ফিলিস্তিন-ভেঙে ফেলো দখলদারির দেয়াল by রজার ওয়াটার্স

১৯৮০ সালে আমি একটি গান লিখি, ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল পার্ট-২’। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এটি নিষিদ্ধ করে। সে দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা সম-অধিকারের কথা তুলতে এ গানটি ব্যবহার করত বলে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।


তখনকার বর্ণবাদী সরকার আমার গানসহ বেশ কিছু গানের ওপর একধরনের সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করেছিল।
২৫ বছর পর ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে এক উৎসবে যোগ দেওয়া ফিলিস্তিনি শিশুরা পশ্চিম তীরকে ঘিরে ইসরায়েলের দেয়াল তোলার প্রতিবাদ জানাতে সেই গানটি ব্যবহার করে। তারা গায়: ‘ইউ ডোন্ট নিড নো অকুপেশন! উই ডোন্ট নিড নো রেসিস্ট ওয়াল!’ (আমাদের কোনো দখলদারির দরকার নেই! দরকার নেই কোনো বর্ণবাদী দেয়াল!) আমি তখনো স্বচক্ষে দেখিনি গানে তারা কিসের কথা বলতে চাইছে।
পরের বছর তেল আবিবে গান পরিবেশন করার ব্যাপারে আমার সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান কিছু ফিলিস্তিনি। তাঁরা ইসরায়েলকে শিক্ষায়তনিক ও সাংস্কৃতিক বয়কটের আন্দোলনে সক্রিয়। দেয়ালের বিরুদ্ধে আমি আগেই জোরালো অবস্থান নিয়েছিলাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক বয়কটের পথ ঠিক কি না, তা নিয়ে তখনো আমি দ্বিধাগ্রস্ত।
বয়কটের পক্ষের ফিলিস্তিনিরা আমার কাছে আহ্বান জানালেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্বচক্ষে দেয়াল দেখতে আমি যেন পশ্চিম তীরে যাই। আমি রাজি হলাম।
জাতিসংঘের নিরাপত্তাধীনে জেরুজালেম ও বেথলেহেম সফর করলাম। সেদিন যা দেখলাম, তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। দেয়ালটি দেখতে মর্মান্তিক। ইসরায়েলি তরুণ সেনারা দেয়ালের পাহারায়। তারা আমাকে বাইরে থেকে আসা নৈমিত্তিক কোনো দর্শক ভেবেছে। আমার প্রতি তাদের আচরণ ছিল ঘৃণাপূর্ণ আগ্রাসী।
আমি বিদেশি, একজন দর্শক। আমার প্রতিই যদি এমন আচরণ করা হয়, তাহলে একবার ভাবুন তো কেমন আচরণ করা হয় ফিলিস্তিনিদের প্রতি, নিম্নশ্রেণীর মানুষের প্রতি কিংবা পাসবুক বহনকারীদের প্রতি। তখন বুঝলাম, সেই দেয়ালের থেকে, আমার দেখা সেই ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের থেকে আমাকে পালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে দেবে না আমার বিবেক। আমার দেখা সেই ফিলিস্তিনিদের জীবন নিত্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদারিতে। তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে (আর কিছুটা অক্ষমতা থেকেও) সেদিন আমি দেয়ালে লিখলাম, ‘উই ডোন্ট নিড নো থট কন্ট্রোল’ (আমাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণের কোনো দরকার নেই)।
সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম, তেল আবিবের মঞ্চে আমার উপস্থিতি ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে আমার দেখা নিপীড়নকেই বৈধতা দেবে। সেই অনুভব থেকে তেল আবিব স্টেডিয়ামে গান পরিবেশনের চুক্তি বাতিল করে সরিয়ে নিলাম ‘নেবে শালমে’। (নেবে শালমের অর্থ শান্তির মরুদ্যান। ইসরায়েলি আরব আর ইসরায়েলি ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টায় গড়ে তোলা সম্প্রীতির গ্রাম)। এখানকার বাসিন্দারা কৃষিজীবী—মটরদানার চাষ আর বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিবেদিত। এখানে মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা পাশাপাশি সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে।
সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে সংগীত আসরটি হয়ে উঠল ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আয়োজন। যানজটের সঙ্গে লড়ে শেষ অবধি ৬০ হাজার ভক্ত জমায়েত হলো। আমাদের দারুণ নাড়া দিয়ে গেল। আসর শেষে সমবেত তরুণদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করলাম, তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের নাগরিক অধিকারকে শ্রদ্ধা করতে সরকারের প্রতি যেন দাবি জানায়।
ইসরায়েলি আরব ও ইসরায়েলি ইহুদিদের সমান অধিকার দিয়ে প্রণীত আইন বাস্তবায়নে ইসরায়েল সরকার এই কয়েক বছরে দুঃখজনকভাবে কোনো চেষ্টাই করেনি। আর দেয়াল শুধুই বেড়েছে নিরন্তর—অবৈধভাবে পশ্চিম তীর দখল অব্যাহত আছে।
গাজার জনগণ কার্যত ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের দেয়ালে বন্দী। তাদের কাছে এই দেয়ালের মানে আরও এক গুচ্ছ অন্যায়ের বোঝা। এই দেয়ালের মানে ক্ষুধার্ত পেটে শিশুদের ঘুমোতে যাওয়া; আর চরম পুষ্টিহীন বহু শিশু। দেয়ালের মানে বিধ্বস্ত অর্থনীতি; মা-বাবার কাজ না জোটা—পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে না পারা। দেয়ালের মানে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন তাঁর আজীবনের তরে চলে যাওয়ার সুযোগ-সন্ধান। কেননা তাঁদের তো আসা-যাওয়ার অনুমতি নেই।
আমার মনে হয়, অবরুদ্ধ গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে (পূর্ব জেরুজালেমসহ) ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল যেভাবে জঘন্য ও নির্মম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তার পাশাপাশি ইসরায়েলে উদ্বাস্তুদের নিজ বাড়িতে ফিরে আসার অধিকার অস্বীকার করে চলেছে; সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের নাগরিক, অহিংস প্রতিরোধ-সংগ্রামের প্রতি সারা দুনিয়ার শুভ বোধসম্পন্ন মানুষের সমর্থন দেওয়ার দাবি রাখে।
সরকার যেখানে কিছু করতে অস্বীকৃতি জানায়, সেখানে জনগণকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়; তাদের হাতে শান্তিপূর্ণ যে হাতিয়ারই থাকুক না কেন, তা নিয়েই। আমার ক্ষেত্রে এর অর্থ, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংকশনস (বর্জন, বিনিয়োগ-প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা) প্রচারণায় যোগ দেওয়ার মাধ্যমে সংহতি জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় ঘোষণা—এই সংহতি শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিই নয়, যে হাজার হাজার ইসরায়েলি জনগণ সরকারি নীতিবিরোধী, তাদের প্রতিও।
মৌলিক মানবাধিকার সবারই প্রাপ্য—এই ভাবনা থেকেই আমার এই প্রত্যয়। এটা ইসরায়েলি জনগণের ওপর কোনো আক্রমণ নয়। সংগীতজগতে আমার সহকর্মী এবং অন্যান্য শিল্পের শিল্পীদের প্রতিও আমার অনুরোধ, আপনারা এই সাংস্কৃতিক বয়কটে শরিক হোন।
বর্ণবাদের পতন আর সাদা-কালো মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সানসিটি রিসোর্টে কোনো অনুষ্ঠান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে শিল্পীরা ঠিক কাজই করেছিলেন। যত দিন দখলদারির দেয়ালের পতন না ঘটবে, যত দিন পর্যন্ত না ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করবে শান্তি, স্বাধীনতা আর তাদের প্রাপ্য ন্যায় ও মর্যাদা সহকারে, তত দিন পর্যন্ত ইসরায়েলে কোনো অনুষ্ঠান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আমরাও ন্যায্য কাজই করব। নতুন সেই দিন আসবে, নিশ্চয়ই।

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রজার ওয়াটার্স: রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.