কালের পুরাণ-সংসদে ‘টাল’, ‘পাগল’ ও ‘চৌকিদার’ by সোহরাব হাসান

‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ বিরোধী দলও সংসদে গিয়ে প্রমাণ করেছে, এত দিন তাদের সংসদে গরহাজির থাকা ঠিক হয়নি। তার পরও বিরোধী দলের সংসদে যোগদানকে আমরা স্বাগত জানাই। সরকারি দল কথা বলতে দেয় না, অসহযোগিতা করে—এসব ঠুনকো অভিযোগে তারা তাদের দাবি ছাড়বে কেন? সংসদে সরকারি


দলেরও যেমন অধিকার আছে, তেমনি আছে বিরোধী দলেরও। ১০ মাস পর হলেও বিরোধী দল সংসদে যোগ দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি নিশ্চয়ই আনন্দের সংবাদ। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা সাত মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয়, বিরোধী দল চাইলে সংসদে গিয়ে কথা বলতেও পারে।
চলতি অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে বিরোধী দলকে পেয়ে সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে ফ্রুটো জুসের মতো এটি বেশি প্রাণবন্ত; যা দেখে আবারও শঙ্কা জাগে, কোনো অজুহাতে আবার তারা স্থায়ী বর্জনের পথ বেছে নেবে কি না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দুরারোগ্য ব্যাধি হলো, সরকারি দল সবকিছু দখলে নিতে চায় আর বিরোধী দল সবকিছুতে বর্জনের রাস্তা মাপে। মনে মনে ভাবে, এই পাঁচ বছর কিছু না পেলেও দুঃখ নেই। আগামী পাঁচ বছর সুদাসলে উশুল করে নেওয়া যাবে। এক পক্ষের সর্বময় আগ্রাসী এবং অপর পক্ষের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে বাংলাদেশের কপালে অনেক দুঃখ আছে।
সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি যে আশা জাগিয়েছিল, তা ধপ করে নিভে যেতেও সময় লাগেনি। বিরোধী দলের বিজ্ঞ সাংসদেরা এত দিন বলে আসছিলেন, তাঁরা জনগণের সমস্যা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যে বিপন্ন হতে চলেছে, সেসব নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে চান; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। কিন্তু গত দুই কর্মদিবসে সে রকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনার চেয়ে দুই দলের সাংসদেরা ‘টাল’, ‘পাগল’, ‘চৌকিদার’ ‘সন্ত্রাসী’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বেশি কথা বলেছেন কারও শাড়ির রং, কিংবা চুলের বিন্যাস নিয়ে। বলা যায়, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াই এই বিতর্কের সূচনা করেছেন। তিনি সুকঠিন ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেছেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কথা জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন (তথ্য-উপাত্তসহ হলে আরও ভালো হতো)। এতে দোষের কিছু নেই। আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর বক্তব্যের জুতসই জবাব দিতে না পেরে যখন বলেন, খালেদা জিয়ার মুখে এ ধরনের সমালোচনা শোভা পায় না, তখন মনে হয় তাঁর অভিযোগের অর্ধেক বিনা বাক্যে তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিরোধী দলের নেত্রী কেন সরকারের সমালোচনা করতে পারবেন না? তাঁদের আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস হয়েছে বলে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোথাও লেখা নেই যে দেশ শাসনে ব্যর্থ ব্যক্তি অন্যের ব্যর্থতার কথা বলতে পারবেন না। বিএনপি ব্যর্থ হয়েছিল বলেই জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা চান, তাঁদের ব্যর্থতার কথা কেউ না বলুক। মুখ বন্ধ করার সংস্কৃতি কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। না দেশের, না গণতন্ত্রের।
এমনকি খালেদা জিয়া যখন সরকারের বিরুদ্ধে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্মান করার অভিযোগ আনেন, তা-ও বাঁকা চোখে দেখার উপায় নেই। শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরের মানুষও ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পত্রপাঠ বিদায় দেওয়ার প্রতিবাদ করেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী দেশের একজন কীর্তিমান ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই ভাষণে যখন তিনি বলেন, ‘সন্তু লারমা একজন সন্ত্রাসী। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ও নিরীহ ব্যক্তিদের হত্যা করেছেন। সন্ত্রাসী সন্তু লারমা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অসম চুক্তি, শান্তির চুক্তি নয়। শান্তি পুরস্কার দিলে দেশে শান্তি থাকবে না’, তখনই খটকা লাগে।
একজন রাজনৈতিক নেত্রী, যিনি তিন-তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি আরেকজন রাজনীতিক এবং একটি জনগোষ্ঠীর নেতা সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে পারেন না। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে খালেদা জিয়ার আপত্তিকে আমরা তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর নেতা, যিনি তাঁর সশস্ত্র লড়াই থেকে পাহাড়িদের শান্তির পথে নিয়ে এসেছেন, তাঁকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করলে সেই জনগোষ্ঠীর প্রতি বিএনপি নেত্রীর অন্ধ আক্রোশ ও জিঘাংসাই প্রকাশ পায়। একজনকে সম্মানিত করার নামে আরেকজনকে অসম্মানিত করার অধিকার কি তাঁর আছে? ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সইয়ের পর খালেদা জিয়া পাঁচ বছর (২০০১-০৬) ক্ষমতায় ছিলেন, সন্তু লারমা সন্ত্রাসী হলে তখন তাঁর বিচার করলেন না কেন? কেন পার্বত্য চুক্তিই বা বাতিল করলেন না? ক্ষমতায় থাকলে তো বটেই, বিরোধী দলে গেলেও হিসাব করে কথা বলতে হয়, তা আমাদের নেতা-নেত্রীরা অনেক সময়ই ভুলে যান। ক্ষমতায় আসার প্রথম মেয়াদে যে তিনি আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘তারা ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজান হবে না, উলুধ্বনি শোনা যাবে।’ তাঁর সেই উক্তি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তা আজও শুকায়নি। এবার তিনি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করলেন। এসব কিসের আলামত? খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের পর যদি পাহাড়িরা ফের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তার দায়দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।
কথায় আছে, ‘রাজা (রানি নয় কেন?) যত বলে, পারিষদগণ বলে তার শত গুণ।’ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া যে পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন, সেই পথেই হাঁটছেন দুই দলের প্রবীণ ও নবীন নেতারা।
সংসদে বুধবার খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্যের পরদিন বিএনপির নারী সাংসদ রেহানা আক্তার যবলেন, ‘বিদেশ থেকে সাদা চামড়ার একজন গবেষক ভাড়া করে এনে আষাঢ়ে গল্পের চেষ্টা করছে সরকার।... স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া ও নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে তার জিহ্বা কেটে টুকরো টুকরো করা হবে।... একজনের বুকে অনেক ব্যথা। তাঁকে বলা হয়েছিল জোটে থাকলে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। রাষ্ট্রপতি তো দূরের কথা, চৌকিদারও বানানো হয়নি।’ সরকারের ডিজিটাল কর্মসূচির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী টাল, বাণিজ্যমন্ত্রী টাল, আইন প্রতিমন্ত্রীও টাল আর সরকার বেসামাল।’ (ইত্তেফাক, ১৭ এপ্রিল, ২০১১)।
এর জবাবে সরকারি দলের সাংসদ অপু উকিল বলেছেন, ‘খাই খাই খালেদা জিয়ার বেড়ে যাওয়া দুর্নীতির ক্যানসার-আক্রান্ত ও সর্বস্বান্ত দেশকে জাগিয়ে তুলেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।’ (ইত্তেফাক, ঐ)। তিনি আরও বলেছেন ‘ওয়ান-ইলেভেন খালেদা জিয়ার পাপের ফসল। আপনি বিধবা হয়ে লাল-গোলাপি শাড়ি পরে মিথ্যাচার করেন। আপনি নারী জাতির কলঙ্ক। আপনি বিধবার বেশে জাতির কাছে ক্ষমা চান। (প্রথম আলো, ঐ)। তিনি খালেদা জিয়াকে ‘পাগল’ বলেও অভিহিত করেছেন।
বিএনপির সাংসদ সুজাত আলী শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বলেছেন, ‘আমাদের নেত্রীর শাড়ির রং নিয়ে কথা উঠেছে। আমাদের নেত্রীকে আল্লাহ নিজ হাতে বানিয়ে পাঠিয়েছেন।’ (প্রথম আলো, ঐ)।
সংসদে দুই দলের নারী সাংসদেরা যেসব অশালীন উক্তি করেছেন, পুরুষ সাংসদেরা করলে নির্ঘাত তা ইভ টিজিংয়ের পর্যায়ে চলে যেত। নারী সাংসদেরা যখন নারীনেত্রী বা সাংসদকে অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন, তখন তাকে কী বলা যায়? আমাদের সমাজে এখনো মানুষ নারীদের সমীহ-সম্মান করে কথা বলে। কিন্তু সংসদের নারী সাংসদেরা সেই সম্মান নিজেরাই ক্ষুণ্ন করছেন। অন্য দলের পুরুষ সাংসদের মনের ব্যথাই বা নারী সাংসদ জানলেন কী করে? জিব কাটার বিষয়টি এত দিন পুরুষের একক এখতিয়ার বলে জানতাম। এখন দেখছি নারীরাও কম যান না। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত যুদ্ধ-সংঘাত হয়েছে, তার জন্য পুরুষই বেশি দায়ী। কিন্তু বাংলাদেশে গত দুই যুগের সংঘাত-সংঘর্ষের দায় নারী নেতৃত্বকেই নিতে হবে। কেননা, তাঁরা দেশ চালিয়েছেন, চালাচ্ছেন।
দলীয় নেত্রীদের খুশি করার কি আর কোনো ভাষা জানা নেই এই সাংসদদের? কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
যাদের হূদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই—
করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
একসময় জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের আলোচনা থেকে অনেক কিছু শেখা যেত, জানা যেত। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁরা আদর্শনীয় ছিলেন। তাঁদের যুক্তিতর্ক, তথ্য এবং চৌকস ভাষা ও বাকপ্রতিমায় মুগ্ধ হতো সবাই। তাঁরা একে অপরের সমালোচনা করলেও ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেন না। কিন্তু এখনকার সাংসদদের কারও আলোচনায় জ্ঞানের আলো নেই, দেশ নেই, মানুষ নেই। আছে কেবল গালাগালি। দেশবাসী তাঁদের কাছ থেকে কী শিখবে?
মাননীয় স্পিকার সাংসদদের অশালীন উক্তি ও বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করেছেন। কিন্তু সাংসদদের বক্তব্য তো সরাসরি বেতার ও টিভিতে প্রচার করা হয়েছে। সাংসদদের বক্তব্য প্রচারের জন্য সংসদ টেলিভিশন নামে একটি নতুন চ্যানেল করা হয়েছে। দোহাই আপনাদের, সাংসদদের বক্তব্য সরাসরি প্রচারের আগে তাঁদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন। তাঁদের নীতি-নৈতিকতা ও শালীনতার পাঠ নিতে বলুন।
স্পিকার আবদুল হামিদ শুরু থেকে সাংসদদের প্রতি আবেদন রেখেছিলেন, তাঁরা যেন ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেন। কিন্তু সংসদে কারও কারও বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে মনে হয়, তাঁরা কথার পিঠে কথা বলতে আগ্রহী নন। ইট খেয়ে পাটকেল মারতে উদ্যত। পৃথিবীর বহু পার্লামেন্টে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে, কিন্তু এ রকম অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহূত হয়েছে বলে জানা নেই। আর এসব ভাষা যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের বিদ্যার দৌড় কত দূর, তা-ও আমরা জানি। কথায় বলে, শূন্য কলস বাজে বেশি।
আমাদের সাংসদেরা বুদ্ধির ঘাটতি পূরণ করেন চাপার জোর দিয়ে।
আগের দিন বিএনপির জ্যেষ্ঠ সাংসদ মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, সরকারি দল যতবার তাঁদের নেতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করবেন, ততবার তাঁরা ওয়াকআউট করবেন। জনাব, তার আগে আপনার নিজের দলের নারী সাংসদদের মুখ ও হাত সংযত করুন। যাঁরা অপরের জিহ্বা কেটে টুকরো টুকরো করতে চান, দয়া করে তাঁদের জিহ্বার লাগাম টেনে ধরুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.