চিরকুট-ফুল, নোবেল ইত্যাদি by শাহাদুজ্জামান
আমস্টারডামে এক বাংলাদেশি যুবককে চিনতাম, যে শহরের ব্যস্ততম চত্বর লাইসাপ্লেনে সন্ধ্যার পর জমে ওঠা রেস্টুরেন্টগুলোতে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করত। সেটা ২০০৬ সাল, কাজের সূত্রে আমি তখন আমস্টারডামে। একই ট্রামে যাতায়াত করতাম আমরা।
তাকে দেখতাম একটা বিশেষ ধরনের ব্যাগে ফুলগুলোকে উল্টো করে ঢুকিয়ে বয়ে নিয়ে যেত। ফুলের পাপড়িগুলো থাকত অদৃশ্য আর তার ডাঁটাগুলো রহস্যময়ভাবে ঊর্ধ্বমুখী বেরিয়ে থাকত ব্যাগ থেকে। লাইসাপ্লেনে নেমে ব্যাগ থেকে ফুলগুলো বের করত সে। এক এক করে এগিয়ে দিত পানরত যুগলদের দিকে। কিন্তু যুবককে দেখাত বিষণ্ন। পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে। বাংলাদেশে মফস্বলের এক কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিল সে, স্বপ্ন ছিল সাহিত্যচর্চা করবে, শিক্ষকতা করবে। জীবন-জীবিকার নানা পাকচক্রে শেষে এসে পড়েছে আমস্টারডামে। দীর্ঘদিন নানা সংগ্রাম করে এখন এই ফুল বিক্রিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। বলছিল, ‘ফুল একটা উপলক্ষ, ভিক্ষা করেই চলি বলতে পারেন। নিজেকে নর্দমার জীব মনে হয় কখনো কখনো। ফুলওয়ালা পরিচয় রাষ্ট্র করে বেড়াতে চাই না, তাই ট্রামে আসবার সময় ফুলগুলোকে লুকিয়ে রাখি।’ হিম তুষারে প্রতিটি দিন ফুল নিয়ে লাইসাপ্লেনে দাঁড়ায় যুবকটি, আর অনেক রাতে ট্রামে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এক এক করে উপার্জন করা ইউরো কয়েন গোনে। কিন্তু মনে আছে, সে বছর ডিসেম্বরের ১০ তারিখ লাইসাপ্লেনে গেলেও একটি ফুলও সেদিন সে বিক্রি করেনি। বিলিয়ে দিয়েছে সবাইকে। রেস্টুরেন্টের টেবিলে টেবিলে গিয়ে যুবকটি বলেছে, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আজ বাংলাদেশের ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই নিন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি টিউলিপ।’
সরলমতি যুবকটিকে মনে পড়ছে। বেচারার পায়ের নিচে মাতৃভূমি নেই, কিন্তু বুকের ভেতর আছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিন্তু যে বাংলাদেশের পরিচয়ে সে এক অনাত্মীয় ভূমিতে দিন যাপন করে, সে পরিচয় লজ্জার, অপমানের, তাচ্ছিল্যের। দেশের একটি ইতিবাচক প্রতীকের জন্য মুখিয়ে থাকে সে। ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি এমন একটি প্রতীক হয়ে উঠেছিল তার কাছে। নিজের উপার্জনের বিনিময়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এই সংবাদ জনে জনে রটিয়ে দিয়ে ফুল বিক্রেতা যুবক তাই বস্তুত তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা আর দেশের অমর্যাদাকে মোকাবিলা করতে চেয়েছে।
কিন্তু যুবক টের পায়নি তার মাতৃভূমি, এই বাংলাদেশ বড় ঘোরেল জায়গা। এখানে কোনটা প্রতীক, কোনটা প্রতীক নয়, কোনটা মর্যাদার, কোনটা মর্যাদার নয়, সেটাকে তো ঝরনার পানির মতো অমন সোজাসাপ্টা, অমন স্বচ্ছ ভেবে নিলেই চলবে না। যথেষ্ট নাকানিচুবানির পর পানি ঘোলা না হওয়া পর্যন্ত তার মীমাংসা হওয়ার কথা নয়। এখানে ব্যর্থতা একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার তো বটেই, সাফল্যও। তা ছাড়া ওই যুবক ড. ইউনূসকে সাফল্য ভেবে বিহ্বল হয়ে পড়লেও দেশের সবাই তো আর তার মতো অমন আনকোরা নয়। তারা যথেষ্ট সেয়ানা। কেউ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই সবাই এখানে বগল বাজায় না। অমন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য লোকের দু-চারটা নাম অনেকের পকেটে থাকে। তা ছাড়া গরিব দেশের এক মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সব রাজা, মহারাজা, যুবরাজের এত ইয়ার দোস্তিই বা থাকবে কেন? পশ্চিমারা যে নোবেল পুরস্কার ইত্যাদি দিয়ে বস্তুত দরিদ্র দেশে তাদের চর তৈরি করে রাখে, এ খবর সেই যুবক না জানলেও এখানে তা অনেকেই জানে। ফলে তারা দেশবাসীকে পশ্চিমাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলে। কিন্তু এখানে আবার অলৌকিক ব্যাপারও ঘটে। দেখা যায় সেই পশ্চিমা দেশেরই পশ্চিমা কোনো সাংবাদিকের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ দেশের অনেক সাংবাদিক, আইনজ্ঞের রক্ত, মাংস, রোমকূপ সব ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে তারা বোধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এবং ১২ বছরের সুপ্তি থেকে জেগে উঠে এই মুহূর্তেই গ্রামীণ ব্যাংকের যুগ-যুগান্তের যাবতীয় অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার নিষ্পত্তি করার জন্য তারা মরণপণ চেষ্টা করেছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জোয়ারে যখন ড. ইউনূস খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছেন, তখন কারা গিয়ে তাঁর হাত ধরছে? একজন গরিব দরদি বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, তাঁরা হচ্ছেন কিছু নাদুসনুদুস ভদ্রলোকের দল, যাঁরা বস্তুত যাকে বলে ‘সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার’। আবার মওকা পেয়ে তাঁর হাত ধরতে এগিয়ে আসছেন, যাঁরা এখন ক্ষমতার বাইরে আছেন তাঁরাও, যদিও কথিত আছে ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁরাও তাঁকে কাবুলিওয়ালা বলেই সম্বোধন করেছিলেন। ফলে যা বলছিলাম, যুবক টের পায়নি তার মাতৃভূমি, এই বাংলাদেশ বড় ঘোরেল জায়গা। তার দেশের একজন মানুষের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে উল্লসিত হতে গিয়ে সে যেকোনো ফাঁদে পড়বে, সেটা সে টের পায়নি।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে ‘ইউনূস চেয়ার’ উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানে যোগ দিলেন প্রফেসর ক্যাম ডোনাল্ডসন। এ মুহূর্তে ব্রিটেনের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করছি, তার ডিরেক্টর ছিলেন প্রফেসর ক্যাম। ইনস্টিটিউটে একমাত্র বাংলাদেশি পেয়ে গ্লাসগো যাওয়ার আগে আলাপে আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে। বললেন, এই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হওয়ার চেয়ে ‘ইউনূস চেয়ার’ হওয়াকে সম্মানজনক মনে করছেন তিনি। বলছিলেন, অগণিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় যাচ্ছেন বলে তিনি উত্তেজিত। ক্ষুদ্রঋণ কি দারিদ্র্য বিমোচনের মহৌষধ, নাকি এটি একটি বিশেষ ধরনের ঋণব্যবস্থা মাত্র? ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামে পাঠানো কি নেহাতই ঘুমপাড়ানি গান? ক্ষুদ্রঋণ কি বস্তুত পুঁজির বাজার সম্প্রসারণেরই একটি পন্থা মাত্র? ‘সামাজিক ব্যবসা’ ইত্যাদি কি পুঁজিবাদকে সহনীয় রাখার একটি উপায়? নাকি এটি শীতলযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর দারিদ্র্য ভাবনায় একটি নতুন মাত্রা? কিংবা দেউলিয়া ধ্রুপদি অর্থনীতির গালে ক্ষুদ্রঋণ একটি চপেটাঘাত? ক্ষুদ্রঋণ কি কেবল একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নাকি এর রয়েছে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক মাত্রাও? ড. ইউনূস কি প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা, নাকি একজন সফল প্রয়োগকারী? বিশ্ব জ্ঞানকাণ্ডে এটি কি বাংলাদেশের একটি সংযোজন? প্রফেসর ক্যাম বলছিলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন তিনি। এখন মনে পড়ছে তিনি বেশ নাদুসনুদুসই ছিলেন, তবে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার কি না, সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত নই। সাম্রাজ্যবাদী দেশে বসে যখন গবেষণা করছেন, তা-ই হবেন হয়তো। তবে এটা বুঝতে পেরেছি যে তিনিও বাংলাদেশের ঘোরেলপনার খবর জানেন না। তিনি স্কটল্যান্ডে বসে এসব বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করতে পারেন কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। এবং সেই প্রশ্ন হচ্ছে, ড. ইউনূসের বয়স কত? তিনি যে বৃদ্ধ হয়েছেন সেটা আমরা প্রায় বছর দশেক ধরে ভুলে থাকতে পারি, কিন্তু পশ্চিমা জাদুকর সাংবাদিকের ছোঁয়ায় এখন তো আমরা জেগে উঠেছি। এখন তো আবিষ্কৃত হয়েছে যে দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল অনন্যসাধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের উত্তরসূরি তৈরি করলেও নজিরবিহীনভাবে এক গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো উত্তরসূরি তৈরি হয়নি। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলে তিনি তো আইনের ঊর্ধ্বে নন? ড. ইউনূসকে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন দেখে প্রফেসর ক্যাম হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন এটি বিশ্বায়নের এই যুগে একটি রাষ্ট্রের নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার হয়তো কোনো অভিনব, সৃজনশীল কৌশল। নাকি তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত এবং বিভ্রান্তও আছেন?
তবে অনুমান করি, আমস্টারডামের সেই ফুল বিক্রেতা যুবকটি এ মুহূর্তে অপ্রস্তুত আছে। সাহিত্যের ছাত্র সে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে সেটি ট্র্যাজেডি না কমেডি? পাঁচ বছর আগের তার সেই বোকা বোকা কাণ্ডটির জন্য হয়তো তার নিজেকে একজন ভাঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। সে সম্ভবত এখন থেকে ট্রামে যেতে যেতে তার ফুলগুলো আর লুকিয়ে রাখবে না। ভাববে, লোকে তো জানে আমি গরিব দেশের মানুষ, আমাদের দেশে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরের একটি আছে, আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করি, আমরা দোররা মেরে মেয়েদের মেরে ফেলি, আমাদের দেশের লোকেরা বন্যায় ভেসে থাকে, আমি সাহিত্য করার বদলে তুষারে কাঁপতে কাঁপতে ফুল বিক্রি করি। এসব লুকানোর কী আছে, লজ্জা পাওয়ারই বা কী আছে!
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
সরলমতি যুবকটিকে মনে পড়ছে। বেচারার পায়ের নিচে মাতৃভূমি নেই, কিন্তু বুকের ভেতর আছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিন্তু যে বাংলাদেশের পরিচয়ে সে এক অনাত্মীয় ভূমিতে দিন যাপন করে, সে পরিচয় লজ্জার, অপমানের, তাচ্ছিল্যের। দেশের একটি ইতিবাচক প্রতীকের জন্য মুখিয়ে থাকে সে। ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি এমন একটি প্রতীক হয়ে উঠেছিল তার কাছে। নিজের উপার্জনের বিনিময়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এই সংবাদ জনে জনে রটিয়ে দিয়ে ফুল বিক্রেতা যুবক তাই বস্তুত তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা আর দেশের অমর্যাদাকে মোকাবিলা করতে চেয়েছে।
কিন্তু যুবক টের পায়নি তার মাতৃভূমি, এই বাংলাদেশ বড় ঘোরেল জায়গা। এখানে কোনটা প্রতীক, কোনটা প্রতীক নয়, কোনটা মর্যাদার, কোনটা মর্যাদার নয়, সেটাকে তো ঝরনার পানির মতো অমন সোজাসাপ্টা, অমন স্বচ্ছ ভেবে নিলেই চলবে না। যথেষ্ট নাকানিচুবানির পর পানি ঘোলা না হওয়া পর্যন্ত তার মীমাংসা হওয়ার কথা নয়। এখানে ব্যর্থতা একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার তো বটেই, সাফল্যও। তা ছাড়া ওই যুবক ড. ইউনূসকে সাফল্য ভেবে বিহ্বল হয়ে পড়লেও দেশের সবাই তো আর তার মতো অমন আনকোরা নয়। তারা যথেষ্ট সেয়ানা। কেউ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই সবাই এখানে বগল বাজায় না। অমন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য লোকের দু-চারটা নাম অনেকের পকেটে থাকে। তা ছাড়া গরিব দেশের এক মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সব রাজা, মহারাজা, যুবরাজের এত ইয়ার দোস্তিই বা থাকবে কেন? পশ্চিমারা যে নোবেল পুরস্কার ইত্যাদি দিয়ে বস্তুত দরিদ্র দেশে তাদের চর তৈরি করে রাখে, এ খবর সেই যুবক না জানলেও এখানে তা অনেকেই জানে। ফলে তারা দেশবাসীকে পশ্চিমাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলে। কিন্তু এখানে আবার অলৌকিক ব্যাপারও ঘটে। দেখা যায় সেই পশ্চিমা দেশেরই পশ্চিমা কোনো সাংবাদিকের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ দেশের অনেক সাংবাদিক, আইনজ্ঞের রক্ত, মাংস, রোমকূপ সব ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে তারা বোধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এবং ১২ বছরের সুপ্তি থেকে জেগে উঠে এই মুহূর্তেই গ্রামীণ ব্যাংকের যুগ-যুগান্তের যাবতীয় অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার নিষ্পত্তি করার জন্য তারা মরণপণ চেষ্টা করেছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জোয়ারে যখন ড. ইউনূস খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছেন, তখন কারা গিয়ে তাঁর হাত ধরছে? একজন গরিব দরদি বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, তাঁরা হচ্ছেন কিছু নাদুসনুদুস ভদ্রলোকের দল, যাঁরা বস্তুত যাকে বলে ‘সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার’। আবার মওকা পেয়ে তাঁর হাত ধরতে এগিয়ে আসছেন, যাঁরা এখন ক্ষমতার বাইরে আছেন তাঁরাও, যদিও কথিত আছে ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁরাও তাঁকে কাবুলিওয়ালা বলেই সম্বোধন করেছিলেন। ফলে যা বলছিলাম, যুবক টের পায়নি তার মাতৃভূমি, এই বাংলাদেশ বড় ঘোরেল জায়গা। তার দেশের একজন মানুষের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে উল্লসিত হতে গিয়ে সে যেকোনো ফাঁদে পড়বে, সেটা সে টের পায়নি।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে ‘ইউনূস চেয়ার’ উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানে যোগ দিলেন প্রফেসর ক্যাম ডোনাল্ডসন। এ মুহূর্তে ব্রিটেনের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করছি, তার ডিরেক্টর ছিলেন প্রফেসর ক্যাম। ইনস্টিটিউটে একমাত্র বাংলাদেশি পেয়ে গ্লাসগো যাওয়ার আগে আলাপে আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে। বললেন, এই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হওয়ার চেয়ে ‘ইউনূস চেয়ার’ হওয়াকে সম্মানজনক মনে করছেন তিনি। বলছিলেন, অগণিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় যাচ্ছেন বলে তিনি উত্তেজিত। ক্ষুদ্রঋণ কি দারিদ্র্য বিমোচনের মহৌষধ, নাকি এটি একটি বিশেষ ধরনের ঋণব্যবস্থা মাত্র? ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামে পাঠানো কি নেহাতই ঘুমপাড়ানি গান? ক্ষুদ্রঋণ কি বস্তুত পুঁজির বাজার সম্প্রসারণেরই একটি পন্থা মাত্র? ‘সামাজিক ব্যবসা’ ইত্যাদি কি পুঁজিবাদকে সহনীয় রাখার একটি উপায়? নাকি এটি শীতলযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর দারিদ্র্য ভাবনায় একটি নতুন মাত্রা? কিংবা দেউলিয়া ধ্রুপদি অর্থনীতির গালে ক্ষুদ্রঋণ একটি চপেটাঘাত? ক্ষুদ্রঋণ কি কেবল একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নাকি এর রয়েছে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক মাত্রাও? ড. ইউনূস কি প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা, নাকি একজন সফল প্রয়োগকারী? বিশ্ব জ্ঞানকাণ্ডে এটি কি বাংলাদেশের একটি সংযোজন? প্রফেসর ক্যাম বলছিলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন তিনি। এখন মনে পড়ছে তিনি বেশ নাদুসনুদুসই ছিলেন, তবে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার কি না, সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত নই। সাম্রাজ্যবাদী দেশে বসে যখন গবেষণা করছেন, তা-ই হবেন হয়তো। তবে এটা বুঝতে পেরেছি যে তিনিও বাংলাদেশের ঘোরেলপনার খবর জানেন না। তিনি স্কটল্যান্ডে বসে এসব বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করতে পারেন কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। এবং সেই প্রশ্ন হচ্ছে, ড. ইউনূসের বয়স কত? তিনি যে বৃদ্ধ হয়েছেন সেটা আমরা প্রায় বছর দশেক ধরে ভুলে থাকতে পারি, কিন্তু পশ্চিমা জাদুকর সাংবাদিকের ছোঁয়ায় এখন তো আমরা জেগে উঠেছি। এখন তো আবিষ্কৃত হয়েছে যে দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল অনন্যসাধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের উত্তরসূরি তৈরি করলেও নজিরবিহীনভাবে এক গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো উত্তরসূরি তৈরি হয়নি। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলে তিনি তো আইনের ঊর্ধ্বে নন? ড. ইউনূসকে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন দেখে প্রফেসর ক্যাম হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন এটি বিশ্বায়নের এই যুগে একটি রাষ্ট্রের নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার হয়তো কোনো অভিনব, সৃজনশীল কৌশল। নাকি তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত এবং বিভ্রান্তও আছেন?
তবে অনুমান করি, আমস্টারডামের সেই ফুল বিক্রেতা যুবকটি এ মুহূর্তে অপ্রস্তুত আছে। সাহিত্যের ছাত্র সে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে সেটি ট্র্যাজেডি না কমেডি? পাঁচ বছর আগের তার সেই বোকা বোকা কাণ্ডটির জন্য হয়তো তার নিজেকে একজন ভাঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। সে সম্ভবত এখন থেকে ট্রামে যেতে যেতে তার ফুলগুলো আর লুকিয়ে রাখবে না। ভাববে, লোকে তো জানে আমি গরিব দেশের মানুষ, আমাদের দেশে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরের একটি আছে, আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করি, আমরা দোররা মেরে মেয়েদের মেরে ফেলি, আমাদের দেশের লোকেরা বন্যায় ভেসে থাকে, আমি সাহিত্য করার বদলে তুষারে কাঁপতে কাঁপতে ফুল বিক্রি করি। এসব লুকানোর কী আছে, লজ্জা পাওয়ারই বা কী আছে!
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments