তারিক রামাদানের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে মিথ্যা অভিযোগ, প্রহসনের বিচার
বিশ্বখ্যাত
মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক রামাদানের
বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে
ফ্রান্সের লিয়েনের হোটেলে এক দুপুরে একজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিন্তু লন্ডন থেকে রামাদানকে বহনকারী বিমান ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটের
আগে লিয়নে পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ফরাসি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা
দিয়েছিলেন রামাদান। কিন্তু সেই নথি মামলার ফাইল থেকে হারিয়ে গেছে বলে
জানিয়েছে ফরাসি পুলিশ। এর পর রামাদান নিজে ফরাসি পুলিশের কাছে মামলার বিষয়ে
সহযোগিতা করে আসছিলেন। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা যথাযথভাবে তদন্ত না করেই
তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর পর ফরাসি আইন লঙ্ঘন করে তাকে নির্জন কারাবাস
দেয়া হয়েছে। সেখানে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর রামাদানকে হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়। তা সত্ত্বেও তাকে জামিন দেয়া হয়নি। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে-
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন ইসলাম শিক্ষা বিভাগের এ অধ্যাপক তার
মুসলিম পরিচয়ের কারণে ফরাসি কর্তৃপক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন কিনা।
ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর এ জাস্ট ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট ড. চন্দ্র
মুজাফফর এক লেখায় অভিযোগ করেছেন, অধ্যাপক তারিক রামাদান ফ্রান্সে প্রহসনের
বিচারের শিকার হচ্ছেন। মুজাফফেরের লেখাটি তুলে ধরা হল- ‘তারিক রামাদান ২
ফেব্রুয়ারি থেকে প্যারিসের ফ্লুরি-মেরোগিস কারাগারের অতিরিক্ত
নিরাপত্তাসংবলিত একটি শাখার নির্জন কক্ষে আটক আছেন।’ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ,
২০০৯ সালে ফ্রান্সের লিয়নে ও ২০১২ সালে প্যারিসে দুই নারী তার হাতে ধর্ষণের
শিকার হয়েছেন। মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে একটি অপরাধ তদন্ত হয়েছে।
আটক রামাদানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি
ফোনেও তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। তারিক রামাদানের
বিরুদ্ধে দুই নারীর অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ জন্যই
৩১ জানুয়ারি তিনি স্বেচ্ছায় প্যারিসে পুলিশের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার জবাব দিতেই তিনি সেদিন
পুলিশের কাছে যান। নিজের অভিযোগের তদন্তে কর্তৃপক্ষকে তিনি পূর্ণ সহযোগিতা
করেছেন। এর পরও তাকে বিচারবহির্ভূত নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হচ্ছে। কারাগারে
তার প্রতি বিদ্রূপাত্মক ও অবমাননাকর মন্তব্য ছোড়া হচ্ছে। লিয়নের ঘটনায় ওই
নারী বলেন, ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর দুপুরে একটি হোটেল কক্ষে তিনি রামাদানের
ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু লন্ডন থেকে রামাদানকে বহনকারী বিমান সন্ধ্যা ৬টা
৩৫ মিনিটের আগে লিয়নে পৌঁছায়নি। এর পর কয়েকশ দর্শকের সামনে বক্তৃতা দিতে
তিনি রাত ৮টা ৩০ মিনিটে হলরুমে যান। তারিক রামাদানের আইনজীবী এসব
তথ্যপ্রমাণ ফরাসি পুলিশকে দিয়েছেন। পুলিশও তা গ্রহণ করার কথা স্বীকার
করেছে। কিন্তু পরে তারা বলেছে- তথ্যপ্রমাণগুলো হারিয়ে গেছে। তাই মামলার
নথিতে সেগুলো রাখা হয়নি। বিচারের ক্ষেত্রে এর চেয়ে প্রহসন আর কি হতে পারে!
২০০৯ সালে ফ্রান্সের জ্যেষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেট মাইকেল ডেবাকের সঙ্গে অভিযুক্ত
নারীর বৈঠক এ মামলা নিয়ে সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। অধ্যাপক রামাদানের বিরুদ্ধে
সাজানো মামলা করতেই ওই বৈঠক হয়েছিল। ইসলামবিদ্বেষী ক্যারোলাইন ফৌরেস্ট ও
অ্যান্টোইন স্ফিয়ার এ মামলায় সহায়তা করেন। ৯ বছর আগে বিচারক ডেবাক অধ্যাপক
রামাদানের বিরুদ্ধে মামলা করতে ফৌরেস্ট ও অভিযোগকারী নারী ক্রিস্টেলির
সঙ্গে আঁতাত করেছেন। বর্তমানে ক্যাশেইশন আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব
পালন করছেন ডেবাক। ধর্ষণের অভিযোগকারী ক্রিস্টেলি কিংবা চলমান মামলার সঙ্গে
নিজের যোগসাজশের কথা প্রকাশ করেননি বিচারক ডেবাক। ফরাসি আইন অনুসারে যা
একেবারে অবৈধ। প্যারিসের ঘটনা ২০১২ সালে ঘটেছে বলে মামলার অভিযোগে বলা
হয়েছে। কিন্তু তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী যা বলছেন, তার সত্যতা নিয়ে
সন্দেহ রয়েছে। এ ঘটনায় অভিযোগকারী হিন্দা আয়ারি ২০১৪ সালের জুন থেকে আগস্ট
পর্যন্ত ফেসবুকের মাধ্যমে অধ্যাপক রামাদানকে ২৮০টির বেশি বার্তা পাঠাননি।
সম্প্রতি আয়ারি ফরাসি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, ফেসবুকে তিনি
রামাদানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনলে রামাদান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট
ব্লক করে দেন।
এর পর দ্বিতীয় আরেকটি অ্যাকাউন্ট খুলে তিনি অক্সফোর্ড
অধ্যাপককে বার্তা পাঠান। আয়ারির আশা ছিল, এতে করে তিনি রামাদানকে প্রলুব্ধ
করে ফাঁদে ফেলতে পারবেন। এ কারণেই গত সপ্তাহে পুলিশ আয়ারির বিরুদ্ধে সমন
জারি করলে তাতে তিনি হাজির হননি। অধ্যাপক রামাদানের বিরুদ্ধে ওই দুই নারীর
অভিযোগ পুরো দস্তুর ভিত্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও আদালতে নিতে তাকে আটক করে
রেখেছে পুলিশ। ফ্রান্সের মূলধারার গণমাধ্যম পুলিশের এ অপকর্মে সহায়তা করছে।
হাস্যকর অভিযোগকে কেবল ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেই না, তারা অধ্যাপক
রামাদানের বিরুদ্ধে বারবার একই মিথ্যা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। তাকে অমর্যাদা ও
অসম্মান করতেই এমনটি করা হচ্ছে। কিছু গণমাধ্যম প্রতিবেদন ছেপেছে, অধ্যাপক
রামাদানের মিসরীয় পাসপোর্ট আছে। তিনি মিসরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে ওই
পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু রামাদানের কাছে কোনো মিসরীয় পাসপোর্ট
নেই। তিনি কেবল সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। ফরাসি গণমাধ্যম তারিক রামাদানের
চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি তার প্রতি দেশটির আইন
আদালতের অবজ্ঞাপূর্ণ ও তির্যক আচরণ এ বিচারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা
বলে মনে করা হচ্ছে। ইউরোপে ইসলাম ও এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যে
পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ সমালোচনা করলে ফরাসি সমাজের
প্রভাবশালীরা সহ্য করতে পারেন না। তারা তখন অসহনশীল হয়ে ওঠেন। কিংবা
ইতিবাচকভাবে নিতে পারেন না। অধ্যাপক তারিক রামাদান একই আচরণের শিকার
হয়েছেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতির কড়া
সমালোচকদের একজন হলেন রামাদান। সামগ্রিকভাবে ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষ ও
দারিদ্র্য অসহায়দের প্রান্তিকীকরণকে মহাদেশটির দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ হিসেবে
বিবেচনা করা হচ্ছে। তারিক রামাদান অবশ্য অতি উগ্র কট্টর মুসলমান ও মুসলিম
দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। অন্য কথায় ফ্রান্সে
বিভিন্ন গোষ্ঠী তারিক রামাদানকে কোণঠাসা করতে ওঠেপড়ে লেগে আছে। সেক্ষেত্রে
যে কেবল ইসলাম ও মুসলিমবিদ্ধেষ থেকে তারিককে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, তা নয়।
ফরাসি পূর্ব সংস্থা ও গোঁড়ামিকে জাহির করতে যৌক্তিক কণ্ঠগুলোকে রুদ্ধ করে
দেয়ার উদ্যোগেরও অংশ হিসেবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হতে পারে। বিভিন্ন
মৌলিক ইস্যুতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অধিকারের ক্ষেত্রে ফরাসি ও ইউরোপীয়
অভিজাতদের চেতনা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। সেক্ষেত্রে তারিক রামাদানের এই
বিচার মুসলিম কর্তৃত্ববাদ ও তাদের নিজেদের সীমানার বাইরে হস্তক্ষেপ করার
ক্ষমতারও প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ তারা ফরাসি কর্তৃপক্ষের ওপর
প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। সব কিছু মিলিয়ে কীভাবে আমরা আশা করতে পারি
তারিক রামাদান ন্যায়বিচার পাবেন? এ জন্য ফ্রি তারিক রামাদান ক্যাম্পেন ও
অন্যান্য সুশীলসমাজ অতিসত্বর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে।
No comments