লিবিয়া-পশ্চিমা হস্তক্ষেপের পরিণাম ভালো হবে না by আবদেল আল-বারি আতওয়ান
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল স্বস্তির। নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদনকে লিবীয় বিদ্রোহীদের রক্ষা এবং তাদের দুর্দশা লাঘবের প্রচেষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। একে কে না স্বাগত জানাবে? বিরোধীদের অস্তিত্ব ‘মুছে ফেলার’ জন্য কারও বল প্রয়োগের ইচ্ছা কে না দমাতে চায়? কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে গুরুতর সংশয়ও রাখা উচিত।
প্রথমত, এই হস্তক্ষেপের পেছনে মতলবটা কী? জাতিসংঘ যখন লিবিয়ায় ‘নো ফ্লাই জোন’ আরোপ করতে ভোটাভুটি করছে, তখন তো পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে মার্কিন মানববিহীন বিমান হামলায় অন্তত ৪০ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেল। যখন আমি এ লেখাটি লিখছি, তখন আল-জাজিরা টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল ইয়েমেনের রাজধানী সানায় নৃশংসতার দৃশ্য। সেই নৃশংসতায় ৪০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। পাকিস্তানি বেসামরিক মানুষকে মার্কিন হামলা থেকে বাঁচাতে কিংবা ইয়েমেনিদের জন্য কোনো ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করা হবে না। এভাবে বেছে বেছে তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ গণজাগরণে পশ্চিমাদের জড়িয়ে যাওয়াকে তাই প্রশ্ন না করে উপায় নেই।
এ কথা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রিয়া করতে অনিচ্ছা দেখাচ্ছিল আর অবশেষে কয়েক সপ্তাহের সিদ্ধান্তহীনতা কাটিয়ে উঠল। এই অঞ্চলে আরেকটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তাতে মার্কিনরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপকারী হিসেবে গণ্য হবে—এই বিবেচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে শুরুতে জড়াতে অনিচ্ছুক ওবামা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আরব ও মুসলমান দেশগুলোর সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন। শুরুতে লক্ষণ ভালো ছিল—গত সপ্তাহে আরব লিগ তাঁর তৎপরতাকে সমর্থন করেছিল এবং মনে হয়েছিল পাঁচটি সদস্যরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সেই সংখ্যা কমে গিয়ে শুধু কাতার ও আরব আমিরাতে দাঁড়াল—সম্ভাব্য তৃতীয় অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র হিসেবে রইল জর্ডান। এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিতে পর্যন্ত আরব সমর্থনের ঘাটতি রয়ে গেছে।
সামরিক তৎপরতার জন্য যে ব্যয় হবে, তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন নিজেদের অর্থনীতির দুরবস্থার কারণে। জাতিসংঘে লিবীয় রাষ্ট্রদূত আবদেল রহমান হালকেম আমাকে বলেছেন, এই সামরিক অভিযানের বেশির ভাগ খরচ বহন করতে কাতার ও আরব আমিরাত রাজি হয়েছে। এসব স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতলবটা কী—লিবীয় নাগরিকদের রক্ষা, গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আক্রোশ, নাকি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো?
এ জায়গায় এসে যাচ্ছে দ্বিতীয় সমস্যাটি—এই হস্তক্ষেপে প্রধান খিলাড়ি পশ্চিমারা, নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আর যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। লিবিয়ার প্রতিবেশী মিসর ও তিউনিসিয়া যদি মুখ্য ভূমিকা রাখত, তবে তা খুবই সুখকর হতো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রতিবেশীদের সহায়তা করছে, এমন ঘটলে তা আরব গণজাগরণের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতো। এতে এমন ধারণাও জোরালো হতো যে, আরববাসী নিজেদের ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ নিজেরাই নিতে পারে। তা ঘটাও সম্ভবপর ছিল। প্রতিবছর মিসর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সামরিক সাহায্য পায়। হিলারি ক্লিনটনের কূটনৈতিক চাপ হয়তো ক্ষমতাধর যুদ্ধ ঘোড়াকে ময়দানে নিয়ে আসতে পারত, নতুবা অন্তত বিদ্রোহীদের অস্ত্রসজ্জিত করে তুলতে মিসরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। কিন্তু গত বুধবার মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘কোনো হস্তক্ষেপ না’।
তৃতীয় সমস্যাটি হলো, যদিও গাদ্দাফিকে প্রায়ই উন্মাদ বলে বাতিল করা হয়, তবু তিনি আসলে চৌকস রণকৌশলী। এই হস্তক্ষেপের রশি তাঁরই হাতে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দ্রুতই তিনি অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করলেন। অনেকে একে জাতিসংঘ প্রস্তাবের প্রাথমিক বিজয় বলে দাবি করেছেন। আসলে, এর দ্বারা একই সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গাদ্দাফিকে যুক্তিসংগত মনে হয়। এই মুহূর্তে অস্ত্রবিরতি গাদ্দাফির জন্য ভালোই হবে: এর আড়ালে গুপ্ত পুলিশ কাজে নেমে পড়তে পারবে। একইভাবে গাদ্দাফি আগের অস্ত্র-অবরোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন; দৃশ্যত এই ছাড়ও তাঁর পক্ষেই যায়। গাদ্দাফির বাহিনীর রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র; কিন্তু বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্রপাতি রয়েছে অল্পই।
গাদ্দাফি জানেন, আরবের রাস্তায় কীভাবে খেলতে হয়। এ মুহূর্তে তাঁর জনসমর্থন নেই বললেই চলে; নিজের পরিবার ও গোত্রের মধ্যেই তাঁর যেটুকু প্রভাব। কিন্তু বাইরের এই হস্তক্ষেপকে তিনি ব্যবহার করতে পারেন তেলপিপাসু উত্তর-ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার কাজে। আরব বিশ্বের আকাশে-বাতাসে যে প্রশ্নটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তিনি সেই প্রশ্নটিই তুলতে পারেন: ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলিরা যখন গাজায় বোমা ফেলছিল, তখন কেন গাজার ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়নি?
তিউনিসিয়ায় বা মিসরে যা হয়নি, লিবিয়ায় তা-ই হয়েছে: অভ্যুত্থান খুব তাড়াতাড়ি সশস্ত্র সংঘাতে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফি প্রশ্ন তুলতে পারেন, জাতিসংঘ যাদের সুরক্ষা দিতে চাইছে, তাদের ‘সিভিলিয়ান’ বলা যায় কি না, কারণ তারা তো যুদ্ধে লিপ্ত। গাদ্দাফি বরং বলতে পারেন যে, পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একটি পক্ষ নিচ্ছে (যেখানে বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অজানা)।
লিবিয়ায় এবং বিশ্বে এই হস্তক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবে? এটা আরেকটা দুশ্চিন্তার বিষয়। লিবিয়া বিভক্ত হয়ে যেতে পারে: পূর্ব অংশ বিদ্রোহীদের হাতে, আর দেশটির অবশিষ্ট অংশ থাকবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তেলক্ষেত্রগুলো ও আল-বেগরা শহরের অয়েল টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতেই। আরও একটি সম্ভাবনা প্রবল: ইরাক, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনের পর লিবিয়া হতে পারে ওই অঞ্চলের চতুর্থ ব্যর্থ রাষ্ট্র। তা যদি হয় তবে আরেকটা বিপর্যয়ের শঙ্কা বাড়ে। এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আল-কায়েদার তৎপরতা বাড়ে। ইরাক ও আফগানিস্তানের বিদ্রোহে আল-কায়েদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন তাদের ঘাঁটি ইয়েমেনে। তারা এখন লিবিয়ায়ও ঢুকে পড়তে পারে। ওসামা বিন লাদেনের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী লিবীয়। আর গাদ্দাফি তো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর কাছে অচেনা কেউ নন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আবু নিদাল গোষ্ঠী নিজেদের জন্য এক অভয়ারণ্য হিসেবে খুঁজে পেয়েছিল লিবিয়াকেই। আর গাদ্দাফি এমন হুমকিও দিয়েছেন যে তিনি যাত্রীবাহী বিমান ও ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবেন।
পঞ্চমত, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেই গাদ্দাফির পতন ঘটবে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ইরাকের উত্তরাংশের কুর্দি, দক্ষিণাংশের শিয়া জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য ইরাকের ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেছিল। তার পরও ১১ বছর ধরে সাদ্দাম ক্ষমতায় ছিলেন। একটি আগ্রাসনের পরই কেবল তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। এ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। এই রকমের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন লিবিয়ায়ও না ঘটে, তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
শেষ কথা হলো, লিবিয়ার ঘটনাবলি আরবের বসন্তকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। জনতার অভ্যুত্থান ও তার সহিংস দমনের ফল দাঁড়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ, তাহলে আরব বিশ্বের অবশিষ্ট স্বৈরশাসকদের দীর্ঘ নিপীড়িত প্রজারা হয়তো বিদ্যমান অবস্থাকেই শ্রেয় মনে করতে বাধ্য হবে।
যা-ই ঘটুক না কেন, লিবিয়ার জনগণ এখন দীর্ঘমেয়াদি সহিংস উত্থান-পতনের মুখোমুখি। কিন্তু তারা যে গণতান্ত্রিক স্বপ্ন দেখে, শেষ পর্যন্ত তা অর্জনে সক্ষম হবে শুধু নিজেদের অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
আবদেল আল-বারি আতওয়ান: লন্ডনভিত্তিক আল-কুদস আল-আরাবি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।
এ কথা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রিয়া করতে অনিচ্ছা দেখাচ্ছিল আর অবশেষে কয়েক সপ্তাহের সিদ্ধান্তহীনতা কাটিয়ে উঠল। এই অঞ্চলে আরেকটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তাতে মার্কিনরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপকারী হিসেবে গণ্য হবে—এই বিবেচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে শুরুতে জড়াতে অনিচ্ছুক ওবামা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আরব ও মুসলমান দেশগুলোর সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন। শুরুতে লক্ষণ ভালো ছিল—গত সপ্তাহে আরব লিগ তাঁর তৎপরতাকে সমর্থন করেছিল এবং মনে হয়েছিল পাঁচটি সদস্যরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সেই সংখ্যা কমে গিয়ে শুধু কাতার ও আরব আমিরাতে দাঁড়াল—সম্ভাব্য তৃতীয় অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র হিসেবে রইল জর্ডান। এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিতে পর্যন্ত আরব সমর্থনের ঘাটতি রয়ে গেছে।
সামরিক তৎপরতার জন্য যে ব্যয় হবে, তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন নিজেদের অর্থনীতির দুরবস্থার কারণে। জাতিসংঘে লিবীয় রাষ্ট্রদূত আবদেল রহমান হালকেম আমাকে বলেছেন, এই সামরিক অভিযানের বেশির ভাগ খরচ বহন করতে কাতার ও আরব আমিরাত রাজি হয়েছে। এসব স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতলবটা কী—লিবীয় নাগরিকদের রক্ষা, গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আক্রোশ, নাকি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো?
এ জায়গায় এসে যাচ্ছে দ্বিতীয় সমস্যাটি—এই হস্তক্ষেপে প্রধান খিলাড়ি পশ্চিমারা, নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আর যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। লিবিয়ার প্রতিবেশী মিসর ও তিউনিসিয়া যদি মুখ্য ভূমিকা রাখত, তবে তা খুবই সুখকর হতো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রতিবেশীদের সহায়তা করছে, এমন ঘটলে তা আরব গণজাগরণের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতো। এতে এমন ধারণাও জোরালো হতো যে, আরববাসী নিজেদের ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ নিজেরাই নিতে পারে। তা ঘটাও সম্ভবপর ছিল। প্রতিবছর মিসর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সামরিক সাহায্য পায়। হিলারি ক্লিনটনের কূটনৈতিক চাপ হয়তো ক্ষমতাধর যুদ্ধ ঘোড়াকে ময়দানে নিয়ে আসতে পারত, নতুবা অন্তত বিদ্রোহীদের অস্ত্রসজ্জিত করে তুলতে মিসরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। কিন্তু গত বুধবার মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘কোনো হস্তক্ষেপ না’।
তৃতীয় সমস্যাটি হলো, যদিও গাদ্দাফিকে প্রায়ই উন্মাদ বলে বাতিল করা হয়, তবু তিনি আসলে চৌকস রণকৌশলী। এই হস্তক্ষেপের রশি তাঁরই হাতে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দ্রুতই তিনি অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করলেন। অনেকে একে জাতিসংঘ প্রস্তাবের প্রাথমিক বিজয় বলে দাবি করেছেন। আসলে, এর দ্বারা একই সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গাদ্দাফিকে যুক্তিসংগত মনে হয়। এই মুহূর্তে অস্ত্রবিরতি গাদ্দাফির জন্য ভালোই হবে: এর আড়ালে গুপ্ত পুলিশ কাজে নেমে পড়তে পারবে। একইভাবে গাদ্দাফি আগের অস্ত্র-অবরোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন; দৃশ্যত এই ছাড়ও তাঁর পক্ষেই যায়। গাদ্দাফির বাহিনীর রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র; কিন্তু বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্রপাতি রয়েছে অল্পই।
গাদ্দাফি জানেন, আরবের রাস্তায় কীভাবে খেলতে হয়। এ মুহূর্তে তাঁর জনসমর্থন নেই বললেই চলে; নিজের পরিবার ও গোত্রের মধ্যেই তাঁর যেটুকু প্রভাব। কিন্তু বাইরের এই হস্তক্ষেপকে তিনি ব্যবহার করতে পারেন তেলপিপাসু উত্তর-ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার কাজে। আরব বিশ্বের আকাশে-বাতাসে যে প্রশ্নটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তিনি সেই প্রশ্নটিই তুলতে পারেন: ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলিরা যখন গাজায় বোমা ফেলছিল, তখন কেন গাজার ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়নি?
তিউনিসিয়ায় বা মিসরে যা হয়নি, লিবিয়ায় তা-ই হয়েছে: অভ্যুত্থান খুব তাড়াতাড়ি সশস্ত্র সংঘাতে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফি প্রশ্ন তুলতে পারেন, জাতিসংঘ যাদের সুরক্ষা দিতে চাইছে, তাদের ‘সিভিলিয়ান’ বলা যায় কি না, কারণ তারা তো যুদ্ধে লিপ্ত। গাদ্দাফি বরং বলতে পারেন যে, পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একটি পক্ষ নিচ্ছে (যেখানে বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অজানা)।
লিবিয়ায় এবং বিশ্বে এই হস্তক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবে? এটা আরেকটা দুশ্চিন্তার বিষয়। লিবিয়া বিভক্ত হয়ে যেতে পারে: পূর্ব অংশ বিদ্রোহীদের হাতে, আর দেশটির অবশিষ্ট অংশ থাকবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তেলক্ষেত্রগুলো ও আল-বেগরা শহরের অয়েল টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতেই। আরও একটি সম্ভাবনা প্রবল: ইরাক, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনের পর লিবিয়া হতে পারে ওই অঞ্চলের চতুর্থ ব্যর্থ রাষ্ট্র। তা যদি হয় তবে আরেকটা বিপর্যয়ের শঙ্কা বাড়ে। এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আল-কায়েদার তৎপরতা বাড়ে। ইরাক ও আফগানিস্তানের বিদ্রোহে আল-কায়েদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন তাদের ঘাঁটি ইয়েমেনে। তারা এখন লিবিয়ায়ও ঢুকে পড়তে পারে। ওসামা বিন লাদেনের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী লিবীয়। আর গাদ্দাফি তো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর কাছে অচেনা কেউ নন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আবু নিদাল গোষ্ঠী নিজেদের জন্য এক অভয়ারণ্য হিসেবে খুঁজে পেয়েছিল লিবিয়াকেই। আর গাদ্দাফি এমন হুমকিও দিয়েছেন যে তিনি যাত্রীবাহী বিমান ও ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবেন।
পঞ্চমত, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেই গাদ্দাফির পতন ঘটবে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ইরাকের উত্তরাংশের কুর্দি, দক্ষিণাংশের শিয়া জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য ইরাকের ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেছিল। তার পরও ১১ বছর ধরে সাদ্দাম ক্ষমতায় ছিলেন। একটি আগ্রাসনের পরই কেবল তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। এ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। এই রকমের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন লিবিয়ায়ও না ঘটে, তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
শেষ কথা হলো, লিবিয়ার ঘটনাবলি আরবের বসন্তকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। জনতার অভ্যুত্থান ও তার সহিংস দমনের ফল দাঁড়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ, তাহলে আরব বিশ্বের অবশিষ্ট স্বৈরশাসকদের দীর্ঘ নিপীড়িত প্রজারা হয়তো বিদ্যমান অবস্থাকেই শ্রেয় মনে করতে বাধ্য হবে।
যা-ই ঘটুক না কেন, লিবিয়ার জনগণ এখন দীর্ঘমেয়াদি সহিংস উত্থান-পতনের মুখোমুখি। কিন্তু তারা যে গণতান্ত্রিক স্বপ্ন দেখে, শেষ পর্যন্ত তা অর্জনে সক্ষম হবে শুধু নিজেদের অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
আবদেল আল-বারি আতওয়ান: লন্ডনভিত্তিক আল-কুদস আল-আরাবি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।
No comments