ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

নিজের ব্যাটাঘাতে ‘বাপরে’ বলে বসে পড়তেই দেখি, বলের চোটে স্টাম্প-ফাম্পগুলো কোথায় উড়ে বেরিয়ে গেছে।
—আউট—আউট! চারিদিকে বেদম চিৎকার। আমপায়ার আবার মাথার ওপরে একটা হাত তুলে জগাই-মাধাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে।


কে আউট হল? ক্যাবলা বোধহয়? আমি তক্ষুনি জানতাম, আমাকে কাকতাড়ুয়া বলে গাল দিয়েছে—আউট না হয়ে যায় কোথায়!
হাঁটুর চোটটা সামলে নিয়ে ব্যাট দিয়ে স্টাম্পগুলো সব ঠিক করতে যাচ্ছি—হঠাৎ হতচ্ছাড়া আমপায়ার বলে বসল—তুমি আউট, চলে যাও।
আউট? বললেই হল? আউট হবার জন্যেই এত কষ্ট করে প্যাড আর পেন্টলুন পরেছি নাকি? আচ্ছা দ্যাখো একবার। বয়ে গেছে আমার আউট হতে!
বললাম, আমি আউট হব না। এখন আউট হবার কোনও দরকার দেখছি না আমি।
আমি ঠিক বুঝেছিলাম ওরা আমপায়ার নয়, ভ্যামপায়ার। কুইনিন চিবোনোর মতো যাচ্ছেতাই মুখ করে বললে: দরকার না থাকলেও তুমি আউট হয়ে গেছ। স্টাম্প পড়ে গেছে তোমার।
—পড়ে গেছে তো কী হয়েছে—আমি রেগে বললাম, আবার দাঁড় করিয়ে দিতে কতক্ষণ? ও-সব চালাকি চলবে না স্যার—এখনও আমার ওভার-বাউন্ডারি করা হয়নি।
কেন জানি না, চারিদিকে ভারি যাচ্ছেতাই একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেল। চোরবাগান ক্লাবের লোকগুলোই বা কেন যে এ-রকম দাপাদাপি করছে, আমি কিছু বুঝতে পারলুম না।
তার মধ্যে আবার চালকুমড়ো ক্যাবলাটা ছুটে এল ওদিক থেকে।
—চলে যা—চলে যা প্যালা। তুই আউট হয়ে গেছিস।
আর কতক্ষণ ধৈর্য থাকে এ-অবস্থায়? আমি চেঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে থাকে তুই আউট হ-গে! আমি এখন ওভার-বাউন্ডারি করব!
আমার কানের কাছে সবাই মিলে তখন সমান কিচির-মিচির করছে। আমি কান দিতাম না—যদি না কটাং করে আমার কানে টান পড়ত। তাকিয়ে দেখি—টেনিদা।
ধাঁই করে আমার কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে কানে একটা চিড়িং মেরে দিল—তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাম আমি। —যা—যা উল্লুক! বেরো মাঠ থেকে। খুব ওস্তাদি হয়েছে, আর নয়! রামছাগলের মতো মুখ করে অগত্যা আমায় চলে যেতে হল। মনে মনে বললাম, আমাকে আউট করা! আউট কাকে বলে সে আমি দেখিয়ে দেব! গিয়ে তো বসলাম—কিন্তু কী তাজ্জব কাণ্ড! আমাদের দেখিয়ে দেবার আগেই চোরাবাগানের টাইগার ক্লাব আউট দেখিয়ে দিচ্ছে। কাররও স্টাম্প উল্টে পড়েছে, পিছনে যে লোকটা কাঙালি বিদায়ের মতো করে হাত বাড়িয়ে বসে আছে, সে আবার খুঁটস করে স্টাম্প লাগিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা মারবার সঙ্গে-সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বল লুফে নিচ্ছে। খালি আউট—আউট—আউট! এ আবার কী কাণ্ড রে বাবা!
আমাদের পটলডাঙা থান্ডার ক্লাব ব্যাট বগলে যাচ্ছে আর আসছে। এমন যে ডাকসাইটে টেনিদা, তারও বল একটা রোগাপটকা ছেলে কটাৎ করে পাকড়ে নিলে। হবেই তো! এদিকে মোটে দু’জন—ওদিকে এগারো, সেই সঙ্গে আবার দু’টো আমপায়ার। কোন্ ভদ্দরলোকে ঝিঁঝি খেলতে পারে কখনও।
ওই চালকুমড়ো ক্যাবলাটাই টিকে রইল শেষতক। কুড়ি না একুশ রান করল বোধ হয়। পঞ্চাশ রান না পেরুতেই পটলডাঙা থান্ডার ক্লাব বেমালুম সাফ।
এইবার আমাদের পালা। ভারি খুশি হল মনটা। আমরা এগারো জন এবারে তোমাদের নিয়ে পড়ব। আমপায়ার দুটোও দেখি ওদের দল ছেড়ে আমাদের সঙ্গে এসে ভিড়েছে। কিন্তু ওদের মতলব ভালো নয় বলেই আমার বোধ হল।
ক্যাপ্টেন টেনিদাকে বললাম, আমপায়ার দুটোকে বাদ দিলে হয় না? ওরা নয় ওদের সঙ্গেই ব্যাট করুক।
টেনিদা আমাকে রদ্দা মারতে এল। বললে, বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা? ওখানে দাঁড়া। একটা ক্যাচ ফেলেছিস কি ঘ্যাঁচ করে কান কেটে দেব। ব্যাট তো খুব করেছিস—এবার যদি ঠিকমতো ফিল্ডিং করতে না পারিস, তা হলে তোর পালাজ্বলের পিলে আমি আস্ত রাখব না!
হাবুল সেন বল করতে গেল।
প্রথম বলেই—ওরে বাপ রে! টাইগার ক্লাবের সেই রোগা ছোকরাটা কী একখানা হাঁকড়ালে! বৌঁ করে বল বেরিয়ে গেল, একদম বাউন্ডারি। ক্যাবলা প্রাণপণে ছুটেও রুখতে পারলে না।
পরের বলেও আবার সেই হাঁকড়ানি। তাকিয়ে দেখি, কামানের গুলির মতো বলটা আমার দিকেই ছুটে আসছে।
একটু দূরেই ছিল আমাদের পাঁচুগোপাল। চেঁচিয়ে বললে, প্যালা—ক্যাচ—ক্যাচ—
—ক্যাচ! ক্যাচ! দূরে দাঁড়িয়ে ও-রকম সবাই-ই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করতে পারে! ওই বল ধরতে গিয়ে আমি মরি আর-কি! তার চাইতে বললেই হয়, পাঞ্জাব মেল ছুটছে প্যালা লুফে নে? মাথা নিচু করে আমি চুপ করে বসে পড়লাম—আবার বল বাউন্ডারি পার।
হইহই করে টেনিদা ছুটে এল।
—ধরলিনে যে?
—ও ধরা যায় না!
—ধরা যায় না? ইস—এমন চমৎকার ক্যাচটা, এক্ষুনি আউট হয়ে যেত!
—সবাইকে আউট করে লাভ কী? তা হলে খেলবে কে? আমরাই তো আউট হয়ে গেছি—এখন খেলুক না ওরা!
—খেলুক না ওরা!—টেনিদা ভেংচি কাটল—তোর মতো গাড়লকে খেলায় নামানোই আমার ভুল হয়েছে! যা—যা—বাউন্ডারি লাইনে চলে যা!
চলে গেলাম। আমার কী! বসে-বসে ঘাসের শিষ চিবুচ্ছি। দুটো-একটা বল এদিক-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল, ধরার চেষ্টা করেও দেখলাম। বোঝা গেল, ও-সব ধরা যায় না। হাতের তলা দিয়ে যেমন শোলমাছ গলে যায়—তেমনি সুড়ৎ-সুড়ৎ করে পিছলে বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে যেতে লাগল।
আর শাবাশ বলতে হবে চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের ওই রোগা ছোকরাকে! ডাইনে মারছে, বাঁয়ে মারছে, চটাং করে মারছে, সাঁই করে মারছে, ধাঁই করে মারছে! একটা বলও বাদ যাচ্ছে না। এর মধ্যেই বেয়াল্লিশ রান করে ফেলেছে একাই। দেখে ভীষণ ভালো লাগল আমার। পকেটে চকোলেট থাকলে দুটো ওকে আমি খেতে দিতাম।
হঠাৎ বল নিয়ে টেনিদা আমার কাছে হাজির।
—ব্যাটিং দেখলাম, ফিল্ডিংও দেখছি। বল করতে পারবি?
এতক্ষণ ঝিঁঝি খেলা দেখে আমার মনে হয়েছিল—বল করাটাই সবচেয়ে সোজা। একপায়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম—খুব পারব। এ আর শক্তটা কী?
—ওদের ওই রোগাপটকা গোঁসাইকে আউট করা চাই। পারবিনে?
—এক্ষুনি আউট করে দিচ্ছি—কিছু ভেবো না!
আমি আগেই জানি, আমপায়ার দুটোর মতলব খারাপ। সেইজন্যেই আমাদের দল থেকে ওদের বাদ দিতে বলেছিলাম— টেনিদা কথাটা কানে তুলল না। যেই প্রথম বলটা দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে বললে—নো বল!
নো বল তো নো বল—তোদের কী! বলতেও যাচ্ছিলাম, কিন্তু গোঁসাই দেখি আবার ধাঁই করে হাঁকড়ে দিয়েছে, বাউন্ডারি তো তুচ্ছ—একেবারে ওভার-বাউন্ডারি!
আর চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের সে কী হাততালি! একজন তো দেখলাম আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে!
এইবার আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে আগুন জ্বলে গেল। মাথায় টিকি নেই—যদি থাকত, নিশ্চয় তেজে রেফের মতো খাড়া হয়ে উঠত। বটে—ডিগবাজি। আচ্ছা—দাঁড়াও! বল হাতে ফিরে যেতেই ঠিক করলাম—এবার গোঁসাইকে একেবারে আউট করে দেব! মোক্ষম আউট!
প্যাডটা বোধহয় ঢিলে হয়ে গেছে—গোঁসাই পিছন ফিরে সেটা বাঁধছিল। দেখলাম, এই সুযোগ। ব্যাট নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালে কিছু করতে পারব না—এই সুযোগেই কর্ণবধ!
মামার বাড়িতে আম পেড়ে পেড়ে হাতের টিপ হয়ে গেছে—আর ভুল হল না। আমপায়ার না ভ্যামপায়ার হাঁ-হাঁ করে ওঠবার আগেই বোঁ করে বল ছুঁড়ে দিলাম।
নির্ঘাত লক্ষ্য! গোঁসাইয়ের মাথায় গিয়ে খটাং করে বল লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই—‘ওরে বাবা!’ গোঁসাই মাঠের মধ্যে ফ্ল্যাট!
আউট যাকে বলে! অন্তত এক হপ্তার জন্যে বিছানায় আউট!
আরে—এ কী, এ কী! মাঠসুদ্ধ লোক তেড়ে আসছে যে! ‘মার মার’ করে আওয়াজ উঠছে যে! অ্যাঁ—আমাকেই নাকি?
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। কান ঝিঁঝি করছে, প্রাণপণে ছুটতে-ছুটতে এবারে টের পাচ্ছি—আসল ঝিঁঝি খেলা কাকে বলে!
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: ভারতীয় বাঙালি লেখক ও ঔপন্যাসিক। ছোটদের জন্য তাঁর সৃষ্ট চরিত্র টেনিদা খুবই জনপ্রিয়।

No comments

Powered by Blogger.