চারদিক-ভাস্কর নিজের ব্যাপারে তথ্য দেবেন by সায়েমা চৌধুরী

ভাস্কর ভট্টাচার্য, ডিজিটালি অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেমের (ডিইসি) একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের উদ্যোগে তৈরি জাতীয় ই-তথ্যকোষের একজন কনটেন্ট ডেভেলপার এবং ওয়েবসাইটটির প্রবেশগম্যতাবিষয়ক একজন পরামর্শক।


চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (ইপসা) কর্মরত ভাস্কর আরও কাজ করছেন প্রতিবন্ধীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, তাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ, ডিজিটালি অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেমের আওতায় বই প্রকাশ এবং আমেরিকান জব অ্যাকসেস উইথ স্পিচ (জস) সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য কম্পিউটার শেখার সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে।
আমরা আজ ভাস্কর ভট্টাচার্যকে নিয়ে কথা বলছি। আসলে আমরা কথা বলছি, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বিষয়ে। আদমশুমারি শুরু হয়ে গেছে। ১০ বছরে একবারই তা হয়। সুতরাং এবারের আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধী মানুষ যেন অংশ নিতে পারে, তা নিশ্চিত করার একটা দায়িত্ব আপনারও আছে। ভাস্কর ভট্টাচার্যকে নিয়ে বলার অর্থ সব প্রতিবন্ধীকে নিয়েই কথা বলা। সে ব্যাপারে আসার আগে আমরা ভাস্করকে নিয়েই আরেকটু কথা বলে নিই। জেনে নিই একজন মানুষের গল্প। আজকের এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সফল পেশাজীবী ভাস্কর ভট্টাচার্যের বেড়ে ওঠা এতটা মসৃণ ছিল না।
১৯৭৯ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার বাগদণ্ডী গ্রামে তাঁর জন্ম। জন্মের পর দুই বছর বয়সেই দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। ভাস্কর যত বড় হতে থাকেন, ততই বাড়তে থাকে মা-বাবা ও স্বজনদের উৎকণ্ঠা। কী হবে ভাস্করের ভবিষ্যৎ? পড়ালেখাই বা করবে কীভাবে? কিন্তু তাঁরা হাল ছাড়েননি, সন্তান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে লুকিয়েও রাখেননি। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ার বই কোথাও আছে, কোথাও নেই, ব্রেইল পেপার ও ব্রেইল ফ্রেমের স্বল্পতা—এমনই বৈরী পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে স্কুল-কলেজের পাঠ শেষ করেন ভাস্কর। নানা বিপত্তি পেরিয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ভাস্করসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীই ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রথম ব্যাচ।
বিশ্ববিদ্যায়ের পড়াশোনা শেষে সুযোগ পেলেন জাপানে চতুর্থ ডাস্কিন লিডারশিপ ট্রেনিংয়ের। ২০০২ সালে জাপানে এক বছরব্যাপী ট্রেনিং শেষ করে তিনি দেশে ফেরেন ব্রেইল সিস্টেম, ডিজিটালি অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম, ব্লাইন্ড স্কুল সিস্টেম, ব্রেইল লাইব্রেরি সিস্টেম, লিডারশিপ ও কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিষয়ে পারদর্শিতা নিয়ে।
চার বছর আগে সহকর্মী শ্যামশ্রীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ভাস্কর। তাঁর দৃষ্টিহীনতা কোনো বাধাই নয় দৃষ্টিমান শ্যামশ্রীর কাছে। তাঁদের ভালোবাসার সংসার আলো করে আছে এক কন্যাসন্তান, শোভা। ৩১ বছর বয়সে যেকোনো এক দৃষ্টিমান ব্যক্তির চেয়েও সুখী ও সফল আজ ভাস্কর ভট্টাচার্য। নিজের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বিব্রত নন তিনি।
ভাস্কর ভট্টাচাযের্র মতো প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের অপরাপর প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষেত্রে খুবই বিরল। কারণ, চরম উপেক্ষা, দারিদ্র্য আর প্রান্তিকতার শিকার বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকেরা—বঞ্চিত তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা থেকে। বাংলাদেশের সংবিধানে যেকোনো ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সব পর্যায়েই বঞ্চনা আর নেতিবাচক আচরণের শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যানের অভাব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারবার আদমশুমারি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষ কতজন—এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর সরকারের কাছে নেই। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা নিরূপণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। সরকারের অদক্ষতা, মানুষের সচেতনতার অভাবসহ নানা কারণে সর্বশেষ আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধী নাগরিকের সঠিক সংখ্যা গণনা করা যায়নি। উক্ত আদমশুমারি অনুযায়ী, এ ধরনের নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ছয় লাখ ১৩ হাজার ৪৬০ জন, যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। যদিও ১৯৮১ সালে অনুমিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয় না।
আজ ১৫ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ ২০১১ বাংলাদেশে পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আশার কথা হলো, এবারের আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গণনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এবারের উদ্যোগটি অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত। আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১-তে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যা নিরূপণে উদ্যোগ গ্রহণ করায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। এর ফলে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি-সম্পর্কিত গ্রহণযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এখন দরকার গণমানুষের সচেতনতা ও সহযোগিতা। কারণ, সবার পরিবার যে ভাস্করের পরিবারের মতো সচেতন, সাহসী ও প্রত্যয়ী, তা তো নয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, লোকলজ্জা বা জড়তার কারণে অনেক পরিবার তার প্রতিবন্ধী সদস্যকে লুকিয়ে রাখতে চায়। এমন অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের সম্পর্কে তথ্য দিতে সংকোচ বোধ করেন।
প্রিয় পাঠক, আদমশুমারির ১৯ নম্বর প্রশ্নে আছে প্রতিবন্ধিতা-সম্পর্কিত তথ্য। ভাস্কর ভট্টাচার্য নিজের তথ্য দেবেন। আপনিও জড়তা ভেঙে এগিয়ে আসুন, আপনার পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্য সম্পর্কে গণনাকারীকে তথ্য দিন। কারণ, আপনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ করবে। পরিবারের বা প্রতিবেশী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি আপনার দায়িত্ব পালন করুন এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি দায়িত্ব পালনে সহায়তা করুন।

No comments

Powered by Blogger.