ইউরোপের চিঠি-জাপানের বিপর্যয় ও পরমাণু-বিতর্ক by পিটার কাস্টার্স

জাপানের চলমান পারমাণবিক বিপর্যয় ইউরোপে পারমাণবিক জ্বালানির ঝুঁকি নিয়ে পুরোনো বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে। জাপানের পূর্ব উপকূলীয় ফুকুশিয়া-দাইচি পারমাণবিক কমপ্লেক্সে বিপর্যয়ের পরপরই পশ্চিমা পরমাণু বিশেষজ্ঞরা জনগণের আতঙ্ক দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন।


এমন যুক্তিও দেওয়া হয়েছে, ফুকুশিমার কয়েকটি পারমাণবিক চুল্লির শীতলীকরণব্যবস্থার স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে কোনোমতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল দুর্ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের একটি পারমাণবিক চুল্লিতে বিস্ফোরণ ও প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ার ফলে দুনিয়াব্যাপী বেসামরিক পারমাণবিক উৎপাদনের বিরোধিতা তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিচ্ছেন, ফুকুশিমা-দাইচি দুর্ঘটনা তুলনীয় হতে পারে সর্বোচ্চ ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইলস দ্বীপের দুর্ঘটনার সঙ্গে। থ্রি মাইলসের দুর্ঘটনায় চুল্লি আংশিক উত্তপ্ত হয়েছিল, আর এর প্রভাব পড়েছিল মূলত স্থানীয় পরিবেশের ওপর। তথাপি জাপানের পরিস্থিতি যতই খোলাসা হতে শুরু করে, ততই (পশ্চিম) ইউরোপজুড়ে তীব্রতর হচ্ছে পারমাণবিক খাতের ওপর নির্ভরতা বুদ্ধিমানের কাজ কি না, সেই বিতর্ক।
পুরোদস্তুর নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে জার্মানি। ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই রাষ্ট্রটির প্রায় ২৮ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে পারমাণবিক জ্বালানি থেকে। এ দেশে অনেক দিন ধরেই পারমাণবিক উৎপাদনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য অংশে নব্বইয়ের দশকে জনতার প্রতিবাদ প্রায় থেমে গেলেও জার্মান প্রতিবাদীকর্মীরা অবরোধ ও নানা ধরনের নাগরিক অবাধ্যতা জারি রাখেন। কিছুদিন পরই তাঁরা নানা কর্মসূচি পালন করেন। যেমন: পারমাণবিক বর্জ্য পরিবহনে বাধা দিতে তাঁরা রেলপথে নিজেদের শেকল দিয়ে আটকে রাখেন। এই ঘটনা ঘটেছে যখন ক্ষমতাধর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) সরকারে জার্মান গ্রিন পার্টিও শরিক ছিল। আরও লক্ষণীয় যে জার্মানির ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একাংশ অত্যন্ত অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছিল যে উচ্চপর্যায়ের ও অন্যান্য বিপজ্জনক পারমাণবিক বর্জ্যের চূড়ান্ত অপসারণের প্রশ্নটি আসলে সমাধান হওয়ার নয়। তাঁরা এটাও স্বীকার করছিলেন, কোনো পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো তাই দায়িত্বজ্ঞানহীন। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডারের শাসনকালে সে দেশের রাজনীতিকদের আলোচনায় ক্রমবর্ধমান হারে জায়গা করে নিচ্ছিল বিদ্যমান পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর ব্যয় কে বহন করবে, সে প্রশ্নটি। রাজনীতিকদের বড় এক অংশ বলছিল, পারমাণবিক কেন্দ্রের মালিকেরই উচিত সেই খরচ বহন করা।
জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী) গত বছর পারমাণবিক লবির বিপুল চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন। কিন্তু জাপানে বিপর্যয় শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে পুরোপুরি পথ বদলাতে হয়েছে! প্রথমবার ১৩ মার্চ, হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জার্মানির সবচেয়ে পুরোনো পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর অন্যতম নেকারওয়েস্থেইম ওয়ান বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানায়। এ বিক্ষোভ ছিল পূর্বপরিকল্পিত, কিন্তু জাপান বিপর্যয়ের ফলে প্রত্যাশিত ৬০ হাজার বিক্ষোভকারীর জায়গায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। আর এটা দ্রুতই মেরকেলের নজর কেড়েছে। গত সেপ্টেম্বরে তিনি বিদ্যমান সব পারমাণবিক কেন্দ্রের ‘জীবন’কাল বাড়ানো উচিত বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এবার তিনি তা পুনর্বিবেচনা করেন। তিনি সেসব কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ করলেন এবং পারমাণবিক জ্বালানির ওপর জার্মানির নির্ভরতা দীর্ঘায়িত করার ব্যাপারে নিজের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। পরে যেদিন খবর এল জাপানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে, সেদিনই জার্মান সরকার আরেকটি পদক্ষেপ নিল। ১৯৮০ সালের আগে নির্মিত পুরোনো পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো সব তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে পারমাণবিক জ্বালানির বিরোধীরা জার্মানির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছেন। যে দ্রুতগতিতে মেরকেল তাঁর অবস্থান পাল্টালেন, তাতে বলা যায়, জাপানের বিপর্যয় জার্মানিতে পারমাণবিক পুনর্জাগরণের সব সম্ভাবনা অকালে শেষ করে দিয়েছে।
জার্মানি ছাড়াও ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশে পারমাণবিক উৎপাদন নিয়ে বিতর্ক পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বিদ্যুতের জোগানের জন্য সুইজারল্যান্ড ৩৯ শতাংশ নির্ভর করে পারমাণবিক জ্বালানির ওপর। ১৪ মার্চ সুইস পরিবেশমন্ত্রী নতুন তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্র অনুমোদনের সব প্রক্রিয়া স্থগিত করলেন। এর ফলে সম্ভাবনা দেখা দিল, বিদ্যমান পারমাণবিক উৎপাদন কেন্দ্রগুলো নবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে হয়তো সুইজারল্যান্ড আর এগোবে না। ফ্রান্সেও তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ফ্রান্সে সর্বাধিক। ফ্রান্সের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৭৯ শতাংশ আসে পারমাণবিক জ্বালানি থেকে। কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ক্ষমতায় আসার পর সরকার দেশের শীর্ষ পরিবেশবাদীদের সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এটির মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে কীভাবে ভূমিকা রাখা যায়। নতুন আইনি পদক্ষেপের খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রাখে এই আলোচনা। কার্বন কর আরোপের বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু এতে পারমাণবিক বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে যায়। ফ্রান্সের শীর্ষ দৈনিক লঁ মঁদ অনুযায়ী, এখন রাজনীতিকেরা দেশটির এত বিপুল পারমাণবিক নির্ভরতা নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছেন। প্রখ্যাত ইউরোপীয় পরিবেশবাদী রাজনীতিক ডেনিয়েল কান-বেনডিট অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, চেরনোবিল বিপর্যয় ও ফলাফলের মাত্রা কম করে দেখানোর জন্য একই ধরনের চেষ্টা হয়েছিল। পারমাণবিক পথ ছেড়ে আসার ব্যাপারে ফ্রান্সে গণভোট করার দাবি তুলেছেন তিনি।
দুনিয়াব্যাপী পারমাণবিক উৎপাদনের ভাগ্যনির্ধারণী সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে জাপানি পারমাণবিক বিপর্যয় ও ফলাফলের হিসাব-নিকাশের সময় হয়নি। তবু এখনই দৃঢ়ভাবে বলে দেওয়া যায়, পারমাণবিক পুনর্জাগরণ ঘটানোর প্রচেষ্টা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে পারমাণবিক জ্বালানি বিতর্ক অচলাবস্থায় পড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির চাপ বাড়ছিল। অতীতের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, পারমাণবিক জ্বালানির প্রবক্তারা মূলত নিজেদের লাভালাভের হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত ছিলেন। সম্ভাব্য জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকি পাশে সরিয়ে রেখে তাঁরা ইউরোপীয় সরকারগুলোকে পরামর্শ দিল, পারমাণবিক জ্বালানি প্রজন্মের বিস্তারে সম্মত না হয়ে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। মনে হয় যেন পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়টি মীমাংসিত আর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমার থেকে পারমাণবিক বর্জ্য যেন কম খারাপ। কিন্তু এই মুহূর্তে জাপান যখন তাদের ইতিহাসের ভয়াবহতম পারমাণবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন তো বিতর্কের পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। যে সমালোচকেরা বড় ধরনের পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর দিতেন, তাঁরা ঠিক ছিলেন না—এ কথা এখন আর বলা যাবে না। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের জার্মান সরকার অন্তত তাদের মনস্থির করতে পেরেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.