লাঞ্ছিত গণতন্ত্রের দেশে বিপন্ন সংসদ by এ কে এম শাহনাওয়াজ
পরাধীন পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় সময়ে এসে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। একটি সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে পথ অতিক্রমে পা বাড়িয়েছিলেন, তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পরাজিত বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র আর লোভী নিকৃষ্ট রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের পাতা ফাঁদ বঙ্গবন্ধুকে অভীষ্টে পেঁৗছাতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু আর চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছিল। এই অন্ধকারে পথ হাঁটা 'মেধাবী' মানুষরা ঠিকই বুঝেছিল, অতঃপর আওয়ামী লীগের বাকি কাণ্ডারিদের নিয়ে ভাবিত না হলেও চলবে। গণতন্ত্র শক্ত ভিতের ওপর না দাঁড়াতে পারলে বাঙালি তার স্বপ্নের ঠিকানা পাবে না কখনো। ফলে মানুষের মুক্তি না এলে অস্থিতিশীল থাকবে এ দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজ; যা কাম্য ষড়যন্ত্রকারীদের। এ পর্যন্ত আওয়ামী নেতৃত্ব যে রাজনৈতিক মেধার পরিচয় দিয়েছে, সরকার পরিচালনায় যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধারার দায়বদ্ধতা দেখাতে পেরেছে, তাতে বরং লাঞ্ছিত হয়েছে গণতন্ত্র। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ তো প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্রের হন্তারকই। তাই সেই অঞ্চল থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা অলীক কল্পনা মাত্র।
রাষ্ট্র-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনকল্যাণে ব্রতী হয় শুধু দেশপ্রেমিক দল এবং ব্যক্তি। এ ধারার রাজনীতিকরা তাই আলোকিত পথে হাঁটেন। স্বচ্ছ রাজনীতির পথে হেঁটে গণমানুষের সমর্থন পাওয়াটাই বড় মনে করেন। আর নিকৃষ্ট রাজনীতির চর্চাকারী ব্যক্তি ও দল ব্যক্তিক এবং দলীয় লোভ অথবা স্থূল মেধা দ্বারা চালিত হয় বলে যেকোনোভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায় এবং নানাভাবে ক্ষমতায় থাকার পরিধি বাড়ানোর জন্য সাধনা করে। অবশ্য এই সাধনার পথে জনকল্যাণের আদর্শ বড় একটা জায়গা পায় না। এ ধারার রাজনীতিকদের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পায় অসংস্কৃত আচরণ।
আমাদের সৌভাগ্য, লুই কান একটি সুদৃশ্য সংসদ ভবন বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বারবার বিপন্ন হয়েছে এই ইমারতটি। দেশপ্রেমিক শোভন রাজনীতিক আইনপ্রণেতাদের পদভারে মুখরিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। এতটাই স্থূল মেধা আর অসংস্কৃতি বোধের অমার্জিত মানুষদের একটি অংশ এখন কূট-রাজনীতির পথ হেঁটে এখানে বসার অধিকারী হন যে সম্মান বাঁচাতে সুস্থ ধারার রাজনীতিক সাংসদরা লা-জবাব হয়ে যান। সংসদের চেহারা দেখলে আশঙ্কা হয়, প্রবীণ-প্রাজ্ঞ দায়িত্বশীল যে কজন সাংসদ অধিবেশন কক্ষের অন্ধকার সামান্য ফিকে করে এখনো আছেন, তাঁদের পরে সংসদ কেমন ভাগাড়ে পরিণত হবে! সংসদ ক্রমে খিস্তিখেউড়ের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। সংসদকে প্রাণবন্ত করতে বিপক্ষদলীয় সাংসদদের প্রতি কটাক্ষ করে শব্দবাণে জর্জরিত করা যায়, তবে তার মধ্যে থাকে মার্জিত রুচির পরিচয়। মেধাবী কৌতুক আমোদিতও করে। রাজনৈতিক মেধা ও মননশীলতা প্রকাশক তীক্ষ্ন শব্দবাণ সফল বিতার্কিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তেমন সাংসদকে। কিন্তু কী শুনি, আজকাল কোনো কোনো তরুণ সাংসদ এবং কখনো কখনো বয়সী অপ্রাজ্ঞ সাংসদদের বক্তব্যে? যে কারণে মাননীয় স্পিকারকে অনুরোধ জানাতে হয় কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল ভাষা পরিহার করার জন্য। মাঝেমধ্যে ভাবি, সংসদ অধিবেশন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার না করলে ভালো। অথবা আমাদের দেশে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের যে অভ্যাস হয়েছে, তা আইন করে পাকাপাকি করা যেতে পারে। জনগণের স্বস্তির বিনিময়ে এমন আইন পাস হোক যে ৯০ কার্যদিবস উপস্থিত না হলেও কেউ সদস্য পদ হারাবে না। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে সদস্য পদ বাঁচাতে সংসদে আসতে হবে না। সংসদে কোনো ভূমিকা না রেখেও আইনসম্মতভাবেই সাংসদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন সাংসদরা। এমন হলে সংসদে উপস্থিত সদস্যদের হাত একটাই থাকবে। ফলে কঠিন শব্দদূষণের তালি থেকে আমরা বেঁচে যাব। সংসদে এসেই অনেক তরুণ তুর্কি সাংসদ ভুলে যান তাঁদের মর্যাদার কথা। আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের কথা। অশালীন শব্দে ও ভঙ্গিতে বলতে থাকেন কার শাড়ির রং সাদা না গোলাপি, কে সাজুগুজু করতে পছন্দ করেন, কোন মন্ত্রী জেলে যাওয়ার সময় তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে কার কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, কার নিকটাত্মীয় বিদেশে খ্রিস্টান-ইহুদি বিয়ে করেছেন...। এমন সব অশ্রাব্য। স্রোতের শেওলা ধরার মতো অসহায় দর্শক-শ্রোতা আমরা অমন অবস্থায় ভাবি, হয়তো এখনই যাঁর যাঁর দলের বয়সী দায়িত্বশীল নেতারা এসব প্রগলভ অর্বাচীনদের থামিয়ে দিয়ে নিজেদের এবং সংসদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। কিন্তু না, তাঁরা টেবিল চাপড়িয়ে বরং উৎসাহী করেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কোনো কোনো সাংসদের মুখে পোকাধরা ধানের খৈ ফুটছে বেশি। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, সুপ্রিম নেতা-নেত্রীদের আস্থায় থাকতে হলে আমাদের তো এক কাঠি সরেস হতেই হবে।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে, আমাদের মতো অনাধুনিক মানুষদের। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে কারণে সব হিন্দি ছবি দেখতে পারি না_অশ্লীল দৃশ্যের কারণে চ্যানেল পরিবর্তন করতে হয়। তেমনি এখন সংসদ অধিবেশন টিভিতে দেখার সময় সতর্ক হয়ে রিমোট কন্ট্রোল হাতে রাখি। যদি বাড়ির উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরা এসব খিস্তি শিখে ফেলে।
ক্রমাগত এমন অধোগতি হচ্ছে কেন! লক্ষ করলে দেখা যাবে, দু-একজন সুপ্রিম নেতা-নেত্রীর কথা বাদ দিলে রাজনীতির ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা জ্যেষ্ঠ নেতাদের সংসদীয় বক্তব্য তথ্যবহুল এবং সংসদীয় ভাষাসমৃদ্ধ। খিস্তিখেউড় আওড়াতে যাঁদের পছন্দ, খোঁজ করলে দেখা যাবে, এর বেশি মেধাসম্পন্ন শব্দচয়নের যোগ্যতা তাঁদের নেই। ছাত্ররাজনীতির অবক্ষয়ের যুগে তাঁদের অনেকে ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা-নেত্রী ছিলেন। ওই অঞ্চল থেকে যা চর্চা ও অর্জন করে এসেছেন, তার বাইরে যাবেন কেমন করে। আমাদের আশঙ্কা হয়, এসব রাজনৈতিক জ্ঞানবর্জিত অমার্জিত ছাত্র ও যুবরাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা তরুণ, ব্যবসায়ী আর আমলায় যখন সংসদ অধিবেশন কক্ষ আরো পূর্ণ হবে, তখন কী দশায় নিপতিত হব আমরা!
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা নামের ডিবেটিং ক্লাব থাকে। সুস্থ ধারার শিক্ষার্থীরা এসব ক্লাব মুখরিত করে। ছাত্র থাকতে বিতর্কচর্চায় যুক্ত ছিলাম বলে ওদের বিতর্ক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। আমি লক্ষ করছি, ইদানীং বিতর্কের ধারা পাল্টে গেছে। আগে আমরা বিষয়ভিত্তিক বিতর্ক করতাম। প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে থেকে দলগুলো বিতার্কিকের মেধায় শাণিত বক্তব্য উপস্থাপন করত। এখন ওরা আয়োজন করে সংসদীয় ধারার বিতর্ক। ওরা বিতর্কস্থলকে মিনি সংসদ বানায়। এখানে স্পিকার থাকেন। সরকারি দল, বিরোধী দল দুই পক্ষ থাকে। এরপর তরুণ বিতার্কিকরা সংসদীয় রীতি মেনে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। চৌকস শব্দ প্রয়োগ করে। কখনো হাস্যরোলেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু শালীনতা ক্ষুণ্ন হয় না। দেখে ভাবি, আহা, এমন যদি হতো আমাদের সংসদ। আয়োজকদের ডেকে বলি, আগের সনাতনী ধারার বদলে এমন ধারায় ফিরে এলে কেন? ওরা ওদের মতো করে জবাব দেয়। আমি বুঝি, যার যেখানে অপূর্ণতা, সেটাকেই পূর্ণ করতে চায়। এ দেশে সুদৃশ্য সংসদ ভবন থাকলেও শোভন সংসদীয় পরিবেশ নেই। এই স্বাপি্নক তরুণরা বোধ হয় এই সংকট মুছে দিতে চায়। আমি ওদের বলি, কী দরকার এই ধারার চর্চার। তোমরা যারা বিতর্ক চর্চা করো, তারা মেধাবী এবং মুক্তচিন্তার মানুষ। যে বলয়ে দেশ চলছে, তাতে তোমাদের সাংসদ হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কোনো দল নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য তোমাদের খুঁজে নেবে না। আর তোমাদের দেখে বিতর্ক শুনে নিজেদের আলোকিত করবে_তেমন সময় কোথায় ক্যাম্পাসের প্রভাবশালী ভবিষ্যৎ সাংসদদের। অতএব তোমাদের সব সাধনাই বৃথা যাবে। তার চেয়ে ফিরে যাও আগের বিষয়ভিত্তিক বিতর্কে। সংসদীয় ধারার বিতর্কের মতো ছকবন্দি হয়ে বিতর্ক করলে বরং মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মুক্ত বিতর্কে তোমরা নিজেদের মেলে ধরো। চৌকস হয়ে কর্মজীবনে বা যার যার অবস্থানে থেকে নিজ ও পরিবেশকে উজ্জ্বল করো।
সংসদ অধিবেশনে সাংসদদের মুখে অমার্জিত কথা শুনে ভাবনা হয়, কোন অন্ধকার থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা? তাঁরা তো জানেন, এসব খিস্তি লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনে শুনছে। সাংবাদিকদের কল্যাণে তথ্য মিডিয়া দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন কি বিব্রত হবেন না তাঁরা! নাকি প্রতিপক্ষকে একহাত নিতে পেরেছেন ভেবে সিনা টান করে হাঁটবেন।
ব্রিটিশ শাসনের একটি বিধি বোধ হয় ভালো ছিল। সরকারি চাকরি পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বংশপরিচয় খোঁজা হতো। আজ কোনো কোনো সাংসদের মুখনিঃসৃত যে অমিয় শব্দমালা শুনি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখি_তাতে মনে হয়, প্রার্থীর পারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত অতীত আচরণের সনদ বাধ্যতামূলকভাবে জমা দেওয়ার বিধি জুড়ে দিতে পারে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুর্বৃত্ত পরিবেশে অমন সনদে স্বাক্ষর করবেন কে!
তার পরও আমাদের চাওয়া এ দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসদে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও এর প্রধান নেতা-নেত্রীদেরই নিতে হবে। সুস্থ বিবেকবান মানুষ মাত্রই চাইবেন, সংসদ অধিবেশন হবে দায়িত্বশীল মানুষদের শোভন ও মার্জিত কথামালায় যুক্তি প্রয়োগ এবং খণ্ডনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি তৈরির জায়গা। সংসদীয় আচরণে চৌকস শব্দবাণে হাস্যরস তৈরি হবে; কিন্তু তা বিকৃত আর অশালীন বলে মনে হবে না। পক্ষ-বিপক্ষ সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। নানা প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি হবে; কিন্তু কূট-ঝগড়ায় কলুষিত হবে না পরিবেশ। অমন স্বপ্ন পূরণ করতে হলে অনেক বেশি সতর্ক ও সংযত আচরণ করতে হবে দলীয় নেতা-নেত্রীদের। তাঁরা যদি অহর্নিশ জনসভা থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ দলের নীতি, আদর্শ ও আচরণের সমালোচনার বদলে ঝগড়াটে ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে বিজয়ীর আনন্দ পান, তবে অনুগামীরা আর কতটা মার্জিত হবেন। ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ সংসদের এমন বিপন্ন দশার অবসান চায়। রাজনীতিকদের বোধোদয় ছাড়া তা কি সম্ভব?
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্র-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনকল্যাণে ব্রতী হয় শুধু দেশপ্রেমিক দল এবং ব্যক্তি। এ ধারার রাজনীতিকরা তাই আলোকিত পথে হাঁটেন। স্বচ্ছ রাজনীতির পথে হেঁটে গণমানুষের সমর্থন পাওয়াটাই বড় মনে করেন। আর নিকৃষ্ট রাজনীতির চর্চাকারী ব্যক্তি ও দল ব্যক্তিক এবং দলীয় লোভ অথবা স্থূল মেধা দ্বারা চালিত হয় বলে যেকোনোভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায় এবং নানাভাবে ক্ষমতায় থাকার পরিধি বাড়ানোর জন্য সাধনা করে। অবশ্য এই সাধনার পথে জনকল্যাণের আদর্শ বড় একটা জায়গা পায় না। এ ধারার রাজনীতিকদের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পায় অসংস্কৃত আচরণ।
আমাদের সৌভাগ্য, লুই কান একটি সুদৃশ্য সংসদ ভবন বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বারবার বিপন্ন হয়েছে এই ইমারতটি। দেশপ্রেমিক শোভন রাজনীতিক আইনপ্রণেতাদের পদভারে মুখরিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। এতটাই স্থূল মেধা আর অসংস্কৃতি বোধের অমার্জিত মানুষদের একটি অংশ এখন কূট-রাজনীতির পথ হেঁটে এখানে বসার অধিকারী হন যে সম্মান বাঁচাতে সুস্থ ধারার রাজনীতিক সাংসদরা লা-জবাব হয়ে যান। সংসদের চেহারা দেখলে আশঙ্কা হয়, প্রবীণ-প্রাজ্ঞ দায়িত্বশীল যে কজন সাংসদ অধিবেশন কক্ষের অন্ধকার সামান্য ফিকে করে এখনো আছেন, তাঁদের পরে সংসদ কেমন ভাগাড়ে পরিণত হবে! সংসদ ক্রমে খিস্তিখেউড়ের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। সংসদকে প্রাণবন্ত করতে বিপক্ষদলীয় সাংসদদের প্রতি কটাক্ষ করে শব্দবাণে জর্জরিত করা যায়, তবে তার মধ্যে থাকে মার্জিত রুচির পরিচয়। মেধাবী কৌতুক আমোদিতও করে। রাজনৈতিক মেধা ও মননশীলতা প্রকাশক তীক্ষ্ন শব্দবাণ সফল বিতার্কিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তেমন সাংসদকে। কিন্তু কী শুনি, আজকাল কোনো কোনো তরুণ সাংসদ এবং কখনো কখনো বয়সী অপ্রাজ্ঞ সাংসদদের বক্তব্যে? যে কারণে মাননীয় স্পিকারকে অনুরোধ জানাতে হয় কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল ভাষা পরিহার করার জন্য। মাঝেমধ্যে ভাবি, সংসদ অধিবেশন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার না করলে ভালো। অথবা আমাদের দেশে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের যে অভ্যাস হয়েছে, তা আইন করে পাকাপাকি করা যেতে পারে। জনগণের স্বস্তির বিনিময়ে এমন আইন পাস হোক যে ৯০ কার্যদিবস উপস্থিত না হলেও কেউ সদস্য পদ হারাবে না। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে সদস্য পদ বাঁচাতে সংসদে আসতে হবে না। সংসদে কোনো ভূমিকা না রেখেও আইনসম্মতভাবেই সাংসদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন সাংসদরা। এমন হলে সংসদে উপস্থিত সদস্যদের হাত একটাই থাকবে। ফলে কঠিন শব্দদূষণের তালি থেকে আমরা বেঁচে যাব। সংসদে এসেই অনেক তরুণ তুর্কি সাংসদ ভুলে যান তাঁদের মর্যাদার কথা। আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের কথা। অশালীন শব্দে ও ভঙ্গিতে বলতে থাকেন কার শাড়ির রং সাদা না গোলাপি, কে সাজুগুজু করতে পছন্দ করেন, কোন মন্ত্রী জেলে যাওয়ার সময় তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে কার কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, কার নিকটাত্মীয় বিদেশে খ্রিস্টান-ইহুদি বিয়ে করেছেন...। এমন সব অশ্রাব্য। স্রোতের শেওলা ধরার মতো অসহায় দর্শক-শ্রোতা আমরা অমন অবস্থায় ভাবি, হয়তো এখনই যাঁর যাঁর দলের বয়সী দায়িত্বশীল নেতারা এসব প্রগলভ অর্বাচীনদের থামিয়ে দিয়ে নিজেদের এবং সংসদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। কিন্তু না, তাঁরা টেবিল চাপড়িয়ে বরং উৎসাহী করেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কোনো কোনো সাংসদের মুখে পোকাধরা ধানের খৈ ফুটছে বেশি। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, সুপ্রিম নেতা-নেত্রীদের আস্থায় থাকতে হলে আমাদের তো এক কাঠি সরেস হতেই হবে।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে, আমাদের মতো অনাধুনিক মানুষদের। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে কারণে সব হিন্দি ছবি দেখতে পারি না_অশ্লীল দৃশ্যের কারণে চ্যানেল পরিবর্তন করতে হয়। তেমনি এখন সংসদ অধিবেশন টিভিতে দেখার সময় সতর্ক হয়ে রিমোট কন্ট্রোল হাতে রাখি। যদি বাড়ির উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরা এসব খিস্তি শিখে ফেলে।
ক্রমাগত এমন অধোগতি হচ্ছে কেন! লক্ষ করলে দেখা যাবে, দু-একজন সুপ্রিম নেতা-নেত্রীর কথা বাদ দিলে রাজনীতির ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা জ্যেষ্ঠ নেতাদের সংসদীয় বক্তব্য তথ্যবহুল এবং সংসদীয় ভাষাসমৃদ্ধ। খিস্তিখেউড় আওড়াতে যাঁদের পছন্দ, খোঁজ করলে দেখা যাবে, এর বেশি মেধাসম্পন্ন শব্দচয়নের যোগ্যতা তাঁদের নেই। ছাত্ররাজনীতির অবক্ষয়ের যুগে তাঁদের অনেকে ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা-নেত্রী ছিলেন। ওই অঞ্চল থেকে যা চর্চা ও অর্জন করে এসেছেন, তার বাইরে যাবেন কেমন করে। আমাদের আশঙ্কা হয়, এসব রাজনৈতিক জ্ঞানবর্জিত অমার্জিত ছাত্র ও যুবরাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা তরুণ, ব্যবসায়ী আর আমলায় যখন সংসদ অধিবেশন কক্ষ আরো পূর্ণ হবে, তখন কী দশায় নিপতিত হব আমরা!
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা নামের ডিবেটিং ক্লাব থাকে। সুস্থ ধারার শিক্ষার্থীরা এসব ক্লাব মুখরিত করে। ছাত্র থাকতে বিতর্কচর্চায় যুক্ত ছিলাম বলে ওদের বিতর্ক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। আমি লক্ষ করছি, ইদানীং বিতর্কের ধারা পাল্টে গেছে। আগে আমরা বিষয়ভিত্তিক বিতর্ক করতাম। প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে থেকে দলগুলো বিতার্কিকের মেধায় শাণিত বক্তব্য উপস্থাপন করত। এখন ওরা আয়োজন করে সংসদীয় ধারার বিতর্ক। ওরা বিতর্কস্থলকে মিনি সংসদ বানায়। এখানে স্পিকার থাকেন। সরকারি দল, বিরোধী দল দুই পক্ষ থাকে। এরপর তরুণ বিতার্কিকরা সংসদীয় রীতি মেনে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। চৌকস শব্দ প্রয়োগ করে। কখনো হাস্যরোলেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু শালীনতা ক্ষুণ্ন হয় না। দেখে ভাবি, আহা, এমন যদি হতো আমাদের সংসদ। আয়োজকদের ডেকে বলি, আগের সনাতনী ধারার বদলে এমন ধারায় ফিরে এলে কেন? ওরা ওদের মতো করে জবাব দেয়। আমি বুঝি, যার যেখানে অপূর্ণতা, সেটাকেই পূর্ণ করতে চায়। এ দেশে সুদৃশ্য সংসদ ভবন থাকলেও শোভন সংসদীয় পরিবেশ নেই। এই স্বাপি্নক তরুণরা বোধ হয় এই সংকট মুছে দিতে চায়। আমি ওদের বলি, কী দরকার এই ধারার চর্চার। তোমরা যারা বিতর্ক চর্চা করো, তারা মেধাবী এবং মুক্তচিন্তার মানুষ। যে বলয়ে দেশ চলছে, তাতে তোমাদের সাংসদ হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কোনো দল নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য তোমাদের খুঁজে নেবে না। আর তোমাদের দেখে বিতর্ক শুনে নিজেদের আলোকিত করবে_তেমন সময় কোথায় ক্যাম্পাসের প্রভাবশালী ভবিষ্যৎ সাংসদদের। অতএব তোমাদের সব সাধনাই বৃথা যাবে। তার চেয়ে ফিরে যাও আগের বিষয়ভিত্তিক বিতর্কে। সংসদীয় ধারার বিতর্কের মতো ছকবন্দি হয়ে বিতর্ক করলে বরং মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মুক্ত বিতর্কে তোমরা নিজেদের মেলে ধরো। চৌকস হয়ে কর্মজীবনে বা যার যার অবস্থানে থেকে নিজ ও পরিবেশকে উজ্জ্বল করো।
সংসদ অধিবেশনে সাংসদদের মুখে অমার্জিত কথা শুনে ভাবনা হয়, কোন অন্ধকার থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা? তাঁরা তো জানেন, এসব খিস্তি লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনে শুনছে। সাংবাদিকদের কল্যাণে তথ্য মিডিয়া দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন কি বিব্রত হবেন না তাঁরা! নাকি প্রতিপক্ষকে একহাত নিতে পেরেছেন ভেবে সিনা টান করে হাঁটবেন।
ব্রিটিশ শাসনের একটি বিধি বোধ হয় ভালো ছিল। সরকারি চাকরি পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বংশপরিচয় খোঁজা হতো। আজ কোনো কোনো সাংসদের মুখনিঃসৃত যে অমিয় শব্দমালা শুনি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখি_তাতে মনে হয়, প্রার্থীর পারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত অতীত আচরণের সনদ বাধ্যতামূলকভাবে জমা দেওয়ার বিধি জুড়ে দিতে পারে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুর্বৃত্ত পরিবেশে অমন সনদে স্বাক্ষর করবেন কে!
তার পরও আমাদের চাওয়া এ দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসদে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও এর প্রধান নেতা-নেত্রীদেরই নিতে হবে। সুস্থ বিবেকবান মানুষ মাত্রই চাইবেন, সংসদ অধিবেশন হবে দায়িত্বশীল মানুষদের শোভন ও মার্জিত কথামালায় যুক্তি প্রয়োগ এবং খণ্ডনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি তৈরির জায়গা। সংসদীয় আচরণে চৌকস শব্দবাণে হাস্যরস তৈরি হবে; কিন্তু তা বিকৃত আর অশালীন বলে মনে হবে না। পক্ষ-বিপক্ষ সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। নানা প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি হবে; কিন্তু কূট-ঝগড়ায় কলুষিত হবে না পরিবেশ। অমন স্বপ্ন পূরণ করতে হলে অনেক বেশি সতর্ক ও সংযত আচরণ করতে হবে দলীয় নেতা-নেত্রীদের। তাঁরা যদি অহর্নিশ জনসভা থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ দলের নীতি, আদর্শ ও আচরণের সমালোচনার বদলে ঝগড়াটে ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে বিজয়ীর আনন্দ পান, তবে অনুগামীরা আর কতটা মার্জিত হবেন। ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ সংসদের এমন বিপন্ন দশার অবসান চায়। রাজনীতিকদের বোধোদয় ছাড়া তা কি সম্ভব?
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments