হাসিনার ভারত সফর নিয়ে মরিয়ার্টির তারবার্তা
উইকিলিকস ১৬ মার্চ ২০১১ ঢাকা দূতাবাস থেকে পাঠানো বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি তারবার্তা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শুরুর দিন, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারির সকাল নয়টা নয় মিনিটে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এই বার্তাটি পাঠান।
গোপনীয় শ্রেণীভুক্ত এই বার্তাটির বাংলা অনুবাদ এখানে ছাপা হলো।
গোপনীয় শাখা ০২-এর ০১ ঢাকা ০০০০২৭
বিষয়: ভারতে ‘রূপান্তরমূলক’ (ট্রান্সফরমেশনাল) সফরের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তুতি
রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি কর্তৃক গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত। কারণসমূহ ১.৪(বি) ও (ডি)
সারসংক্ষেপ
১(সি). ২০০৯ সালের শুরুতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফরটি শুরু করতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি পৌঁছাবেন। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের মন্থরতা উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরের বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের দায়িত্ব নিজের কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করেন; এবং তাঁর উপদেষ্টা আমাদের বলেন যে তাঁরা আশা করছেন, এই সফরের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘রূপান্তর’ ঘটবে। হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা মনে করেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার উন্নত সম্পর্ককে নয়াদিল্লি অন্যান্য প্রতিবেশীর প্রতি এই বার্তা পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করতে চাইবে যে, আঞ্চলিক বিষয়াবলিতে ভারত এক নতুন পন্থা গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু তাঁর স্বদেশে সন্দিগ্ধ জনগণের কাছে কোনো চুক্তিকে গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নের ফলে এ অঞ্চলে অধিকতর স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি সাধিত হবে এবং এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রক্ষিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হাসিনার ভারত
সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে
২(সি). প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ১০ জানুয়ারি সকালে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে জানান যে ওই দিন আরও পরের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ভারতীয় আলোচকদের সঙ্গে চতুর্থবারের মতো আলোচনা শেষে রিজভী নয়াদিল্লি থেকে ফিরেছেন ৮ জানুয়ারি। রিজভী অবশ্য স্বীকার করেন, প্রথম দিকে ভারতীয়দের এমন সংশয় ছিল যে এই সফর থেকে কী অর্জিত হতে পারে। তবে তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘রূপান্তর’ ঘটানোর লক্ষ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অত্যন্ত গোপন ও ছোট পরিসরে, শুধু গত সপ্তাহে এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। চূড়ান্ত ধাপে এসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও মসিউর রহমানকে—আমলাতন্ত্রের মধ্যে আটকে পড়া চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সম্পর্কে রিজভী বলেন যে তাঁদের সৃজনশীলতা ও দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে।
পুরোনো চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের ওপর
গুরুত্ব আরোপ
৩(সি). বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নতুন ও তুলনামূলকভাবে গৌণ চুক্তিগুলোর (প্রত্যর্পণ, বন্দী বিনিময়, বিদ্যুৎ বিনিময় ইত্যাদি) ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এই সফরকালে সেগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন যে তিনি ও তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষরা প্রধানত গুরুত্ব দিয়েছেন ট্রানজিট ও আন্তযোগাযোগ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তযোগাযোগ-ব্যবস্থা বিকাশ সম্পর্কিত চুক্তি হবে, যেখানে রেল যোগাযোগ ও নৌপরিবহন বিস্তৃতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মংলা ও আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের অনুমতি ভারতকে দেওয়ার বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হবে। (নোট: রিজভী বলেন, এই তিন বন্দরের মধ্যে মংলা বন্দর নিয়ে সর্বাধিক বিতর্ক রয়েছে, কারণ এর ফলে কলকাতা বন্দরের বাণিজ্য স্থানান্তরিত হতে পারে বলে পশ্চিমবঙ্গে স্পর্শকাতরতা রয়েছে।) রিজভী বলেন, সীমান্ত হাট বসানোরও অনুমোদন দেওয়া হবে, যার ফলে চোরাচালান হ্রাস পাবে।
দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য
৪(সি). রিজভী বাণিজ্য সম্প্রসারণের অফুরন্ত সুযোগ দেখেন, বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে। তিনি বলেন, ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের অনুমোদনও এই চুক্তিতে থাকবে। রিজভী বলেন, ভবিষ্যতে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও মনটেক সিং আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য উন্মুক্তকরণে ভারতীয় নেতাদের অঙ্গীকার রয়েছে অংশত অভ্যন্তরীণ শিল্প খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। যখন ভারতীয় রাজ্যগুলোর স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া উচিত, রিজভী তখন বলছেন যে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ভারতীয়রা বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাগুলো সত্যিই সরিয়ে নিতে চায়।
সমুদ্রসীমা ও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে
৫(সি). রিজভী বলেন, আলোচনাকালে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি জটিল বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশ যখন সমুদ্রসীমা বিতর্কটি একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক সালিস কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে, তখন ভারতীয়রা হতাশ হয়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে তাঁকে সামান্য আশাবাদী মনে হয়। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে এ বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ হবে যৌথ নদী কমিশনের একটি সভা এবং বর্তমানে নদীটির পানিপ্রবাহ নির্ধারণের লক্ষ্যে যৌথভাবে পানি জরিপ চালানো। রিজভী এমন আশা ব্যক্ত করেন যে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই কিছু পানি ভাগাভাগি শুরু হবে।
যোগাযোগ-কৌশলের প্রয়োজনীয়তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অবহেলা
৬(সি). রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন যে তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী এক দিনের আজমির জিয়ারত শেষে ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় না ফিরে বিলম্ব করে একটা ভুল করতে যাচ্ছিলেন। রিজভী একান্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় যাত্রাবিরতির মাধ্যমে ভারতে তাঁর অবস্থান দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা তিনি ‘ভণ্ডুল’ (স্যাবোটাজ) করে দিয়েছেন। ১২ জানুয়ারি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষ হলে অবিলম্বে ঢাকা ফেরার পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। রিজভীর চাপের ফলে প্রধানমন্ত্রী সফর শেষে দেশে ফিরে তাঁর সফরের ফলাফল তুলে ধরতে সংসদে বক্তৃতা করবেন। তবে রিজভী শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ২৪ ঘণ্টা বিলম্ব হলে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দল তাঁর সফর সম্পর্কে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পাবে। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে চুক্তিগুলো নিজের গুণেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আমরা রিজভীর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করি যে সরকারকে যদি বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে এবং সফরটি সম্পর্কে একটি পৃথক ব্রিফিং করতে বলা হয়, তাহলে কী সুফল পাওয়া যেতে পারে। বিরোধী দলের সঙ্গে ভারতের অব্যাহত সম্পৃক্ততার গুরুত্ব নিয়েও আমরা আলোচনা করি।
মন্তব্য
৭(সি). দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। এই প্রয়াস সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ রাইফেলসে বিদ্রোহের কারণে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রধান মনোযোগের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর। ২০০৯ সালের শেষ দিকে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় বিদ্রোহীকে (ইনসারজেন্টস) ভারতের কাছে হস্তান্তর এই সফরের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তার ফলে মনে হচ্ছে, এই সফরের ফলাফল বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাকে বেশ ছাড়িয়ে যাবে এবং সরকারের শক্তি বৃদ্ধি করবে। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সরকারের সমালোচনা করতে পারে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ। [২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন সংস্কার সাধনের চেষ্টা করছিল, তখন দুর্বল কৌশলগত যোগাযোগ (স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস) তাদের হাতকে দুর্বল করে দেয়। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার তার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করেনি।] তবে সেই সঙ্গে এ-ও বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবাচক রূপান্তর এই অঞ্চলে অধিকতর স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সহায়ক হতে পারে।
গোপনীয় শাখা ০২-এর ০১ ঢাকা ০০০০২৭
বিষয়: ভারতে ‘রূপান্তরমূলক’ (ট্রান্সফরমেশনাল) সফরের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তুতি
রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি কর্তৃক গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত। কারণসমূহ ১.৪(বি) ও (ডি)
সারসংক্ষেপ
১(সি). ২০০৯ সালের শুরুতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফরটি শুরু করতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি পৌঁছাবেন। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের মন্থরতা উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরের বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের দায়িত্ব নিজের কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করেন; এবং তাঁর উপদেষ্টা আমাদের বলেন যে তাঁরা আশা করছেন, এই সফরের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘রূপান্তর’ ঘটবে। হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা মনে করেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার উন্নত সম্পর্ককে নয়াদিল্লি অন্যান্য প্রতিবেশীর প্রতি এই বার্তা পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করতে চাইবে যে, আঞ্চলিক বিষয়াবলিতে ভারত এক নতুন পন্থা গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু তাঁর স্বদেশে সন্দিগ্ধ জনগণের কাছে কোনো চুক্তিকে গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নের ফলে এ অঞ্চলে অধিকতর স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি সাধিত হবে এবং এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রক্ষিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হাসিনার ভারত
সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে
২(সি). প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ১০ জানুয়ারি সকালে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে জানান যে ওই দিন আরও পরের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ভারতীয় আলোচকদের সঙ্গে চতুর্থবারের মতো আলোচনা শেষে রিজভী নয়াদিল্লি থেকে ফিরেছেন ৮ জানুয়ারি। রিজভী অবশ্য স্বীকার করেন, প্রথম দিকে ভারতীয়দের এমন সংশয় ছিল যে এই সফর থেকে কী অর্জিত হতে পারে। তবে তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘রূপান্তর’ ঘটানোর লক্ষ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অত্যন্ত গোপন ও ছোট পরিসরে, শুধু গত সপ্তাহে এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। চূড়ান্ত ধাপে এসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও মসিউর রহমানকে—আমলাতন্ত্রের মধ্যে আটকে পড়া চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সম্পর্কে রিজভী বলেন যে তাঁদের সৃজনশীলতা ও দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে।
পুরোনো চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের ওপর
গুরুত্ব আরোপ
৩(সি). বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নতুন ও তুলনামূলকভাবে গৌণ চুক্তিগুলোর (প্রত্যর্পণ, বন্দী বিনিময়, বিদ্যুৎ বিনিময় ইত্যাদি) ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এই সফরকালে সেগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন যে তিনি ও তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষরা প্রধানত গুরুত্ব দিয়েছেন ট্রানজিট ও আন্তযোগাযোগ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তযোগাযোগ-ব্যবস্থা বিকাশ সম্পর্কিত চুক্তি হবে, যেখানে রেল যোগাযোগ ও নৌপরিবহন বিস্তৃতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মংলা ও আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের অনুমতি ভারতকে দেওয়ার বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হবে। (নোট: রিজভী বলেন, এই তিন বন্দরের মধ্যে মংলা বন্দর নিয়ে সর্বাধিক বিতর্ক রয়েছে, কারণ এর ফলে কলকাতা বন্দরের বাণিজ্য স্থানান্তরিত হতে পারে বলে পশ্চিমবঙ্গে স্পর্শকাতরতা রয়েছে।) রিজভী বলেন, সীমান্ত হাট বসানোরও অনুমোদন দেওয়া হবে, যার ফলে চোরাচালান হ্রাস পাবে।
দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য
৪(সি). রিজভী বাণিজ্য সম্প্রসারণের অফুরন্ত সুযোগ দেখেন, বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে। তিনি বলেন, ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের অনুমোদনও এই চুক্তিতে থাকবে। রিজভী বলেন, ভবিষ্যতে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও মনটেক সিং আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য উন্মুক্তকরণে ভারতীয় নেতাদের অঙ্গীকার রয়েছে অংশত অভ্যন্তরীণ শিল্প খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। যখন ভারতীয় রাজ্যগুলোর স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া উচিত, রিজভী তখন বলছেন যে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ভারতীয়রা বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাগুলো সত্যিই সরিয়ে নিতে চায়।
সমুদ্রসীমা ও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে
৫(সি). রিজভী বলেন, আলোচনাকালে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি জটিল বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশ যখন সমুদ্রসীমা বিতর্কটি একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক সালিস কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে, তখন ভারতীয়রা হতাশ হয়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে তাঁকে সামান্য আশাবাদী মনে হয়। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে এ বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ হবে যৌথ নদী কমিশনের একটি সভা এবং বর্তমানে নদীটির পানিপ্রবাহ নির্ধারণের লক্ষ্যে যৌথভাবে পানি জরিপ চালানো। রিজভী এমন আশা ব্যক্ত করেন যে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই কিছু পানি ভাগাভাগি শুরু হবে।
যোগাযোগ-কৌশলের প্রয়োজনীয়তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অবহেলা
৬(সি). রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন যে তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী এক দিনের আজমির জিয়ারত শেষে ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় না ফিরে বিলম্ব করে একটা ভুল করতে যাচ্ছিলেন। রিজভী একান্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় যাত্রাবিরতির মাধ্যমে ভারতে তাঁর অবস্থান দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা তিনি ‘ভণ্ডুল’ (স্যাবোটাজ) করে দিয়েছেন। ১২ জানুয়ারি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষ হলে অবিলম্বে ঢাকা ফেরার পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। রিজভীর চাপের ফলে প্রধানমন্ত্রী সফর শেষে দেশে ফিরে তাঁর সফরের ফলাফল তুলে ধরতে সংসদে বক্তৃতা করবেন। তবে রিজভী শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ২৪ ঘণ্টা বিলম্ব হলে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দল তাঁর সফর সম্পর্কে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পাবে। রিজভীর ভাষ্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে চুক্তিগুলো নিজের গুণেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আমরা রিজভীর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করি যে সরকারকে যদি বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে এবং সফরটি সম্পর্কে একটি পৃথক ব্রিফিং করতে বলা হয়, তাহলে কী সুফল পাওয়া যেতে পারে। বিরোধী দলের সঙ্গে ভারতের অব্যাহত সম্পৃক্ততার গুরুত্ব নিয়েও আমরা আলোচনা করি।
মন্তব্য
৭(সি). দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। এই প্রয়াস সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ রাইফেলসে বিদ্রোহের কারণে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রধান মনোযোগের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর। ২০০৯ সালের শেষ দিকে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় বিদ্রোহীকে (ইনসারজেন্টস) ভারতের কাছে হস্তান্তর এই সফরের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তার ফলে মনে হচ্ছে, এই সফরের ফলাফল বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাকে বেশ ছাড়িয়ে যাবে এবং সরকারের শক্তি বৃদ্ধি করবে। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সরকারের সমালোচনা করতে পারে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ। [২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন সংস্কার সাধনের চেষ্টা করছিল, তখন দুর্বল কৌশলগত যোগাযোগ (স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস) তাদের হাতকে দুর্বল করে দেয়। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার তার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করেনি।] তবে সেই সঙ্গে এ-ও বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবাচক রূপান্তর এই অঞ্চলে অধিকতর স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সহায়ক হতে পারে।
No comments