চারদিক-গ্লকোমার সঙ্গে বসবাস by এম নজরুল ইসলাম

আজ (১২ মার্চ ২০১১) বিশ্ব গ্লকোমা দিবস। ‘গ্লকোমায় দৃষ্টি হারানো রোধ করুন, পরিবারের সঙ্গেই থাকুন’—এই হচ্ছে এ বছরের বিশ্ব গ্লকোমা দিবসের স্লোগান। বিশ্ব গ্লকোমা সমিতি প্রদত্ত এই স্লোগানে বোঝানো হয়েছে, আপনি দৃষ্টি হারিয়ে ফেললে পরিবারের সদস্যদের দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।


এ ছাড়া স্লোগানের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, গ্লকোমা একটি পারিবারিক চক্ষুরোগ, বংশানুক্রমে এ রোগটি ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, নাতি-নাতনির মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পারে। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছরই মার্চ মাসে বিশ্ব গ্লকোমা দিবস পালন করা হয়। এ ছাড়া গত বছর থেকে এক সপ্তাহব্যাপী ‘বিশ্ব গ্লকোমা সপ্তাহ’ পালন করা হচ্ছে। এ বছর ৬ থেকে ১২ মার্চ বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব্ব গ্লকোমা সপ্তাহ এবং ১২ মার্চ বিশ্ব গ্লকোমা দিবস পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গ্লকোমা সোসাইটি লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার বিতরণ, শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে।
গ্লকোমা রোগটি এখন আর দুই দশক আগের মতো অপরিচিত নাম নয়। বাংলাদেশের অনেকেই গ্লকোমা রোগের নাম শুনেছেন এবং চোখের এ রোগটি সম্পর্কে সামান্য হলেও তাদের ধারণা আছে।
গ্লকোমা সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা আছে—গ্লকোমা হলেই চোখ অন্ধ হয়ে যাবে এবং এর কোনো চিকিৎসা নেই। এই ধারণায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও পুরোপুরি সত্য নয়।
এটা সত্যি, গ্লকোমা চোখের একটি মারাত্মক অসুখ এবং চিকিৎসার আগে পর্যন্ত যেটুকু দৃষ্টি কমে গেছে, সেটা আর ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। তবে যেটুকু দৃষ্টি বিদ্যমান আছে, সেটুকু সুচিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো যায়।
গ্লকোমার সফল অপারেশন হলে সারা জীবনের জন্য আর ড্রপ বা বড়ি ব্যবহারের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
আমি বহুদিন ধরে গ্লকোমার চিকিৎসা করে আসছি এবং লক্ষ করেছি, গ্লকোমা রোগী মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েন। যখন বুঝতে পারেন তাঁর চোখের রোগটি স্থায়ী এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি ও দৃষ্টির পরিসীমা আর কখনো উন্নত হবে না, তখন তাঁরা খুবই মানসিক চাপে থাকেন।
আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চোখের ওষুধ ব্যবহার করলে এবং চোখের চাপ স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে পারলে ভালো থাকার সম্ভাবনা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। বেশির ভাগ গ্লকোমা রোগীই চোখের ফোঁটা ওষুধ ব্যবহার করে ভালো থাকেন।
কারও যদি ওষুধ দিয়ে চোখের চাপ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে গ্লকোমার শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। শল্যচিকিৎসার ঝুঁকি কিছু বেশি হলেও অন্ধত্ব বরণ করার চেয়ে অবশ্যই ভালো। এ বিষয়ে একজন চক্ষু ও গ্লকোমা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে নেওয়াই কাম্য।
চিকিৎসার জন্য ওষুধ বা ইনসুলিন ইনজেকশন দিয়ে ডায়াবেটিসের রোগীর রক্তের শর্করা স্বাভাবিক রাখতে হয়, উচ্চরক্তচাপের জন্য ওষুধ দ্বারা রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে রাখতে হয়। এ দুটো রোগই সারা জীবনের রোগ। সারা জীবন এর চিকিৎসা করাতে হয়। গ্লকোমাও সারা জীবনের রোগ। ওষুধ ব্যবহার করে বা শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে চোখের চাপ স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে হবে। তিন-চার মাস পরপর চিকিৎসককে দিয়ে চোখের চাপ এবং চোখের ভেতরের অপটিক নার্ভের অবস্থা, দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষা করাতে হবে।
গ্লকোমা রোগীর বছরে অন্তত একবার চোখের যাবতীয় ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াও দৃষ্টির পরিসীমা পরীক্ষা করা উচিত। এ ছাড়া চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে আধুনিক কয়েকটি পরীক্ষা, যেমন রেটিনার রঙিন ছবি, ওসিটি মেশিনের সাহায্যে রেটিনার নার্ভ ফাইবার এনালাইসিস, অপটিক ডিস্কের পরীক্ষা ইত্যাদি করানো যেতে পারে।
গ্লকোমা চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চোখের নার্ভের যত বেশি ক্ষতি হওয়ার পর রোগ নির্ণয় হয়, ততই চিকিৎসা জটিল হতে থাকে। এ জন্য চশমার পাওয়ার পরিবর্তন বা অন্য কোনো কারণে যখনই চক্ষু চিকিৎসকের কাছে যাবেন, তখনই জেনে নিন আপনার গ্লকোমা আছে কি না।
একধরনের গ্লকোমায় চোখের চাপ বেড়ে ৬০-৮০ মি.মি. মারকারি হয়ে যায়। এসব রোগীর চোখে প্রচণ্ড ব্যথা, দৃষ্টিশক্তি একেবারেই কমে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া—এসব উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। এ রোগীদের অতি দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে। দু-এক ঘণ্টা দেরিতে এসব রোগীর চোখের নার্ভ অনেকটাই খারাপ হয়ে যেতে পারে।
ছোট শিশুদেরও গ্লকোমা হতে পারে। জন্মগত গ্লকোমা থাকতে চোখের আকৃতি বিশেষ করে কর্নিয়া বা নেত্রস্বচ্ছের আয়তন বাড়তে পারে। চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে, চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে। এসবের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত গ্লকোমা বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। শিশুদের গ্লকোমার চিকিৎসা ওষুধ দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় না, এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শল্যচিকিৎসা করতে হয় এবং ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রে এ চিকিৎসা সফল হয়।
গ্লকোমা হলে দুশ্চিন্তা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করালে গ্লকোমাকে সঙ্গে নিয়েই প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। আপনার দৃষ্টি যতটুকু ভালো আছে, এটা দিয়ে বাকি জীবন ভালোভাবেই বসবাস করতে পারবেন। তবে তার জন্য দরকার দৈনন্দিন জীবনের কিছু নিয়ম ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
আপনারা সবাই ভালো থাকুন। গ্লকোমা থেকে মুক্ত থাকুন। গ্লকোমা হলেও ঘাবড়াবেন না। সুচিকিৎসা আপনাকে ভালো রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.