মিডিয়া ভাবনা-মিডিয়ায় ভুল তথ্যের প্রচার থামাতে হবে by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

মহাস্থানগড় সম্পর্কে হাইকোর্ট বেঞ্চের একটি আদেশকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালতে যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন, তার জন্য এক বিবৃতিতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে স্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে, মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ না দেখে আমার মন্তব্য করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’


সৈয়দ আবুল মকসুদের এই বিবৃতি ও আদালতে দেওয়া বক্তব্যের জন্য আমি জনাব মকসুদের প্রশংসা ও সমালোচনা করতে চাই। প্রথমে প্রশংসা। সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালত বা বিচারকদের একটি রায় সম্পর্কে ঠিকভাবে না জেনে মন্তব্য করার জন্য নিজের ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মানুষ ফেরেশতা নয়। যাঁরা বহু রকম কাজ করেন, বহু বিষয়ে লেখালেখি করেন বা কথা বলেন, তাঁদের দু-চারটা ভুল হতেই পারে। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার পর সেই ভুল স্বীকার করা ও প্রয়োজনে দুঃখ প্রকাশ করা বা বাধ্য হলে ক্ষমা চাওয়া অন্যায় কিছু নয়। দুঃখ প্রকাশ করার পর বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যাওয়া উচিত। ‘দুঃখ প্রকাশকে’ যদি অন্যপক্ষ যথেষ্ট মনে না করে, তা হলে বড়জোর তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলা যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। ক্ষমাপ্রার্থনার পর বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলা একেবারেই উচিত নয়। সবার মনে রাখা দরকার, অনেক মানুষ খুব আবেগপ্রবণ হয়। মানুষের ভুল হতেই পারে। সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ক্ষেত্রে বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে একটা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। আমাদের সমাজে অনেকেই ভুল স্বীকার করতে চান না।
এবার সমালোচনার দিকটি আলোচনা করা যাক। বিবৃতিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ না দেখে আমার মন্তব্য করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন প্রবীণ, মেধাবী ও প্রাজ্ঞ কলামিস্ট। তিনি কোনো ‘অবসরপ্রাপ্ত’ কলামিস্ট নন। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে তিনি বহু বছর ধরে যুক্ত। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতা সম্পর্কে তিনি জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। শুধু সাংবাদিক হিসেবে নন, প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। মওলানা ভাসানী ও সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ বহুকাল এ দেশে পঠিত হবে। এ রকম একজন অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ কলামিস্ট যদি কোনো বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার না জেনে কেবল পত্রিকার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য করেন, তা সংগত নয়। যেকোনো বিষয় সম্পর্কে না জেনে বা খণ্ডিত জেনে প্রশংসা করলে তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু নিন্দা ও সমালোচনা করা একেবারেই উচিত নয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম ও প্রজ্ঞার প্রতি সুবিচার করেননি। এ ঘটনা শুধু তাঁকে নয়, সংবাদপত্রের সব কলামিস্ট ও টিভি অনুষ্ঠানের আলোচকদের সতর্ক ও সচেতন হতে সহায়ক হবে।
কয়েক দিন আগের ঘটনা। সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ব্যাপারে আদালতে গিয়েছিলেন। বিচারপতি মহাস্থানগড় প্রসঙ্গে আদালতের মন্তব্য সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁকে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়নি। এজলাসে তিনি দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, গান্ধীর ভেকধারী, ভণ্ড বুদ্ধিজীবী, মূর্খ—এ রকম আপত্তিকর ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে। পুলিশ বিভাগের উদ্দেশে এমনও বলা হয়েছে, সৈয়দ মকসুদের বক্তব্য খুঁটিয়ে দেখে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন কি না, তদন্তসাপেক্ষে তার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের অনুরোধে আদালত তাঁর আগের আদেশ সংশোধন ও পরে তা প্রত্যাহার করেন বলে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একটা ভুল করেছেন, এ কথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। কিন্তু তাই বলে সম্মানিত আদালত যে ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করেছেন, তা কি ঠিক কাজ হয়েছে? সৈয়দ আবুল মকসুদ রাস্তার লোক নন। তিনি এ দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক। তাঁর মতো লোকের সঙ্গে আদালতের এ রকম ব্যবহার করা ঠিক কাজ হয়েছে কি না, তা পাঠকদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। যাঁরা আইন-আদালত নিয়ে লেখালেখি করেন, তাঁদের বিষয়টা পর্যালোচনা করার জন্য আমি অনুরোধ জানাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদের এ ঘটনার সূত্রে সার্বিকভাবে মিডিয়ায় ভুল তথ্যের প্রচার নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। সংবাদপত্রের কলাম, রিপোর্ট ও টিভির টক শোতে প্রায়ই নানা বিষয়ে লেখক ও আলোচকদের ভুল তথ্য দিতে দেখা যায়। কোনো বিষয়ে না জেনে, কম জেনে, ভুল জেনে অনেক কলামিস্ট বা আলোচক খুব ‘আত্মবিশ্বাসের’ সঙ্গে লিখে যান বা বলে যান। অনেক সময় রাজনৈতিক বা দলীয় কারণে অনেকে নানা বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে লিখে থাকেন বা টিভিতে আলোচনা করে থাকেন। রাজনৈতিক গ্রুপের লেখক বা আলোচকদের ক্ষেত্রে এমনটি বেশি দেখা যায়। কারণ, কোনো ইস্যু সমর্থন করা বা বিরোধিতা করাটাই তাঁদের মূল এজেন্ডা। তথ্য ভুল হোক কি ঠিক হোক, তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা থাকে না। বরং জেনেশুনেই তাঁরা ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদপত্রে লেখেন বা টিভিতে আলোচনা করেন। যাতে তাঁর সমর্থন বা বিরোধিতাটা জোরদার করা যায়। সংবাদপত্রে ও টিভির টক শোতে এ রকম ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। হয়তো প্রতিদিন এমনটি হয় না। কিন্তু প্রায়ই হয়। সবাই ভুল তথ্য দেন না, কিন্তু অনেকেই দেন।
পাঠক বলতে পারেন, আমি (লেখক) কী করে বুঝতে পারলাম ভুল তথ্য। খুব সংগত প্রশ্ন। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা বা লেখালেখির সুবাদে বাংলাদেশের যে কয়েকটি ইস্যু বা সেক্টর সম্পর্কে আমি মোটামুটি তথ্য জানি, তার ভিত্তিতেই আমি দেখেছি, অন্তত এসব সেক্টর সম্পর্কেও ভুল তথ্য অহরহ প্রচারিত হয়। আমি মাত্র কয়েকটি সেক্টর সম্পর্কে জানি। দেশে নানা সেক্টর সম্পর্কে ভালো ধারণা, এমনকি বিশেষজ্ঞ ধারণা রয়েছে, এমন পাঠক ও দর্শকের কাছেও আমি ব্যক্তিগতভাবে শুনেছি এই ভুল তথ্যের অভিযোগ।
পাঠক আবার প্রশ্ন করতে পারেন, ‘তা হলে তাঁরা প্রতিবাদ করেন না কেন?’ খুব সংগত প্রশ্ন। আমার উত্তর হলো, কত প্রতিবাদ করবে? প্রতিদিন প্রতিবাদ করবে? প্রতিবাদ করলেই কি সংবাদপত্রে ছাপা হয়? ঢাকায় এমন একাধিক সংবাদপত্র রয়েছে, যারা তাদের ভুল তথ্য-কণ্টকিত প্রতিবেদনের কোনো প্রতিবাদ প্রকাশ করে না। করলেও ৩০ লাইনের প্রতিবাদ থেকে তিন লাইন প্রতিবাদ ছাপায়। তাদের আপনি কী করবেন? কিছু সংবাদপত্র যা খুশি তা-ই করতে পারে। শুধু পারে না, প্রতিদিন করছেও।
সংবাদপত্রে তবু আপনি ভুল তথ্যের প্রতিবাদ পাঠাতে পারেন। কিন্তু টিভিতে? প্রতিদিন রাতে ১১টি টিভি চ্যানেলে ১১টি ‘টক শো’, ১১টি ‘সংবাদপত্র পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে আলোচকদের কেউ কেউ দিব্যি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সরকার, বিরোধী দল, মন্ত্রী, এমপি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা, কুৎসা, বিষোদ্গার করেই যাচ্ছেন। কারণ, এটা হয়তো তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডা। এই বিষোদ্গার তাঁকে করতেই হবে। এতে তিনি বা ওই টিভি চ্যানেল হয়তো লাভবান হচ্ছে। কাজেই সঠিক তথ্য সম্পর্কে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তা ছাড়া আলোচক ভুল তথ্য দিয়ে আলোচনা করলেও তাঁকে থামাবে কে? উপস্থাপক? অনেক সময় সঠিক তথ্য তো তিনিও জানেন না। অনেক অদক্ষ সাংবাদিক এখন টক শো ও সংবাদপত্র পর্যালোচনা অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজেই দুই পক্ষের কেউই সঠিক তথ্য জানেন না বা জানার চেষ্টা করেন না। এভাবে টক শোর মাধ্যমে তাঁরা পুরো দেশের (বিদেশেরও) টিভি দর্শকদের বিভ্রান্ত করে যাচ্ছেন আর তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করছেন। বলা বাহুল্য, সব টক শোর উপস্থাপক এ রকম নন। অনেকে তথ্যের ব্যাপারে খুব সচেতন ও সতর্ক।
টিভি মিডিয়ায় এসব ভুল সংশোধনের উপায় কী? আমি লাগসই কোনো উপায় দেখি না। শুধু দক্ষ, শিক্ষিত ও তথ্য জানা পেশাদার উপস্থাপকই ভুল তথ্য কিছুটা ঠেকাতে পারেন বলে মনে হয়। কোনো মতলববাজ আলোচক একটা মনগড়া তথ্য বললে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাঁর এই তথ্যের উৎস কী? তা হলে তিনি একটু থামতে পারেন। মতামতের জন্য কোনো উৎস প্রয়োজন হয় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের একটা উৎস থাকতেই হবে। নইলে বলতে হবে সেই তথ্য মনগড়া।
অনেক আলোচক তথ্য প্রসঙ্গে হয়তো বলবেন, ‘এ রকম আমি শুনেছি’, ‘সবাই এ রকম বলে’, ‘পত্রিকায় পড়েছি’—এটা কোনো সঠিক তথ্যের উৎস হতে পারে না। পত্রিকায় কে লিখেছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকায় কি তথ্যের উৎস উল্লেখ করা হয়েছিল?
আমি মনে করি, এটা সংবাদপত্রের জন্য সম্পাদক (বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ) ও টিভি অনুষ্ঠানের জন্য উপস্থাপকের দক্ষতার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে টিভি প্রযোজক ও উপস্থাপকদের আরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশে (এমনকি বিদেশেও) কোনো ইস্যু বা ব্যক্তি সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার হওয়া বাঞ্ছিত নয়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.