দেশহীন মানুষের কথা-আমরা মর্মাহত, আমরা দুঃখিত by সঞ্জীব দ্রং

ধরে নিতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই, সরকার আন্তরিকভাবে আদিবাসীদের কিছু নাগরিক অধিকার দিতে চায়। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আদিবাসীদের মধ্যে যে চারজন মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন, তাঁরা ‘আদিবাসী’ শব্দটিই থাকুক চেয়েছিলেন। আমাকে মঙ্গলবার রাতে বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আদিবাসীরা ফোন করে
বলেছেন, ‘এত বছর এত পরিশ্রম করলেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য, এখন সরকার চাচ্ছে “ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এখন কী করবেন?’ আমি বললাম, ‘আমরা মর্মাহত এবং দুঃখিত। কী ভাষায় সরকারকে আমরা বোঝাতে পারব জানি না। সরকার নানাভাবে নানা সময়ে আদিবাসীদের কথা বলেছে। সরকারপ্রধানেরা গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছেন। আদিবাসী হিসেবে যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ ও ২০০৯ সালে, বেগম খালেদা জিয়া ২০০৩ সালে এবং ফখরুদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালে “আদিবাসী” হিসেবেই বাণী দিয়েছেন। এসবের কপি আমার কাছে আছে। এখন নতুন শিক্ষানীতি খুলে দেখেন, দেখবেন সেখানে আদিবাসী আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দিনবদলের সনদ দেখেন, সেখানে আদিবাসী আছে। গত আদিবাসী দিবসে আইনমন্ত্রী মহোদয়ের বাণী দেখেন, সেখানেও আদিবাসী। আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে আছেন শ্রদ্ধেয় রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু। কয়েক দিন আগেও তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁরা আদিবাসীদের আন্দোলনে পরম বন্ধু এবং সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির সদস্য। আমাদের একটি অনুষ্ঠানে আমরা এই কমিটির মাননীয় কো-চেয়ারম্যান শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, তিনিও আদিবাসীদের “আদিবাসী”ই বলেছিলেন। তাহলে কেন আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে এখন স্বীকৃতির প্রশ্ন আসছে?’
প্রথম আলো প্রেস ব্রিফিংয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৬ মার্চ রিপোর্ট করেছে, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী “আদিবাসী” নাকি “উপজাতি”, এটি একটি বড় ইস্যু। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় আমরা তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তাই কমিটি এবার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংবিধানিকভাবে “আদিবাসী” বা “উপজাতি” হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না, কমিটি এদের “ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করবে।’
আমার মনে হয়, কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে। আদিবাসী শব্দের অর্থ নিয়ে অন্য রকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আদিবাসী অর্থ তো কে কোথায় প্রথম আবির্ভূত হলো বা বসতি গড়ে তুলল, তা নয়। আদিবাসী বলা হলে অন্যরা অ-আদিবাসী বা বহিরাগত হয়ে যাবে, তা তো নয়। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে ঐতিহাসিক কারণে এই আদিবাসীরা বঞ্চিত ও শোষিত। আমাদের দেশেও আদিবাসী মানেই নিজ বাসভূমে পরবাসী একশ্রেণীর অসহায় মানুষ, যাদের জায়গা-জমি, পাহাড়-বন, আবাসস্থল শক্তির জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যাদের একসময় ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল, এখন বিপন্ন। এই-ই তো বৈশিষ্ট্য আদিবাসীদের, যাকে কোনো সংজ্ঞায় ফেলা সমীচীন হবে না।
জাতিসংঘ আদিবাসী বা ইনডিজিনাস পিপলস শব্দের কোনো সংজ্ঞা দেয়নি, কারণ আদিবাসীরা আন্তর্জাতিকভাবে এটি চায়নি। এর মূল কারণ হলো, আত্মপরিচয়ের অধিকার। কে কার পরিচিতি নির্ধারণ করে দেবে, কেনই বা দেবে? আপনি কাঁঠালকে জাম বললে তো হবে না, অথবা আপনি গায়ের জোরে দিনকে রাত্রি তো বলতে পারেন না। কিছু শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে তো পৃথিবী ও সমাজ পথ চলে। সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘জাতিগত ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি ছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, রীতি, ঐতিহ্য, শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হবে।
আমি অনুরোধ করব, কমিটি আদিবাসী হিসেবেই সুপারিশ করুক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে নয়। এ বিষয়ে আগে প্রথম আলোয় অনেকে লিখেছেন, যেমন—বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, রাজা দেবাশীষ রায়, ড. সাদেকা হালিম, অধ্যাপক এইচ কে এস আরেফিন, জোবাইদা নাসরীন প্রমুখ। আমি যত দূর জানি, অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত আদিবাসীদের ভূমিসহ নানা কাজে যুক্ত। তাঁদের সবার মতামত নেওয়ার জন্য আমি কমিটিকে অনুরোধ করছি। আমাকে এবং অধ্যাপক মেসবাহ কামালকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কিছু পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে। সেই সভার মিনিটস আমার কাছে আছে। সেখানেও সবাই আদিবাসীই বলেছেন। ২০০৯ সালের আদিবাসী দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, ‘আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চিরায়ত জ্ঞান, নৃত্য-গীত, সাহিত্য, জীবনের মূল্যবোধ পৃথিবীর জন্য অমূল্য সম্পদ। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহ্যগত জ্ঞান। সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধপরিকর এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নেও আমরা একযোগে কাজ করতে চাই।’
আমি সরকারকে অনুরোধ করব, কমপক্ষে ৪৬টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের হূৎস্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করুন, দেখবেন কেউ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দটিকে মন থেকে গ্রহণ করবে না। ক্ষমতায় থেকে আপনারা কেন মানুষগুলোকে এই দুঃখ দেবেন?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও মানবাধিকারকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.