চীনকে ঘিরে ফেলতে চার দেশের প্রস্তুতি!
প্রশান্ত
ও ভারত মহাসাগরে চীনকে ঘিরতে ‘পাল্টা’ বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচি নিচ্ছে
চার দেশ। অস্ট্রেলিয়ান ফিনানশিয়াল রিভিউ-এর এক প্রতিবেদনে সোমবার এই খবর
প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারত, জাপান, আমেরিকা ও
অস্ট্রেলিয়া এই ‘পাল্টা’ বেল্ট অ্যান্ড রোড গড়তে হাত মেলাচ্ছে। আমেরিকা ও
জাপানের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়ান
ফিনানশিয়াল রিভিউ। তবে যে মার্কিন প্রশাসনিক কর্তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার
নাম প্রকাশ করা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল চলতি
সপ্তাহের শেষের দিকে আমেরিকা সফরে যাচ্ছেন। সেই সফরে ট্রাম্প ও টার্নবুলের
মধ্যে যে বৈঠক হবে, তার আলোচ্যসূচিতে ‘পাল্টা’ বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচির
বিষয়টি রয়েছে বলে মার্কিন প্রশাসনিক কর্তা অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রটিকে
জানিয়েছেন। কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটা এখনো এতটাই প্রাথমিক স্তরে যে
টার্নবুলের এই আমেরিকা সফরে চার দেশের যৌথ উদ্যোগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে
ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে ওই মার্কিন কর্মকর্তার মত। বেল্ট অ্যান্ড রোড
উদ্যোগ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের স্বপ্নের উদ্যোগ। চীনের ‘ওয়ান
বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতির প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট শি নিজেই। সেই নীতির রূপায়ণেই
বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিং। সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে
আন্তর্জাতিক পরিবহণ নেটওয়ার্ক তৈরির প্রস্তাব রেখেছে চীন। এশিয়া ও আফ্রিকার
অনেকগুলো দেশ চীনের সে উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে। সাড়া মিলেছে পৃথিবীর
অন্যান্য অংশ থেকেও। ভারত কিন্তু বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সাড়া দেয়নি।
দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই উদ্যোগের সাফল্যের জন্য যে ভারতের
অংশীদারিত্ব অপরিহার্য, তা চীন জানে। তাই নানাভাবে নয়াদিল্লিকে রাজি করানোর
চেষ্টা করেছে বেইজিং। কিন্তু বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের সবচেয়ে বড়
বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি), তা
পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে যাওয়ায় ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ ভারতের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করছে বলে
নয়াদিল্লি জানিয়েছে। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ারও নানা প্রশ্ন রয়েছে
চীনের এই উদ্যোগ সম্পর্কে। আন্তর্জাতিক পরিবহণ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং
অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নই যদি লক্ষ্য হয়, তা
হলে বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে চীনের প্রভুত্ব কেন থাকবে? প্রশ্ন উঠেছে বেশ
কয়েকটি দেশ থেকেই। যে দেশগুলো এই উদ্যোগে সামিল হবে, তাদের প্রত্যেকের
অংশীদারিত্বই সমপরিমাণ হওয়া উচিত বলে সেই দেশগুলোর মত। কিন্তু এ প্রসঙ্গে
চীনের কাছে খুব স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ বলছে, চীন
আসলে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। আমেরিকা যে রকম বিশ্বের প্রায়
সব প্রান্তে প্রভাবশালী, বেল্ট অ্যান্ড রোডের মাধ্যমে চীনও তেমনই
প্রভাবশালী হয়ে উঠতে চায়। কূটনৈতিক শিবিরের এই ব্যাখ্যাকে যথেষ্ট গুরুত্ব
দিয়ে দেখছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। চীনের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, বেল্ট
অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যত বেশি দেশ সামিল হবে, পৃথিবীর মানচিত্রে চীনের
পদচিহ্ন ততই গাঢ় হবে, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেল্ট
অ্যান্ড রোডের বাড়বাড়ন্ত রুখতে চায় আমেরিকা। রুখতে চায়
ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়াও, কারণ ভারত মহাসাগর এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে
একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা চীন শুরু করেছে, তা এই তিন দেশের
স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছে।
তাই আমেরিকা-জাপান-ভারত-অস্ট্রেলিয়া যৌথ উদ্যোগে
‘পাল্টা’ বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জল্পনা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। এই
রকম এক উদ্যোগ নিয়ে যে আলোচনা চলছে, জাপানের তরফে কিন্তু তা প্রকারান্তরে
স্বীকার করা হয়েছে। জাপানের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি য়োশিহিদে সুগা
জানিয়েছেন, জাপান-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান-ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে
নিজেদের যৌথ স্বার্থ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চলে। চার দেশ যদি যৌথ উদ্যোগে কোনও
নেটওয়ার্ক তৈরি করে, তা হলে সে উদ্যোগকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড-এর
‘পাল্টা’ হিসেবে না দেখাই ভালো বলে সুগা মন্তব্য করেছেন। যে মার্কিন
কর্মকর্তাকে অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রটি উদ্ধৃত করেছে, সেই মার্কিন কর্মকর্তাও
বলেছেন যে, ভারত-জাপান-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার এই উদ্যোগকে বেল্ট অ্যান্ড
রোড-এর ‘পাল্টা’ না বলে তার ‘বিকল্প’ বলাই ভালো। জাপান নিজেও কিন্তু
প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত সমুদ্রভাগে মিত্র
দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলতে চাইছে। জাপানের ‘অফিশিয়াল
ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স’-এর (ওডিএ) আওতায় বৃহত্তর ‘স্বাধীন ও মুক্ত
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’কে রূপায়িত করতে চাইছে জাপান। পরিবহণ ও যোগাযোগ তথা
বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলার রূপরেখা রয়েছে এই কৌশলে।
২০১৭ সালে জাপান যে ওডিএ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র তৈরি করেছিল, তাতেই এ কথা
রয়েছে বলে খবর। ভারত মহাসাগর এবং এশিয়া প্যাসিফিকে মিত্র দেশগুলোর মধ্যে
সহযোগিতা বৃদ্ধির এই জাপানি উদ্যোগে আমেরিকারও অনুমোদন রয়েছে।
No comments