বাংলাদেশের সংবিধান-সংস্কার : দুর্লক্ষণ-দুর্ভাবনা by কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ তথা সংবিধান নিয়ে টানাহেঁচড়া বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অত্যন্ত দুঃখজনক অধ্যায়। এসব বিষয়ে আমরা যে চিন্তাভাবনা কিংবা মন স্থির করতে পারিনি, সেটাই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা যত গলাবাজিই করি না কেন! বর্তমানে সার্ধশত জন্মোৎসব পালন করছি আমরা যে
রবীন্দ্রনাথের, তিনি এক অমোঘ রোগ-নির্ণয়ের ভঙ্গিতে একবার বলেছিলেন, 'ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে, ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল, আচারে মুুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল।' রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় এসব প্রবলতা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার বাংলাদেশের মানুষের হাতে। প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের অভিযুক্ত করার সুযোগ এখন আর নেই। কিন্তু এই স্বাধীন সময়কালেও জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা কী করেছি? রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংবিধান নিয়ে কি কম খেলা ছিল আমাদের? সর্বশেষ পরিস্থিতিও কি খুব আশাপ্রদ? রবীন্দ্রনাথ কথিত 'ধর্মভাব'-এর প্রবলতার রোগটি কি নিজের দুরারোগ্যতা নিয়ে বার বারই ফিরে আসছে না? উল্লেখ্য, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে দেওয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের একটি রায় সম্প্রতি বংলাদেশের সংবিধান নিয়ে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা ও তৎপরতার সূচনা করেছে। তবে প্রাথমিকভাবে এ রায়টিও কিন্তু কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগের ফল ছিল না। ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা দাবি করে বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্চেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলমের একটি রিট আবেদন ছিল বাংলাদেশের হাইকোর্টে; ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট সিনেমা হলটির মালিকানা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণাও চারদলীয় জোট সরকারের বৈরী ভূমিকার কারণে দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল; ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর সেই বৈরিতার অবসান হয়। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখাতেই সৃষ্টি হয় বর্তমানের নবতর প্রেক্ষাপট।
এ জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অবশ্যই অনেক সাধুবাদ পাবেন। কিন্তু তার পরও কেন আমরা মসৃণভাবে এগোতে পারছি না? প্রথমে কিছু চিন্তার অস্পষ্টতা দেখা গেল, কিছু মতভেদ_আদালতের রায় কার্যকর করার উপায় নিয়ে। দুটি ধারণা এল : ১. আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ; ২. সংসদীয় আলাপ-আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ। এই দুটি ধারা এখনো পাশাপাশি চলছে। সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অপর পক্ষে, সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে তার সভায় সংবিধান সংস্কারের যাবতীয় ধারণা ও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ কমিটি অনেকটা সংবিধান কমিশনের মতো কাজ করছে, যে রকম কোনো কিছু গঠনের এবং আমাদের সংবিধান পুনরুদ্ধারের দাবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফোরাম এবং ব্যক্তির পক্ষ থেকে উঠেছে।
শুধু সংসদীয় বিশেষ কমিটিকে নয়, সম্প্র্রতি সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তিত ও সরব দেখা গেছে বিশেষ দুই-একটি প্রশ্নে। যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রবীন্দ্রনাথ কথিত সেই 'প্রবল', 'ধর্মভাব'-এর। এককথায়, আমরা যে সংবিধান তথা রাজনীতির ইসলামীকরণ করেছিলাম, তার বাইরে এসে দাঁড়াব কি না, সেটাই কেন্দ্রীয় চিন্তাভাবনা এখনো। জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম', ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতাসহ সংবিধানের একাধিক মূলনীতি। জেনারেল এরশাদের সময় ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘুরেফিরে ধর্ম তথা ইসলামবিষয়ক এই প্রশ্নগুলোতেই সংবিধান-সংস্কারের আলাপ-আলোচনা বেশি নিবদ্ধ থেকেছে, থাকছে। সংসদীয় বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে মাননীয় সংসদ নেত্রীর সঙ্গে মূলত এ ব্যাপারেই পরামর্শসভা হয়েছে। এ সম্পর্কে পরবর্তীকালে যা জানা গেছে, কেউ কেউ আগেই সে রকম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। আমি শেষোক্তদের দলে। বংলাদেশের জনমানস এবং বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে কিছু নগণ্য হতাশা বহু আগেই আমি ব্যক্ত করেছিলাম। সংসদ নেত্রীর পরামর্শ সম্ভবত ছিল 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম', রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের পাশাপাশি রাখার। কিন্তু এগুলো পাশাপাশি কিংবা একসঙ্গে রাখার যৌক্তিক সুযোগ রয়েছে কি না, তা কে ভাববে? সংবিধান কি একটি যোগ অঙ্ক, না যোগফল? এতে কি বিপরীত কিংবা বিসদৃশ কতগুলো নীতি বা অবস্থান ঘোষণা করা যায়? এর ফল ভবিষ্যতে কত মারাত্মক হতে পারে, তা কি এখনই ভাবার নয়? দেখা যাচ্ছে, একেবারে সর্বশেষ এই পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোনো শোরগোল কিংবা আলাপ-আলোচনা নেই। লেখক-বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ_কোনো মহলই ভাবিত নন, সোচ্চারও নন। সে ক্ষেত্রে কি ভাবা যায় আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে?
এবং ঠিক এ কারণেই আমি এককভাবে সংসদ নেত্রী কিংবা তাঁর দলের ওপর কোনো দায় চাপাবো না। রাষ্ট্র কিংবা সমাজ রূপান্তরণের দায়-দায়িত্ব তো কারো বা কোনো দলের একার নয়। এখন একটা দুর্লভ সুযোগ এসেছে আমাদের সংবিধানের অসংগতিগুলো কাটিয়ে ওঠার, রাষ্ট্রকে তার আদর্শিক আদিতে পুনঃস্থাপিত করার। আগ্রহী-দাবিদার ব্যক্তিরা যদি এখন নীরব-নিষ্ক্রিয় থাকেন, তাহলে কী প্রমাণিত হবে? জোর গণদাবির মুখেই তো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সাহসী, ভিন্ন ভাবনা করা সম্ভব। এসব প্রশ্নে আমাদের প্রকৃত, অন্তরতম মনোভাব তাহলে কী? আমরা কেন তাহলে মুসলিম লীগকে, একে, ওকে-তাকে দায়ী করি? আমরা কি প্রায় সবাই তাহলে ঠাট্টার সেই তালগাছ কিংবা সোনার পাথর বাটিটিই চাই? সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষাই কি আমাদের সবার মূল বিবেচনা? সে জন্য যখন যা দরকার, তা-ই করব_রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ধর্ম প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা? রাষ্ট্রধর্ম, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা_এগুলো একসঙ্গে যায় কি না, আমাদের বিশিষ্ট জনমানসে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে তা কি কোনো প্রশ্ন নয়?
বলা হয়, অতি চালাকের গলায় দড়ি। মানুষ যখনই অতিচালাকি করেছে, শুধু নিজের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা, তখন ক্ষতিগ্রস্তরা বেজার হয়েছে, রুখে দিয়েছে। এ নিয়ম সবার বেলায়ই সত্য। মায় উদ্ভিদজগৎ, বিশ্বপ্রকৃতি। মূলত ধর্ম প্রশ্নে এবং সংশ্লিষ্ট বহু বিভক্তি ও বিভেদ কি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে আমাদের অনেক দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনাকে পরিষ্কার কেড়ে নেয়নি? আরো কত মূল্য আমরা দিতে চাই? ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে তা এখন গোটা মানবজাতির পায়ের বেড়িতে পরিণতপ্রায়। বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে নগণ্য কণ্ঠে আর একবার বলছি : সাধু সাবধান! আমাদের অতীত আমাদের বর্তমানকে নির্মাণ করেছে, আর এই বর্তমান নির্মাণ করবে ভবিষ্যৎকে। হ্যাঁ, নিশ্চয় এগুলো আপ্তবাক্য মাত্র!
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার বাংলাদেশের মানুষের হাতে। প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের অভিযুক্ত করার সুযোগ এখন আর নেই। কিন্তু এই স্বাধীন সময়কালেও জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা কী করেছি? রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংবিধান নিয়ে কি কম খেলা ছিল আমাদের? সর্বশেষ পরিস্থিতিও কি খুব আশাপ্রদ? রবীন্দ্রনাথ কথিত 'ধর্মভাব'-এর প্রবলতার রোগটি কি নিজের দুরারোগ্যতা নিয়ে বার বারই ফিরে আসছে না? উল্লেখ্য, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে দেওয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের একটি রায় সম্প্রতি বংলাদেশের সংবিধান নিয়ে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা ও তৎপরতার সূচনা করেছে। তবে প্রাথমিকভাবে এ রায়টিও কিন্তু কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগের ফল ছিল না। ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা দাবি করে বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্চেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলমের একটি রিট আবেদন ছিল বাংলাদেশের হাইকোর্টে; ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট সিনেমা হলটির মালিকানা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণাও চারদলীয় জোট সরকারের বৈরী ভূমিকার কারণে দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল; ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর সেই বৈরিতার অবসান হয়। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখাতেই সৃষ্টি হয় বর্তমানের নবতর প্রেক্ষাপট।
এ জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অবশ্যই অনেক সাধুবাদ পাবেন। কিন্তু তার পরও কেন আমরা মসৃণভাবে এগোতে পারছি না? প্রথমে কিছু চিন্তার অস্পষ্টতা দেখা গেল, কিছু মতভেদ_আদালতের রায় কার্যকর করার উপায় নিয়ে। দুটি ধারণা এল : ১. আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ; ২. সংসদীয় আলাপ-আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ। এই দুটি ধারা এখনো পাশাপাশি চলছে। সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অপর পক্ষে, সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে তার সভায় সংবিধান সংস্কারের যাবতীয় ধারণা ও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ কমিটি অনেকটা সংবিধান কমিশনের মতো কাজ করছে, যে রকম কোনো কিছু গঠনের এবং আমাদের সংবিধান পুনরুদ্ধারের দাবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফোরাম এবং ব্যক্তির পক্ষ থেকে উঠেছে।
শুধু সংসদীয় বিশেষ কমিটিকে নয়, সম্প্র্রতি সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তিত ও সরব দেখা গেছে বিশেষ দুই-একটি প্রশ্নে। যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রবীন্দ্রনাথ কথিত সেই 'প্রবল', 'ধর্মভাব'-এর। এককথায়, আমরা যে সংবিধান তথা রাজনীতির ইসলামীকরণ করেছিলাম, তার বাইরে এসে দাঁড়াব কি না, সেটাই কেন্দ্রীয় চিন্তাভাবনা এখনো। জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম', ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতাসহ সংবিধানের একাধিক মূলনীতি। জেনারেল এরশাদের সময় ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘুরেফিরে ধর্ম তথা ইসলামবিষয়ক এই প্রশ্নগুলোতেই সংবিধান-সংস্কারের আলাপ-আলোচনা বেশি নিবদ্ধ থেকেছে, থাকছে। সংসদীয় বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে মাননীয় সংসদ নেত্রীর সঙ্গে মূলত এ ব্যাপারেই পরামর্শসভা হয়েছে। এ সম্পর্কে পরবর্তীকালে যা জানা গেছে, কেউ কেউ আগেই সে রকম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। আমি শেষোক্তদের দলে। বংলাদেশের জনমানস এবং বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে কিছু নগণ্য হতাশা বহু আগেই আমি ব্যক্ত করেছিলাম। সংসদ নেত্রীর পরামর্শ সম্ভবত ছিল 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম', রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের পাশাপাশি রাখার। কিন্তু এগুলো পাশাপাশি কিংবা একসঙ্গে রাখার যৌক্তিক সুযোগ রয়েছে কি না, তা কে ভাববে? সংবিধান কি একটি যোগ অঙ্ক, না যোগফল? এতে কি বিপরীত কিংবা বিসদৃশ কতগুলো নীতি বা অবস্থান ঘোষণা করা যায়? এর ফল ভবিষ্যতে কত মারাত্মক হতে পারে, তা কি এখনই ভাবার নয়? দেখা যাচ্ছে, একেবারে সর্বশেষ এই পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোনো শোরগোল কিংবা আলাপ-আলোচনা নেই। লেখক-বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ_কোনো মহলই ভাবিত নন, সোচ্চারও নন। সে ক্ষেত্রে কি ভাবা যায় আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে?
এবং ঠিক এ কারণেই আমি এককভাবে সংসদ নেত্রী কিংবা তাঁর দলের ওপর কোনো দায় চাপাবো না। রাষ্ট্র কিংবা সমাজ রূপান্তরণের দায়-দায়িত্ব তো কারো বা কোনো দলের একার নয়। এখন একটা দুর্লভ সুযোগ এসেছে আমাদের সংবিধানের অসংগতিগুলো কাটিয়ে ওঠার, রাষ্ট্রকে তার আদর্শিক আদিতে পুনঃস্থাপিত করার। আগ্রহী-দাবিদার ব্যক্তিরা যদি এখন নীরব-নিষ্ক্রিয় থাকেন, তাহলে কী প্রমাণিত হবে? জোর গণদাবির মুখেই তো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সাহসী, ভিন্ন ভাবনা করা সম্ভব। এসব প্রশ্নে আমাদের প্রকৃত, অন্তরতম মনোভাব তাহলে কী? আমরা কেন তাহলে মুসলিম লীগকে, একে, ওকে-তাকে দায়ী করি? আমরা কি প্রায় সবাই তাহলে ঠাট্টার সেই তালগাছ কিংবা সোনার পাথর বাটিটিই চাই? সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষাই কি আমাদের সবার মূল বিবেচনা? সে জন্য যখন যা দরকার, তা-ই করব_রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ধর্ম প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা? রাষ্ট্রধর্ম, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা_এগুলো একসঙ্গে যায় কি না, আমাদের বিশিষ্ট জনমানসে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে তা কি কোনো প্রশ্ন নয়?
বলা হয়, অতি চালাকের গলায় দড়ি। মানুষ যখনই অতিচালাকি করেছে, শুধু নিজের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা, তখন ক্ষতিগ্রস্তরা বেজার হয়েছে, রুখে দিয়েছে। এ নিয়ম সবার বেলায়ই সত্য। মায় উদ্ভিদজগৎ, বিশ্বপ্রকৃতি। মূলত ধর্ম প্রশ্নে এবং সংশ্লিষ্ট বহু বিভক্তি ও বিভেদ কি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে আমাদের অনেক দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনাকে পরিষ্কার কেড়ে নেয়নি? আরো কত মূল্য আমরা দিতে চাই? ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে তা এখন গোটা মানবজাতির পায়ের বেড়িতে পরিণতপ্রায়। বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে নগণ্য কণ্ঠে আর একবার বলছি : সাধু সাবধান! আমাদের অতীত আমাদের বর্তমানকে নির্মাণ করেছে, আর এই বর্তমান নির্মাণ করবে ভবিষ্যৎকে। হ্যাঁ, নিশ্চয় এগুলো আপ্তবাক্য মাত্র!
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments