সহজিয়া কড়চা-সেদিনের বন্ধুদের ভুলতে পারি না by সৈয়দ আবুল মকসুদ
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অন্য দেশের যাঁরা নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন অথবা অন্যভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের ঋণ আমরা কোনো দিন পরিশোধ করতে পারব না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের যাঁরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের ঋণও পরিশোধযোগ্য নয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে সিদ্ধান্ত নেয়, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান, তাঁদের সম্মাননা দেবে। কাজটি বহু আগেই আমাদের করা উচিত ছিল।
পনেরো-বিশ বছর আগে আলহাজ মকবুল হোসেনের দৈনিক আল-আমীন-এর সঙ্গে কিছু সময় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যুক্ত ছিলেন। তখন অনুরুদ্ধ হয়ে আমি সেখানে দু-একটি লেখা লিখেছিলাম। বিশেষভাবে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও কাজী জাফর আহমদের স্নেহভাজন আশরাফ গিরানীর তাগিদে। একটি প্রবন্ধে আমি দুটি বিষয়ে বলেছিলাম। এক. মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লিখতে হলে শুধু আমাদের নিজেদের বক্তব্যের প্রাধান্য দিলে হবে না, ভারতীয় ও পাকিস্তানি লেখক-রাজনীতিকদের ভাষ্যও বিচার-বিবেচনা ও পরীক্ষা করে তা ব্যবহার করতে হবে। দুই. বাংলাদেশের বাইরে যাঁরা, বিশেষ করে ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি, সোভিয়েত, ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের একটা স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আমার মতো নগণ্য মানুষের কথা সরকারি কর্মকর্তারা শুনবেন না, তাও জানতাম।
আদৌ না হওয়ার চেয়ে ৪০ বছর পরে হলেও আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু ও হিতার্থীদের যে স্বীকৃতি ও সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা খুবই খুশির কথা। গত ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্মাননা প্রাপকদের তালিকা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ৪০০ বিদেশিকে সম্মাননা জানাবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁরা জীবিত তাঁদের সবাইকেই ঢাকায় নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মরণোত্তর সম্মাননা জানানো হবে। রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী এসব বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৫০ গ্রাম ওজনের একটি করে স্বর্ণপদক দেবেন। তাঁদের সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেওয়া হবে।
তালিকায় ভারতের ২২৬ জন এবং পাকিস্তানের ৪০ জন রয়েছেন। বাকিরা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হচ্ছে সুইস রেডক্রস, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন, সংবাদমাধ্যম বিবিসি, আকাশবাণী, জেনেভাভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস, আইসিআরসি, অক্সফাম জিবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন।
ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের সবার নামের তালিকা দেখার সুযোগ হয়নি। দেখলেও তাঁদের সবাইকে চিনব না। তালিকাটি তৈরি করেছে পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কোনো বিশেষ অবদানের জন্য কাউকে মনোনয়ন বা নির্বাচন করা কঠিন কাজ। কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠায় আস্থা রেখেই বলছি, আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক। তালিকাটি যদি বিখ্যাত ২০-২৫ জনের হতো, তা হলে কথা ছিল না। দীর্ঘ বলেই কথাটা বলছি। উপযুক্ত কেউ যদি বাদ পড়েন, তা হবে বেদনাদায়ক।
আমরা কোনো ব্যাপারেই গভীর অনুসন্ধানের চেষ্টা করি না। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্মোহভাবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার অভ্যাস আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। কোনো ব্যাপারে যিনি মনোনীত বা নির্বাচিত হবেন, তাঁর অবদান খতিয়ে দেখা উচিত। তাঁর চেয়ে বেশি অবদান যাঁর, তিনি বাদ পড়লেন কি না, তা মাথায় রাখা দরকার। যদি কোনো কারণে—ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়েন, তা হবে বড় অবিচার। অর্থাৎ একজনকে সম্মান দিতে গিয়ে আরেকজনকে অসম্মান করা।
বাংলাদেশের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষ সমর্থন দিয়েছেন। তাঁরা তা না দিলে আমরা অত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেতাম না, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতিও পেতাম না। তাঁদের সবার নাম-পরিচয়-ঠিকানা আমাদের পক্ষে কোনো দিনই জানা সম্ভব হবে না। বিশিষ্ট ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কেই শুধু জানা যাবে।
গোটা আরব বিশ্বই ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশের মুসলমানরা যে হাজারে হাজারে মরছে, তা তাদের মধ্যে কোনো করুণার সৃষ্টি করেনি। সেদিন ব্যতিক্রম ছিল ইরাক। ইরাকের বাথ আরব সোস্যালিস্ট পার্টির নেতারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭২-৭৩-এ দেখেছি, বঙ্গবন্ধু ইরাকি নেতাদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন। তখন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ছিলেন না, কিন্তু সাদ্দাম হোসেনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন।
দূরদেশের আরও কত যে মানুষ—কত দূরের সিন্ধুপারের কত বিদেশিনী আমাদের পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছেন, তার খবর আমরা জানি না। রবীন্দ্রপ্রেয়সী ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের জন্য শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরই চাপে হোর্হে লুইস বোর্হেসের মতো মহান লেখকও এগিয়ে আসেন। তাঁরা আরও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুই মারিয়া দ্য পাবলো পার্দোর সঙ্গে দেখা করে স্মারকপত্র দেন। ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকাজে অংশ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা কোনো আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, ‘মানব জাতির ট্র্যাজেডি’ বলে তাঁরা মন্তব্য করেছিলেন। ওকাম্পো-বোর্হেসের সঙ্গে অন্যদের মধ্যে ছিলেন এল সালভাদোর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার ইসমায়েল কুইলেস। তাঁদের কারণে লাতিন আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ওপর গবেষণা করার সময় প্যারিসে তাঁর কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছিলাম আরও কিছু ফরাসি বুদ্ধিজীবীর সংবাদ, যাঁরা ছিলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। সেদিন সামগ্রিকভাবে ফরাসি দেশ ছিল পাকিস্তান সরকারের পক্ষে, ব্যক্তিগতভাবে অনেক ফরাসি সমর্থন দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের। ওয়ালীউল্লাহ্র ভাষায়, ‘দ্য গল আর নেই; অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলবে এমন লোক আর নেই। বরঞ্চ মার্কিনিদের দলে যোগ দিয়ে চুপিচুপি জাহাজভর্তি সামরিক মালরসদ পাঠাচ্ছে এহাইয়া খানের সাহায্যার্থে।’
সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন না। বরং ছিলেন কট্টর বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি মিসেস গান্ধীকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন ও এর উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব বাংলাদেশ’। ভারতসহ ২৩টি দেশের প্রতিনিধিরা তাতে অংশ নেন। ফরাসি দেশ থেকে জাঁ-পল সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বুভোয়ারকে আনানোর ব্যাপারে ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ওই কনফারেন্সের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণের পক্ষে চিঠিতে ও ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন দিল্লি থেকে জর্জ ফার্নান্দেজ, রাধাকৃষ্ণ, এ সি সেন ও এম ভি রাও। রাও ছিলেন কো-অর্ডিনেটিং সেক্রেটারি।
জর্জ পাম্পিডুর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। কিন্তু অনেক ফরাসি বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁর কাছে আমাদের ঋণ সীমাহীন, তিনি হলেন আদ্রেঁ মালরো। তিনি ছিলেন একজন প্রধান ফরাসি লেখক এবং দ্য গল সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী। চীনা ও স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। একাত্তরে তিনি বৃদ্ধ। সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন-এ এক দীর্ঘ প্রতিবেদন বের হয় যে মালরো বাংলাদেশে যেতে চান এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে চান ‘Under Bengali orders’। ‘বেঙ্গলি সিচুয়েশনস’ তিনি অব্যাহত নজরদারি করছিলেন। অন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পিয়ের এসানুয়েল, লা আরে পিয়ের, প্রফেসর জি ফিলিরেয়ার, লঅ মঁদ-এর সম্পাদক প্রমুখ বাঙালির পক্ষে ছিলেন।
বাইরের মানুষের কথা যতই আমরা বলি, আসল সাহায্য পেয়েছি ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের গণহত্যার জের তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি ও প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করেছিল। প্রবাসী সরকারকে কাজ করতে হয়েছে কলকাতা থেকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী প্রমুখ অধিকাংশই ছিলেন কলকাতায়। তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে দলমত-নির্বিশেষে সেখানকার মানুষ।
আমার বন্ধুদের কেউ কেউ কলকাতায় গিয়ে কাগজ বের করেছিলেন। তাঁদের বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য করেছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা। আর্থিক সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয় যে ‘জয় বাংলা’ নামে আওয়ামী লীগের এক সাপ্তাহিক মুখপত্র মুজিবনগর থেকে আত্মপ্রকাশ করছে। এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আহমদ রফিক। জয় বাংলার জন্য মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রতিবেদন, লেখা প্রভৃতি আহ্বান করা হয়েছে। যোগাযোগের ঠিকানা: ৯ সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা।
অগ্রজপ্রতিম কবি, প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক আমার অতি ঘনিষ্ঠজন। তাঁর সঙ্গে ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নাগরিক-এ আমি কাজ করেছি। তিনিই জয় বাংলার সম্পাদক, সাংঘাতিক খুশি হলাম। ভাবলাম, নিয়মিত লেখা যাবে, নামে না হলেও বেনামে। দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু কয়েক দিন পরে শাহাদৎ চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুদের গ্রুপের একজন বললেন, টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের নেতা এম এন এ আবদুল মান্নান জয় বাংলার প্রকাশক-সম্পাদক, আহমদ রফিক তাঁর ছদ্মনাম। তা সত্ত্বেও জয় বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং লেখা পাঠাই।
মান্নান সাহেব ছিলেন চমৎকার মানুষ। বাহাত্তরেও জয় বাংলার সঙ্গে যুক্ত থাকি। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তিনি তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কিন্তু সরকারের তীব্র সমালোচনা করে লিখলেও কিছু বলতেন না। ষোলোই ডিসেম্বরের পরপর জয় বাংলার একটি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল। ওই সংখ্যার পরিচালনা সম্পাদক ছিলেন মো. জিল্লুর রহমান (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি), সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, এবনে গোলাম সামাদ প্রমুখ। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। শুনেছিলাম, ওই সংখ্যা প্রকাশে আর্থিক অনুদান দিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা।
যে প্রসঙ্গে কথাটি বললাম তা হলো, একাত্তরে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডসহ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনও দিয়েছে। তাদের কথা ভুললে আমাদের পক্ষে তা হবে দীনতার পরিচয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর পূর্বাণী হোটেলে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে যে মিডিয়া সেন্টার খোলা হয়, তাতে যুক্ত থেকে দেখেছি, শুধু কলকাতার নয়, অন্যান্য প্রদেশের বহু সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের যাঁরা অসামান্য অবদান রাখেন, আমি তাঁদের একটি তালিকা তৈরির চেষ্টা করেছিলাম নব্বইয়ের দশকে। উৎসাহ শুধু নয়, সঙ্গী পেয়েছিলাম যাঁকে, তিনি মহিউদ্দিন আহমদ। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কূটনীতিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেন। যোগ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান, সেখানে যাঁরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান, মহিউদ্দিন ভাই তাঁদের একজন। প্রথম বিএনপি সরকার তাঁকে জোর করে অকাল অবসরে পাঠায়। তিনি আমার সোদরপ্রতিম। বাধ্যতামূলক অবসরে থাকায় তাঁর কাজকর্ম ছিল না, তাই জুটি বাঁধি তাঁর সঙ্গে।
একাত্তর পুনরাবিষ্কারে আমরা পশ্চিমবঙ্গে অভিযানে বের হই। যাত্রা বিমানে নয়, সড়কপথে। দুজনের কাঁধে দুই ব্যাগ। আমাদের কোনো গন্তব্য ছিল না, ছিল শুধু যাত্রা। যেখানে রাত সেখানেই কাত। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। সীমান্তের ওপারে বিখ্যাত যশোর রোডে বড় বড় রেইনট্রির ছায়ায় হাঁটতে গিয়ে আমাদের চোখে ভেসে উঠেছিল একাত্তরের শরণার্থীদের স্রোতের দৃশ্য। কলকাতায় আমাদের দুজনের সঙ্গে যোগ দেন আমার আরেক আপনজন—বেলাল মোহাম্মদ, তাঁর পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তখন কলকাতা উপ-হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর ছিলেন আমাদের অনুজপ্রতিম মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। একাত্তর পুনরাবিষ্কার ও সেদিনের বন্ধুদের খুঁজে বের করতে তাঁর আন্তরিক সহায়তা পেয়েছি।
কাজের কাজ কিছু হোক বা না হোক, আমরা তিনজন কতবার কত সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা একসঙ্গে কাটিয়েছি। গড়ের মাঠ থেকে গঙ্গার তীরে বেলুড় মঠ। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বোলপুর শান্তিনিকেতন। শুরুলে শ্রীনিকেতন। খোয়াই বা ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। গিয়েছি কত জায়গায়। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অফিস কক্ষটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ওটা শ্রী অরবিন্দের পৈতৃক বাড়ি।
সময়ের পলিতে চাপা পড়ে গেছে সেদিনের বহু ব্যক্তির বড় অবদানের কথাও। ১৫ বছর ধরে আমি খুঁজেছি তাঁদের। একাত্তরে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র ছিলেন শ্যামসুন্দর গুপ্ত। বাংলাদেশের পক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি খুলেছিলেন মেয়রের ত্রাণ তহবিল—‘মেয়রস রিলিফ ফান্ড’। ডেপুটি মেয়র পান্নালাল দাসও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। শরণার্থীদের জন্য একটি স্বাস্থ্য ও সেবাকেন্দ্র খোলা হয়। ‘বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হোক’—এই দাবি নিয়ে মেয়রের নেতৃত্বে অলডারম্যান ও কাউন্সিলররা রাজভবনে শোভাযাত্রা করে যান। সেই ছবি আমার কাছে আছে। ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে’ শীর্ষক পৌরসভা থেকে একটি সাময়িকীও বের করা হয়েছিল। তাঁর নামটি কি সম্মাননা প্রাপকদের তালিকায় আছে?
সাহিত্য-সংস্কৃতি মাসিক চিত্রাঙ্গদার সম্পাদক অজিত মোহন গুপ্ত একেবারে শুরু থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। চিত্রাঙ্গদার ১০০ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংখ্যাটি একটি অসামান্য দলিল। অজিত গুপ্ত তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন।
সেপ্টেম্বরে জয় বাংলা নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন উমাপ্রসাদ মৈত্র, প্রযোজনা করেন ধীরেন দাশগুপ্ত। কাহিনি ও চিত্রনাট্য মিহির সেন। তাঁর একটি প্রিন্ট যদি আমাদের কাছে না থাকে, তা হবে বেদনাদায়ক। পশ্চিমবঙ্গে জনমত গঠনে এই ছবি বড় ভূমিকা রেখেছিল। সম্মাননা কি তাঁদের প্রাপ্য নয়?
বাঙালি কবি-লেখকদের আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি। কলকাতার খ্যাতিমান উর্দু কবি ও দৈনিক আফসার-এর সম্পাদক সালিক লাক্ষৌভি দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর ‘জাগ্ ওঠা বাংলাদেশ’ (জেগে উঠেছে বাংলাদেশ) আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রথম স্তবকটি এ রকম:
জাগ্ ওঠা বাংলাদেশ
জুলুমকে হাত সে সাজ হায় রাইফেল,
আজ মজলুম সিনে সিপার বান গ্যায়ে,
হার সোহাগান কি আঁখো সে সোলে রাওয়া।
জেগে উঠেছে বাংলাদেশ,
অত্যাচারীর হাতে আজ আছে রাইফেল,
আজ মজলুমের বক্ষ হয়ে গেছে ঢাল,
নব-পরিণীতারা আজ হাসে না—
তাদের চোখে আগুনের শিখা।
সালিক লাক্ষৌভি সম্মাননা পাবেন কি না, জানি না। একাত্তরে জনমত গঠনে নজরুলের জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর সম্মোহনী আবৃত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বের করা মিছিলে কলকাতার রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠত। স্বীকৃতি তাঁরও প্রাপ্য।
সীমাহীন রক্তপাতের ভেতর দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে অন্য দেশের যাঁরা সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন দেন, তাঁদের কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ। উপকারীর উপকার স্বীকার করার নামই কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ থাকা ভালো। এই যে এত দিন পর দুঃসময়ের বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমাদের কৃতজ্ঞতার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তবে কোনো কারণে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরাও যেন পরে কখনো সম্মাননা পান—সেই আবেদন করি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পনেরো-বিশ বছর আগে আলহাজ মকবুল হোসেনের দৈনিক আল-আমীন-এর সঙ্গে কিছু সময় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যুক্ত ছিলেন। তখন অনুরুদ্ধ হয়ে আমি সেখানে দু-একটি লেখা লিখেছিলাম। বিশেষভাবে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও কাজী জাফর আহমদের স্নেহভাজন আশরাফ গিরানীর তাগিদে। একটি প্রবন্ধে আমি দুটি বিষয়ে বলেছিলাম। এক. মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লিখতে হলে শুধু আমাদের নিজেদের বক্তব্যের প্রাধান্য দিলে হবে না, ভারতীয় ও পাকিস্তানি লেখক-রাজনীতিকদের ভাষ্যও বিচার-বিবেচনা ও পরীক্ষা করে তা ব্যবহার করতে হবে। দুই. বাংলাদেশের বাইরে যাঁরা, বিশেষ করে ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি, সোভিয়েত, ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের একটা স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আমার মতো নগণ্য মানুষের কথা সরকারি কর্মকর্তারা শুনবেন না, তাও জানতাম।
আদৌ না হওয়ার চেয়ে ৪০ বছর পরে হলেও আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু ও হিতার্থীদের যে স্বীকৃতি ও সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা খুবই খুশির কথা। গত ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্মাননা প্রাপকদের তালিকা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ৪০০ বিদেশিকে সম্মাননা জানাবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁরা জীবিত তাঁদের সবাইকেই ঢাকায় নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মরণোত্তর সম্মাননা জানানো হবে। রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী এসব বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৫০ গ্রাম ওজনের একটি করে স্বর্ণপদক দেবেন। তাঁদের সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেওয়া হবে।
তালিকায় ভারতের ২২৬ জন এবং পাকিস্তানের ৪০ জন রয়েছেন। বাকিরা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হচ্ছে সুইস রেডক্রস, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন, সংবাদমাধ্যম বিবিসি, আকাশবাণী, জেনেভাভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস, আইসিআরসি, অক্সফাম জিবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন।
ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের সবার নামের তালিকা দেখার সুযোগ হয়নি। দেখলেও তাঁদের সবাইকে চিনব না। তালিকাটি তৈরি করেছে পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কোনো বিশেষ অবদানের জন্য কাউকে মনোনয়ন বা নির্বাচন করা কঠিন কাজ। কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠায় আস্থা রেখেই বলছি, আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক। তালিকাটি যদি বিখ্যাত ২০-২৫ জনের হতো, তা হলে কথা ছিল না। দীর্ঘ বলেই কথাটা বলছি। উপযুক্ত কেউ যদি বাদ পড়েন, তা হবে বেদনাদায়ক।
আমরা কোনো ব্যাপারেই গভীর অনুসন্ধানের চেষ্টা করি না। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্মোহভাবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার অভ্যাস আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। কোনো ব্যাপারে যিনি মনোনীত বা নির্বাচিত হবেন, তাঁর অবদান খতিয়ে দেখা উচিত। তাঁর চেয়ে বেশি অবদান যাঁর, তিনি বাদ পড়লেন কি না, তা মাথায় রাখা দরকার। যদি কোনো কারণে—ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়েন, তা হবে বড় অবিচার। অর্থাৎ একজনকে সম্মান দিতে গিয়ে আরেকজনকে অসম্মান করা।
বাংলাদেশের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষ সমর্থন দিয়েছেন। তাঁরা তা না দিলে আমরা অত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেতাম না, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতিও পেতাম না। তাঁদের সবার নাম-পরিচয়-ঠিকানা আমাদের পক্ষে কোনো দিনই জানা সম্ভব হবে না। বিশিষ্ট ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কেই শুধু জানা যাবে।
গোটা আরব বিশ্বই ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশের মুসলমানরা যে হাজারে হাজারে মরছে, তা তাদের মধ্যে কোনো করুণার সৃষ্টি করেনি। সেদিন ব্যতিক্রম ছিল ইরাক। ইরাকের বাথ আরব সোস্যালিস্ট পার্টির নেতারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭২-৭৩-এ দেখেছি, বঙ্গবন্ধু ইরাকি নেতাদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন। তখন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ছিলেন না, কিন্তু সাদ্দাম হোসেনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন।
দূরদেশের আরও কত যে মানুষ—কত দূরের সিন্ধুপারের কত বিদেশিনী আমাদের পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছেন, তার খবর আমরা জানি না। রবীন্দ্রপ্রেয়সী ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের জন্য শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরই চাপে হোর্হে লুইস বোর্হেসের মতো মহান লেখকও এগিয়ে আসেন। তাঁরা আরও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুই মারিয়া দ্য পাবলো পার্দোর সঙ্গে দেখা করে স্মারকপত্র দেন। ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকাজে অংশ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা কোনো আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, ‘মানব জাতির ট্র্যাজেডি’ বলে তাঁরা মন্তব্য করেছিলেন। ওকাম্পো-বোর্হেসের সঙ্গে অন্যদের মধ্যে ছিলেন এল সালভাদোর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার ইসমায়েল কুইলেস। তাঁদের কারণে লাতিন আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ওপর গবেষণা করার সময় প্যারিসে তাঁর কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছিলাম আরও কিছু ফরাসি বুদ্ধিজীবীর সংবাদ, যাঁরা ছিলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। সেদিন সামগ্রিকভাবে ফরাসি দেশ ছিল পাকিস্তান সরকারের পক্ষে, ব্যক্তিগতভাবে অনেক ফরাসি সমর্থন দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের। ওয়ালীউল্লাহ্র ভাষায়, ‘দ্য গল আর নেই; অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলবে এমন লোক আর নেই। বরঞ্চ মার্কিনিদের দলে যোগ দিয়ে চুপিচুপি জাহাজভর্তি সামরিক মালরসদ পাঠাচ্ছে এহাইয়া খানের সাহায্যার্থে।’
সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন না। বরং ছিলেন কট্টর বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি মিসেস গান্ধীকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন ও এর উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব বাংলাদেশ’। ভারতসহ ২৩টি দেশের প্রতিনিধিরা তাতে অংশ নেন। ফরাসি দেশ থেকে জাঁ-পল সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বুভোয়ারকে আনানোর ব্যাপারে ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ওই কনফারেন্সের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণের পক্ষে চিঠিতে ও ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন দিল্লি থেকে জর্জ ফার্নান্দেজ, রাধাকৃষ্ণ, এ সি সেন ও এম ভি রাও। রাও ছিলেন কো-অর্ডিনেটিং সেক্রেটারি।
জর্জ পাম্পিডুর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। কিন্তু অনেক ফরাসি বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁর কাছে আমাদের ঋণ সীমাহীন, তিনি হলেন আদ্রেঁ মালরো। তিনি ছিলেন একজন প্রধান ফরাসি লেখক এবং দ্য গল সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী। চীনা ও স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। একাত্তরে তিনি বৃদ্ধ। সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন-এ এক দীর্ঘ প্রতিবেদন বের হয় যে মালরো বাংলাদেশে যেতে চান এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে চান ‘Under Bengali orders’। ‘বেঙ্গলি সিচুয়েশনস’ তিনি অব্যাহত নজরদারি করছিলেন। অন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পিয়ের এসানুয়েল, লা আরে পিয়ের, প্রফেসর জি ফিলিরেয়ার, লঅ মঁদ-এর সম্পাদক প্রমুখ বাঙালির পক্ষে ছিলেন।
বাইরের মানুষের কথা যতই আমরা বলি, আসল সাহায্য পেয়েছি ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের গণহত্যার জের তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি ও প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করেছিল। প্রবাসী সরকারকে কাজ করতে হয়েছে কলকাতা থেকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী প্রমুখ অধিকাংশই ছিলেন কলকাতায়। তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে দলমত-নির্বিশেষে সেখানকার মানুষ।
আমার বন্ধুদের কেউ কেউ কলকাতায় গিয়ে কাগজ বের করেছিলেন। তাঁদের বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য করেছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা। আর্থিক সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয় যে ‘জয় বাংলা’ নামে আওয়ামী লীগের এক সাপ্তাহিক মুখপত্র মুজিবনগর থেকে আত্মপ্রকাশ করছে। এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আহমদ রফিক। জয় বাংলার জন্য মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রতিবেদন, লেখা প্রভৃতি আহ্বান করা হয়েছে। যোগাযোগের ঠিকানা: ৯ সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা।
অগ্রজপ্রতিম কবি, প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক আমার অতি ঘনিষ্ঠজন। তাঁর সঙ্গে ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নাগরিক-এ আমি কাজ করেছি। তিনিই জয় বাংলার সম্পাদক, সাংঘাতিক খুশি হলাম। ভাবলাম, নিয়মিত লেখা যাবে, নামে না হলেও বেনামে। দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু কয়েক দিন পরে শাহাদৎ চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুদের গ্রুপের একজন বললেন, টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের নেতা এম এন এ আবদুল মান্নান জয় বাংলার প্রকাশক-সম্পাদক, আহমদ রফিক তাঁর ছদ্মনাম। তা সত্ত্বেও জয় বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং লেখা পাঠাই।
মান্নান সাহেব ছিলেন চমৎকার মানুষ। বাহাত্তরেও জয় বাংলার সঙ্গে যুক্ত থাকি। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তিনি তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কিন্তু সরকারের তীব্র সমালোচনা করে লিখলেও কিছু বলতেন না। ষোলোই ডিসেম্বরের পরপর জয় বাংলার একটি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল। ওই সংখ্যার পরিচালনা সম্পাদক ছিলেন মো. জিল্লুর রহমান (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি), সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, এবনে গোলাম সামাদ প্রমুখ। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। শুনেছিলাম, ওই সংখ্যা প্রকাশে আর্থিক অনুদান দিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা।
যে প্রসঙ্গে কথাটি বললাম তা হলো, একাত্তরে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডসহ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনও দিয়েছে। তাদের কথা ভুললে আমাদের পক্ষে তা হবে দীনতার পরিচয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর পূর্বাণী হোটেলে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে যে মিডিয়া সেন্টার খোলা হয়, তাতে যুক্ত থেকে দেখেছি, শুধু কলকাতার নয়, অন্যান্য প্রদেশের বহু সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের যাঁরা অসামান্য অবদান রাখেন, আমি তাঁদের একটি তালিকা তৈরির চেষ্টা করেছিলাম নব্বইয়ের দশকে। উৎসাহ শুধু নয়, সঙ্গী পেয়েছিলাম যাঁকে, তিনি মহিউদ্দিন আহমদ। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কূটনীতিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেন। যোগ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান, সেখানে যাঁরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান, মহিউদ্দিন ভাই তাঁদের একজন। প্রথম বিএনপি সরকার তাঁকে জোর করে অকাল অবসরে পাঠায়। তিনি আমার সোদরপ্রতিম। বাধ্যতামূলক অবসরে থাকায় তাঁর কাজকর্ম ছিল না, তাই জুটি বাঁধি তাঁর সঙ্গে।
একাত্তর পুনরাবিষ্কারে আমরা পশ্চিমবঙ্গে অভিযানে বের হই। যাত্রা বিমানে নয়, সড়কপথে। দুজনের কাঁধে দুই ব্যাগ। আমাদের কোনো গন্তব্য ছিল না, ছিল শুধু যাত্রা। যেখানে রাত সেখানেই কাত। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। সীমান্তের ওপারে বিখ্যাত যশোর রোডে বড় বড় রেইনট্রির ছায়ায় হাঁটতে গিয়ে আমাদের চোখে ভেসে উঠেছিল একাত্তরের শরণার্থীদের স্রোতের দৃশ্য। কলকাতায় আমাদের দুজনের সঙ্গে যোগ দেন আমার আরেক আপনজন—বেলাল মোহাম্মদ, তাঁর পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তখন কলকাতা উপ-হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর ছিলেন আমাদের অনুজপ্রতিম মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। একাত্তর পুনরাবিষ্কার ও সেদিনের বন্ধুদের খুঁজে বের করতে তাঁর আন্তরিক সহায়তা পেয়েছি।
কাজের কাজ কিছু হোক বা না হোক, আমরা তিনজন কতবার কত সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা একসঙ্গে কাটিয়েছি। গড়ের মাঠ থেকে গঙ্গার তীরে বেলুড় মঠ। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বোলপুর শান্তিনিকেতন। শুরুলে শ্রীনিকেতন। খোয়াই বা ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। গিয়েছি কত জায়গায়। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অফিস কক্ষটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ওটা শ্রী অরবিন্দের পৈতৃক বাড়ি।
সময়ের পলিতে চাপা পড়ে গেছে সেদিনের বহু ব্যক্তির বড় অবদানের কথাও। ১৫ বছর ধরে আমি খুঁজেছি তাঁদের। একাত্তরে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র ছিলেন শ্যামসুন্দর গুপ্ত। বাংলাদেশের পক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি খুলেছিলেন মেয়রের ত্রাণ তহবিল—‘মেয়রস রিলিফ ফান্ড’। ডেপুটি মেয়র পান্নালাল দাসও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। শরণার্থীদের জন্য একটি স্বাস্থ্য ও সেবাকেন্দ্র খোলা হয়। ‘বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হোক’—এই দাবি নিয়ে মেয়রের নেতৃত্বে অলডারম্যান ও কাউন্সিলররা রাজভবনে শোভাযাত্রা করে যান। সেই ছবি আমার কাছে আছে। ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে’ শীর্ষক পৌরসভা থেকে একটি সাময়িকীও বের করা হয়েছিল। তাঁর নামটি কি সম্মাননা প্রাপকদের তালিকায় আছে?
সাহিত্য-সংস্কৃতি মাসিক চিত্রাঙ্গদার সম্পাদক অজিত মোহন গুপ্ত একেবারে শুরু থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। চিত্রাঙ্গদার ১০০ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংখ্যাটি একটি অসামান্য দলিল। অজিত গুপ্ত তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন।
সেপ্টেম্বরে জয় বাংলা নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন উমাপ্রসাদ মৈত্র, প্রযোজনা করেন ধীরেন দাশগুপ্ত। কাহিনি ও চিত্রনাট্য মিহির সেন। তাঁর একটি প্রিন্ট যদি আমাদের কাছে না থাকে, তা হবে বেদনাদায়ক। পশ্চিমবঙ্গে জনমত গঠনে এই ছবি বড় ভূমিকা রেখেছিল। সম্মাননা কি তাঁদের প্রাপ্য নয়?
বাঙালি কবি-লেখকদের আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি। কলকাতার খ্যাতিমান উর্দু কবি ও দৈনিক আফসার-এর সম্পাদক সালিক লাক্ষৌভি দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর ‘জাগ্ ওঠা বাংলাদেশ’ (জেগে উঠেছে বাংলাদেশ) আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রথম স্তবকটি এ রকম:
জাগ্ ওঠা বাংলাদেশ
জুলুমকে হাত সে সাজ হায় রাইফেল,
আজ মজলুম সিনে সিপার বান গ্যায়ে,
হার সোহাগান কি আঁখো সে সোলে রাওয়া।
জেগে উঠেছে বাংলাদেশ,
অত্যাচারীর হাতে আজ আছে রাইফেল,
আজ মজলুমের বক্ষ হয়ে গেছে ঢাল,
নব-পরিণীতারা আজ হাসে না—
তাদের চোখে আগুনের শিখা।
সালিক লাক্ষৌভি সম্মাননা পাবেন কি না, জানি না। একাত্তরে জনমত গঠনে নজরুলের জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর সম্মোহনী আবৃত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বের করা মিছিলে কলকাতার রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠত। স্বীকৃতি তাঁরও প্রাপ্য।
সীমাহীন রক্তপাতের ভেতর দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে অন্য দেশের যাঁরা সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন দেন, তাঁদের কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ। উপকারীর উপকার স্বীকার করার নামই কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ থাকা ভালো। এই যে এত দিন পর দুঃসময়ের বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমাদের কৃতজ্ঞতার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তবে কোনো কারণে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরাও যেন পরে কখনো সম্মাননা পান—সেই আবেদন করি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments