বিশেষ সাক্ষাৎ কার-বৈষম্য কমানো ও গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণই বড় চ্যালেঞ্জ by রেহমান সোবহান
রেহমান সোবহানের জন্ম ১৯৩৫ সালে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭২-৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। রেহমান সোবহান বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি চিন্তাশালা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি এই সংস্থার বোর্ড সদস্য।
সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্য, তার কারণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে, প্রচুর বইপত্র লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এটা কেন? বাস্তবে এসব গবেষণার সুফল কেন পাওয়া যাচ্ছে না?
রেহমান সোবহান হ্যাঁ, গবেষণা অনেক হয়েছে, অনেক বছর ধরে অনেক বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যাঁরা দারিদ্র্য-সংক্রান্ত নীতিগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন, তাঁরা এসব বইপত্র কমই পড়েন। অধিকাংশ গবেষণাই তাঁরা পড়েন না। আবার এসব গবেষণা থেকে পাওয়া কিছু ভাবনা যদি সরকারি নীতিমালার মধ্যে স্থান পেয়েও যায়, সেগুলো খুব একটা বাস্তবায়িত হয় না। অবশ্য দারিদ্র্যের উৎ সগুলো কী, যেসব অন্যায্য ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় এবং অব্যাহত থাকে, সেগুলোর স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যগুলো কী—খুব কমসংখ্যক গবেষণাতেই এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়। তাই, দারিদ্র্যের উৎ সগুলো নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল গ্রহণের ব্যর্থতার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারছে না।
প্রথম আলো আপনার সাম্প্রতিক বই চ্যালেঞ্জিং দি ইনজাস্টিস অব পভার্টিতে আপনি দাবি করেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এ বইতে আপনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা এ বিষয়ে অন্যরা বলেননি। নতুন কী কথা আপনি বলেছেন এ বইতে?
রেহমান সোবহান বলার চেষ্টা করেছি, দারিদ্র্যকে আয়-বঞ্চনা হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। দারিদ্র্য বিষয়ে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আয়-বঞ্চনা বা ইনকাম ডিপ্রাইভেশন দারিদ্র্যের একটা লক্ষণমাত্র, উৎ স নয়। এ বইতে দারিদ্র্য সংজ্ঞায়িত হয়েছে নতুনভাবে: দারিদ্র্য হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার অন্যায্য বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজের বিভিন্ন অংশ উন্নয়নের সুযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আমরা ইনজাস্টিস বা অবিচারের চারটি উৎ সের ওপর জোরারোপ করেছি। এক. সম্পদের অসম অধিকার, দুই. বাজারব্যবস্থায় অসম অংশগ্রহণ; তিন. মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুযোগের অসমতা; এবং চার. অন্যায্য শাসনব্যবস্থা। দক্ষিণ এশিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের নানা কর্মসূচির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমাদের এ বইতে সুনির্দিষ্ট কতকগুলো নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যকে চ্যালেঞ্জ করা যায়।
প্রথম আলো আপনি বলছেন, দারিদ্র্য হচ্ছে ইনজাস্টিস, বাংলায় বলা যায়, অবিচার। আপনার এ বইতে আপনি এই অবিচারের কাঠামোগত দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমাদের দেশে আয়ের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য (ইনকাম পভার্টি) কমানোর লক্ষ্যে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কিছুমাত্রায় সফলও হয়েছে, কিছু দরিদ্র মানুষের আয় বেড়েছে, অনেক আয়হীন মানুষ এখন আয় করছেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন, এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ইনজাস্টিস কমতে পারে, বা কমছে কি না?
রেহমান সোবহান ইনকাম পভার্টি বা আয়-দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কতকগুলো সফল উদ্যোগ রয়েছে। সরকারি এবং এনজিও—উভয় খাতেই এসব উদ্যোগ শুরু করা হয়েছিল। এসব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ইনজাস্টিস কিছু মাত্রায় কমে আসতে পারে, কিন্তু নিরসন হবে না। দুঃখের বিষয়, এসব কর্মসূচিও খণ্ডিত এবং এগুলো ইনজাস্টিসের উৎ সগুলো স্পর্শ করে না বললেই চলে।
প্রথম আলো কেউ কেউ বলেন, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করছে। দারিদ্র্যের যে চক্রের মধ্যে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ তাদের সেই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে না। এ বিষয় আপনি কী বলেন?
রেহমান সোবহান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রথাগত ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দরিদ্র মানুষেরা সহজে ঋণ পায় না। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা তাদের ঋণ দিয়ে আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে দক্ষিণ ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ কার্যকর হয়েছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছাতে আমাদের প্রথাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকালের এই ব্যর্থতায় ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় এ সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে দরিদ্র মানুষেরা ঋণ পাওয়ার যোগ্য। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেশি—এটা থেকে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে ঋণগ্রহীতা হিসেবে অভিজাত ধনী লোকদের চেয়ে দরিদ্র লোকদের যোগ্যতা অনেক বেশি। কারণ, ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থায় ঋণখেলাপির হারের চেয়ে ধনী লোকদের ঋণখেলাপির হার অনেক বেশি। অবশ্য ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যচক্রের পুরো সমস্যার সমাধান করতে পারে না; একটি অংশের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। দরিদ্র মানুষের পুঁজির অভাবটা লাঘব করতে পারে, তার হাতে কিছু পুঁজি দিয়ে তার আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। দারিদ্র্যের অন্য উৎ সগুলো যেমন বাজারব্যবস্থা ও মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব—এগুলো ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা স্পর্শ করে না। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতার কথা লেখালেখির মাধ্যমে আমি অনেক বছর ধরে বলে আসছি। আমি মনে করি, দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়ে আরও আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। কিন্তু এর মানে আবার এটা নয় যে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার কোনো কৃতিত্ব নেই। লাখ লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকা রক্ষায় ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষুদ্রঋণ না পেলে হয়তো এই পরিবারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হতো।
প্রথম আলো আপনি যে ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলেন, তা প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাবিস্তারের গুরুত্ব খুব বেশি। কিন্তু সরকারগুলো এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। আপনি লিখেছেন, শিক্ষার সুযোগের গণতন্ত্রায়ণ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো প্রবণতা, শিক্ষা ক্রমশই ধনীদের বিষয় হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রেহমান সোবহান দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে—শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ছাড়া—শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। ধনী ও অভিজাতদের সন্তানেরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নত মানের শিক্ষা পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা সরকারি, বেসরকারি স্কুল-কলেজে এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাতে নিম্নমানের শিক্ষা পাচ্ছে। এই বিভাজনটা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ, প্রতিটি দেশেই নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়ান বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, তাই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের তেমন মাথাব্যথা নেই। এক প্রজন্ম আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, এমনকি তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতেন সরকারি জেলা স্কুলগুলোতে, তারপর ভর্তি হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন আর সে রকম নেই। এখন অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সংসদ সদস্যদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অধিকাংশই ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, অথবা তাঁরা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে। এত তথ্যযুগে যেখানে জ্ঞানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার মতো নীতি যত দিন পর্যন্ত গ্রহণ করা না হচ্ছে, তত দিন আমাদের সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন বেড়েই চলবে। এই বিভাজনের এক দিকে থাকবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত শাসকশ্রেণী, অন্যদিকে নিম্নমানের শিক্ষায় শিক্ষিত জনসাধারণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য এটা হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যাপার।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে কিছু সাফল্য সত্ত্বেও সামাজিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক অস্থিরতাও যে বাড়ছে, হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
রেহমান সোবহান প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নয়া-উদারপন্থী এজেন্ডার ভিত্তিতে যে উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাতে অর্থনৈতিক অসমতা ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ারই কথা, এবং তা বছরের পর বছর ধরে বেড়েই চলেছে। যে সমাজে একজন গার্মেন্টস মালিক নিউইয়র্ক শহরের একজন ধনকুবেরের মতো প্রাচুর্যময় ভোগবিলাসী জীবন যাপন করেন, আর তাঁর কারখানার নারী শ্রমিকেরা বস্তিতে বাস করেন, মাসে ৩০ ডলার বা ২১০০ টাকায় জীবন ধারণ করেন, অথবা যে সমাজে আম্বানি মুম্বাই শহরে কয়েক কোটি ডলার খরচ করে অট্টালিকা বানান, আর তাঁর দেশের কোটি কোটি মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে, সে রকম সমাজ তো নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সামাজিকভাবে বিপজ্জনক এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। আমরা যদি শুধু আমাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেই আঁচ করা যায়, সামনে কী বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। ভারতের কিছু অঞ্চলে মাওবাদী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়া, নেপালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে মাওবাদীদের বেরিয়ে আসা এবং পাকিস্তানজুড়ে মৌলবাদী শক্তিগুলোর ক্রবর্ধমান হুমকি—এগুলো সামাজিক অস্থিরতারই ফল, যা সৃষ্টি হয়েছে অসমতা ও অবিচার থেকে।
প্রথম আলো যেসব কাঠামোগত অবিচার বা স্ট্রাকচারাল ইনজাস্টিসের কারণে দারিদ্র্য ও অসাম্য সৃষ্টি হয়, আপনি কি মনে করেন, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেগুলো দূর করে একটি সমতাভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব?
রেহমান সোবহান আমাদের বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সেই সব কাঠামোগত অবিচার দূর করা খুব কঠিন, যেগুলো থেকে দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয় এবং যেগুলো দারিদ্র্য অব্যাহত রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি এখন ধনী লোকদের কারবার। সে কারবারে টাকা আর পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া, পুরো নির্বাচনী-প্রক্রিয়ার ফলাফল। আমি আমার বইতে বলেছি যে অবিচার রোধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের এই গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। কীভাবে তা করা যায়, তা নিয়ে আরেকটি বই রচিত হতে পারে। আশার কথা, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে অন্যান্য গবেষক ও পণ্ডিত এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তবে আমার বইতে প্রচুরসংখ্যক নীতিপ্রস্তাব রয়েছে। যদি কোনো সরকার ন্যূনতম আন্তরিকতার সঙ্গে কাঠামোগত অবিচারগুলো দূর করতে চায়, তাহলে আমার নীতিপ্রস্তাবগুলো বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও প্রয়োগযোগ্য হতে পারে। কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে না। সেগুলো এনজিওরাও বাস্তবায়ন করতে পারে, যেসব এনজিও তাদের গ্রাহকদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। বেসরকারি খাতের যাঁরা সামাজিকভাবে অধিকতর সচেতন, তাঁরাও এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। বড় এনজিওগুলো নিজেদের উদ্যোগেই নিজেদের একেকটি করপোরেশনে রূপান্তর করতে পারে, যে করপোরেশনের মালিক হবে ওই এনজিওর গ্রাহকেরা, যারা সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ। ওই করপোরেশনের জবাবদিহিও থাকবে তাদের কাছেই। এ ক্ষেত্রে ভারতের সেলফ এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের (এসইডব্লিউএ) দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা যেতে পারে। ভারতে আইটিসি যে লাখ লাখ কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে, তাদের ইক্যুইটি শেয়ার দেওয়ার ক্ষেত্রে তো কোনো অপ্রতিরোধ্য বাধা নেই। বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত গার্মেন্ট মালিক যদি তাঁর কারখানার শ্রমিকদের কারখানাটির ইক্যুইটি শেয়ার পাওয়ার সুযোগ করে দেন, যাতে করে তাঁরা তাঁদের শ্রমে সৃষ্ট মূল্য সংযোজনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোই উপকৃত হবে, কারণ এর মধ্য দিয়ে তাঁদের শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টি হবে, তাঁরা কোম্পানির আরও উন্নতি, আরও মুনাফার জন্য কাজ করবেন।
প্রথম আলো এখন বর্তমান সরকারের কর্মসম্পাদন, জাতীয় সংসদ, বিরোধী দলের ভূমিকা—এসব নিয়ে কিছু বলবেন?
রেহমান সোবহান এ বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা যাবে না। শুধু এটুকু বলি, প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। আমরা আশা করি, সামনের তিন বছরে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষ এই দূরত্ব নিরসনের উদ্যোগ নেবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রেহমান সোবহান ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্য, তার কারণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে, প্রচুর বইপত্র লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এটা কেন? বাস্তবে এসব গবেষণার সুফল কেন পাওয়া যাচ্ছে না?
রেহমান সোবহান হ্যাঁ, গবেষণা অনেক হয়েছে, অনেক বছর ধরে অনেক বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যাঁরা দারিদ্র্য-সংক্রান্ত নীতিগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন, তাঁরা এসব বইপত্র কমই পড়েন। অধিকাংশ গবেষণাই তাঁরা পড়েন না। আবার এসব গবেষণা থেকে পাওয়া কিছু ভাবনা যদি সরকারি নীতিমালার মধ্যে স্থান পেয়েও যায়, সেগুলো খুব একটা বাস্তবায়িত হয় না। অবশ্য দারিদ্র্যের উৎ সগুলো কী, যেসব অন্যায্য ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় এবং অব্যাহত থাকে, সেগুলোর স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যগুলো কী—খুব কমসংখ্যক গবেষণাতেই এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়। তাই, দারিদ্র্যের উৎ সগুলো নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল গ্রহণের ব্যর্থতার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারছে না।
প্রথম আলো আপনার সাম্প্রতিক বই চ্যালেঞ্জিং দি ইনজাস্টিস অব পভার্টিতে আপনি দাবি করেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এ বইতে আপনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা এ বিষয়ে অন্যরা বলেননি। নতুন কী কথা আপনি বলেছেন এ বইতে?
রেহমান সোবহান বলার চেষ্টা করেছি, দারিদ্র্যকে আয়-বঞ্চনা হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। দারিদ্র্য বিষয়ে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আয়-বঞ্চনা বা ইনকাম ডিপ্রাইভেশন দারিদ্র্যের একটা লক্ষণমাত্র, উৎ স নয়। এ বইতে দারিদ্র্য সংজ্ঞায়িত হয়েছে নতুনভাবে: দারিদ্র্য হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার অন্যায্য বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজের বিভিন্ন অংশ উন্নয়নের সুযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আমরা ইনজাস্টিস বা অবিচারের চারটি উৎ সের ওপর জোরারোপ করেছি। এক. সম্পদের অসম অধিকার, দুই. বাজারব্যবস্থায় অসম অংশগ্রহণ; তিন. মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুযোগের অসমতা; এবং চার. অন্যায্য শাসনব্যবস্থা। দক্ষিণ এশিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের নানা কর্মসূচির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমাদের এ বইতে সুনির্দিষ্ট কতকগুলো নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যকে চ্যালেঞ্জ করা যায়।
প্রথম আলো আপনি বলছেন, দারিদ্র্য হচ্ছে ইনজাস্টিস, বাংলায় বলা যায়, অবিচার। আপনার এ বইতে আপনি এই অবিচারের কাঠামোগত দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমাদের দেশে আয়ের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য (ইনকাম পভার্টি) কমানোর লক্ষ্যে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কিছুমাত্রায় সফলও হয়েছে, কিছু দরিদ্র মানুষের আয় বেড়েছে, অনেক আয়হীন মানুষ এখন আয় করছেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন, এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ইনজাস্টিস কমতে পারে, বা কমছে কি না?
রেহমান সোবহান ইনকাম পভার্টি বা আয়-দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কতকগুলো সফল উদ্যোগ রয়েছে। সরকারি এবং এনজিও—উভয় খাতেই এসব উদ্যোগ শুরু করা হয়েছিল। এসব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ইনজাস্টিস কিছু মাত্রায় কমে আসতে পারে, কিন্তু নিরসন হবে না। দুঃখের বিষয়, এসব কর্মসূচিও খণ্ডিত এবং এগুলো ইনজাস্টিসের উৎ সগুলো স্পর্শ করে না বললেই চলে।
প্রথম আলো কেউ কেউ বলেন, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করছে। দারিদ্র্যের যে চক্রের মধ্যে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ তাদের সেই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে না। এ বিষয় আপনি কী বলেন?
রেহমান সোবহান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রথাগত ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দরিদ্র মানুষেরা সহজে ঋণ পায় না। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা তাদের ঋণ দিয়ে আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে দক্ষিণ ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ কার্যকর হয়েছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছাতে আমাদের প্রথাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকালের এই ব্যর্থতায় ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় এ সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে দরিদ্র মানুষেরা ঋণ পাওয়ার যোগ্য। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেশি—এটা থেকে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে ঋণগ্রহীতা হিসেবে অভিজাত ধনী লোকদের চেয়ে দরিদ্র লোকদের যোগ্যতা অনেক বেশি। কারণ, ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থায় ঋণখেলাপির হারের চেয়ে ধনী লোকদের ঋণখেলাপির হার অনেক বেশি। অবশ্য ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যচক্রের পুরো সমস্যার সমাধান করতে পারে না; একটি অংশের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। দরিদ্র মানুষের পুঁজির অভাবটা লাঘব করতে পারে, তার হাতে কিছু পুঁজি দিয়ে তার আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। দারিদ্র্যের অন্য উৎ সগুলো যেমন বাজারব্যবস্থা ও মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব—এগুলো ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা স্পর্শ করে না। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতার কথা লেখালেখির মাধ্যমে আমি অনেক বছর ধরে বলে আসছি। আমি মনে করি, দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়ে আরও আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। কিন্তু এর মানে আবার এটা নয় যে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার কোনো কৃতিত্ব নেই। লাখ লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকা রক্ষায় ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষুদ্রঋণ না পেলে হয়তো এই পরিবারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হতো।
প্রথম আলো আপনি যে ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলেন, তা প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাবিস্তারের গুরুত্ব খুব বেশি। কিন্তু সরকারগুলো এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। আপনি লিখেছেন, শিক্ষার সুযোগের গণতন্ত্রায়ণ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো প্রবণতা, শিক্ষা ক্রমশই ধনীদের বিষয় হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রেহমান সোবহান দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে—শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ছাড়া—শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। ধনী ও অভিজাতদের সন্তানেরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নত মানের শিক্ষা পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা সরকারি, বেসরকারি স্কুল-কলেজে এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাতে নিম্নমানের শিক্ষা পাচ্ছে। এই বিভাজনটা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ, প্রতিটি দেশেই নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়ান বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, তাই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের তেমন মাথাব্যথা নেই। এক প্রজন্ম আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, এমনকি তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতেন সরকারি জেলা স্কুলগুলোতে, তারপর ভর্তি হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন আর সে রকম নেই। এখন অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সংসদ সদস্যদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অধিকাংশই ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, অথবা তাঁরা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে। এত তথ্যযুগে যেখানে জ্ঞানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার মতো নীতি যত দিন পর্যন্ত গ্রহণ করা না হচ্ছে, তত দিন আমাদের সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন বেড়েই চলবে। এই বিভাজনের এক দিকে থাকবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত শাসকশ্রেণী, অন্যদিকে নিম্নমানের শিক্ষায় শিক্ষিত জনসাধারণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য এটা হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যাপার।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে কিছু সাফল্য সত্ত্বেও সামাজিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক অস্থিরতাও যে বাড়ছে, হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
রেহমান সোবহান প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নয়া-উদারপন্থী এজেন্ডার ভিত্তিতে যে উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাতে অর্থনৈতিক অসমতা ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ারই কথা, এবং তা বছরের পর বছর ধরে বেড়েই চলেছে। যে সমাজে একজন গার্মেন্টস মালিক নিউইয়র্ক শহরের একজন ধনকুবেরের মতো প্রাচুর্যময় ভোগবিলাসী জীবন যাপন করেন, আর তাঁর কারখানার নারী শ্রমিকেরা বস্তিতে বাস করেন, মাসে ৩০ ডলার বা ২১০০ টাকায় জীবন ধারণ করেন, অথবা যে সমাজে আম্বানি মুম্বাই শহরে কয়েক কোটি ডলার খরচ করে অট্টালিকা বানান, আর তাঁর দেশের কোটি কোটি মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে, সে রকম সমাজ তো নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সামাজিকভাবে বিপজ্জনক এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। আমরা যদি শুধু আমাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেই আঁচ করা যায়, সামনে কী বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। ভারতের কিছু অঞ্চলে মাওবাদী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়া, নেপালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে মাওবাদীদের বেরিয়ে আসা এবং পাকিস্তানজুড়ে মৌলবাদী শক্তিগুলোর ক্রবর্ধমান হুমকি—এগুলো সামাজিক অস্থিরতারই ফল, যা সৃষ্টি হয়েছে অসমতা ও অবিচার থেকে।
প্রথম আলো যেসব কাঠামোগত অবিচার বা স্ট্রাকচারাল ইনজাস্টিসের কারণে দারিদ্র্য ও অসাম্য সৃষ্টি হয়, আপনি কি মনে করেন, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেগুলো দূর করে একটি সমতাভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব?
রেহমান সোবহান আমাদের বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সেই সব কাঠামোগত অবিচার দূর করা খুব কঠিন, যেগুলো থেকে দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয় এবং যেগুলো দারিদ্র্য অব্যাহত রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি এখন ধনী লোকদের কারবার। সে কারবারে টাকা আর পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া, পুরো নির্বাচনী-প্রক্রিয়ার ফলাফল। আমি আমার বইতে বলেছি যে অবিচার রোধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের এই গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। কীভাবে তা করা যায়, তা নিয়ে আরেকটি বই রচিত হতে পারে। আশার কথা, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে অন্যান্য গবেষক ও পণ্ডিত এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তবে আমার বইতে প্রচুরসংখ্যক নীতিপ্রস্তাব রয়েছে। যদি কোনো সরকার ন্যূনতম আন্তরিকতার সঙ্গে কাঠামোগত অবিচারগুলো দূর করতে চায়, তাহলে আমার নীতিপ্রস্তাবগুলো বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও প্রয়োগযোগ্য হতে পারে। কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে না। সেগুলো এনজিওরাও বাস্তবায়ন করতে পারে, যেসব এনজিও তাদের গ্রাহকদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। বেসরকারি খাতের যাঁরা সামাজিকভাবে অধিকতর সচেতন, তাঁরাও এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। বড় এনজিওগুলো নিজেদের উদ্যোগেই নিজেদের একেকটি করপোরেশনে রূপান্তর করতে পারে, যে করপোরেশনের মালিক হবে ওই এনজিওর গ্রাহকেরা, যারা সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ। ওই করপোরেশনের জবাবদিহিও থাকবে তাদের কাছেই। এ ক্ষেত্রে ভারতের সেলফ এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের (এসইডব্লিউএ) দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা যেতে পারে। ভারতে আইটিসি যে লাখ লাখ কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে, তাদের ইক্যুইটি শেয়ার দেওয়ার ক্ষেত্রে তো কোনো অপ্রতিরোধ্য বাধা নেই। বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত গার্মেন্ট মালিক যদি তাঁর কারখানার শ্রমিকদের কারখানাটির ইক্যুইটি শেয়ার পাওয়ার সুযোগ করে দেন, যাতে করে তাঁরা তাঁদের শ্রমে সৃষ্ট মূল্য সংযোজনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোই উপকৃত হবে, কারণ এর মধ্য দিয়ে তাঁদের শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টি হবে, তাঁরা কোম্পানির আরও উন্নতি, আরও মুনাফার জন্য কাজ করবেন।
প্রথম আলো এখন বর্তমান সরকারের কর্মসম্পাদন, জাতীয় সংসদ, বিরোধী দলের ভূমিকা—এসব নিয়ে কিছু বলবেন?
রেহমান সোবহান এ বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা যাবে না। শুধু এটুকু বলি, প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। আমরা আশা করি, সামনের তিন বছরে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষ এই দূরত্ব নিরসনের উদ্যোগ নেবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রেহমান সোবহান ধন্যবাদ।
No comments