এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছার চেয়ে জীবনের চূড়ায় পৌঁছানো কঠিন! by জুয়েল রানা
কবে
যাব পাহাড়ে আহারে, আহারে! গানটি যেন পাহাড়ে যেতে না পারার আমার আকুতিই
প্রকাশ করে। শৈশব থেকে আমৃত্যু জীবন-যুদ্ধে কত পাহাড়ই আমরা ডিঙাই।
নিত্যদিনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কারণে খুব কম মানুষেরই প্রকৃতির পাহাড় বা
পর্বত দেখা কিংবা ডিঙানো সম্ভব হয়। যেমন গ্রামের স্কুল-কলেজ থেকে পড়ে
বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার মতো মজুর, কুলি,
কৃষক ও মেহনতি মানুষের সন্তানদের যুগ যুগ ধরেই টিকে থাকার সংগ্রাম করে
যেতে হয়।
মানুষের বাসায় প্রাইভেট পড়িয়ে, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে, বিক্রয়কর্মীর কাজ করে যুদ্ধ করতে হয় হলের গণরুমে একটি আসন, দুবেলা হলের তৈলাক্ত খাবার, ডাল ও পানির অভিনব মিশ্রণ, আজিজ সুপার বা নিউমার্কেটের ১৫০ টাকার একটি গেঞ্জি বা শার্ট, ১২০ টাকার স্যান্ডেল এবং পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে পরিবারের জন্য কিছু পাঠানোর। সেই সাথে অসম সমাজ, ক্লাসের পড়াশুনা, পিতা-মাতার স্বপ্ন, ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, শ্রেণিকক্ষে বা সহপাঠীদের সাথে পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবন-ধারনে খাপ খাওয়ানোর প্রতিবন্ধকতা সর্বোপরি সামাজিক বঞ্চনা তাদের কুরে কুরে খায়।
সবাই নিত্যদিনের এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পেরে উঠে না, যেমন পেরে ওঠেনি আমাদের হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হোসেন কিছুদিন আগেই আত্মহত্যা করেছে, যার মূল কারণ হলো আমাদের অসম সমাজের যাতাকল, নির্যাতন, অত্যাচার ও অবজ্ঞা। এভাবেই সংগ্রামী মানুষগুলো এক সময় নিজের ওপর বিশ্বাসটাও হারিয়ে ফেলে। কোনো কোনো সময় জীবন দিয়ে ধিক্কার জানাতে চায় আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত, সুশীল, শহুরে, স্মার্ট, উচ্চ বংশীয় ও পয়সাওয়ালা অমানুষদের। যদিও আত্মহত্যা কখনোই সমাধান নয়। আমাদের বেঁচে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই অন্ধ সমাজকে প্রতিনিয়ত চপেটাঘাত করতে হবে এবং উপড়ে ফেলতে হবে কলুষিত এই সমাজের শিকড়।
তাইতো বেঁচে থাকার এ জীবন সংগ্রামে তিন বেলা ভোগ করাটাই হয়ে ওঠে মুখ্য; সেখানে জীবন উপভোগ যেন এক আকাশ- কুসুম কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাসফরে অংশগ্রহণ, সহপাঠীদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, প্রিয়ার ভালোবাসা কিংবা নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্য কিছু চিন্তা যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্ণিমার চাঁদের মত একখানা ঝলসানো রুটি। এভাবেই একদিন মরে যায় পিপাসু সেই মন, ভালোবাসাপূর্ণ সেই কোমল হৃদয় এবং আমরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠি এক একটা দানব; যে দানব গিলে ফেলে মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ, মানবতা এমন কি পুরো জগৎটাকে।
বিভাগীয় শিক্ষক জামাল স্যারের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম সেমিস্টারে ৫০০টাকা চাঁদা দিয়ে কুমিল্লা বার্ডে একবার শিক্ষাসফরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এরপর আর কখনোই সহপাঠীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি নয়নাভিরাম সাজেক ভ্যালি, নীলগিরি, মাধবকুণ্ডের ঝর্ণা কিংবা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে বিভাগ থেকে তিন দিনের জন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময় বন্ধুদের সাথে সমুদ্র বিলাস আমার জন্য বিলাসিতাই ছিল। আজ যুক্তরাজ্যে বিশ্বের প্রথম সারির ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে এরাসমাস স্কলার হিসেবে পড়ালেখা করছি। এখানে ছুটির দিনে সবাই প্রকৃতি ভ্রমণে বের হয়। প্রতি সপ্তাহে না পারলেও মাসে অন্তত দু-একদিন আমিও অংশগ্রহণ করার দুঃসাহস করি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সহপাঠীদের অনুরোধ ও উৎসাহে ওয়েলস-এর সর্বোচ্চ মাউন্টেন স্নোডেন চূড়ায় ওঠার মনস্থির করি। ৩৫৬০ ফুট উচূ এই মাউন্টেনের চূড়ায় পৌঁছাতে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। উল্লেখ্য, প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী স্যার এডমুন্ড হিলারি 'স্নোডেন' মাউন্টেনেই অনুশীলন করেছিলেন। যাহোক আমাদের ৫ জনের দল সকাল ১০টায় 'স্নোডেন' মাউন্টেনে ওঠা শুরু করে। সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে আমরা মাত্র তিনজন ২৯৫০ ফুট পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলাম। প্রচুর তুষারপাত, মেঘ ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে ১৭ ফেব্রুয়ারি ৮২০ ফুট উচ্চতা থেকে বরফে পিছলে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাই চূড়ায় যেতে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। চূড়ায় যেতে না পারলেও প্রথমবারের মতো পর্বতারোহণের অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। মেঘের সাথে মিতালি, পাথর, তুষারপাত, বাতাস ও বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ। এ যেন সত্যি সত্যি বেঁচে থাকার লড়াই, একটু বিচ্যুত হলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। নামতে নামতে আমি ভাবছিলাম, কত সহজে এত উঁচুতে উঠে গেলাম! অথচ আজকের এই মাউন্টেন দেখতে আসার পেছনে কত সময় ও পরিশ্রম লেগেছে! এ পর্যন্ত কতগুলো পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে বর্তমানে পৌঁছেছি। জীবনের সংগ্রামটা পর্বতে বেঁচে থাকার সংগ্রামের চেয়ে ঢের। তেমনিভাবে উপলব্ধি করলাম, পর্বতের চূড়ার চেয়ে জীবনের চূড়ায় পৌঁছানো অনেক কঠিন। এই উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জানাই আমার বন্ধু হারিন, নন্দিতা, টেইলর ও প্যাট্রিসিয়াকে।
লেখক: এরাসমাস মুন্ডুস স্কলার, শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
মানুষের বাসায় প্রাইভেট পড়িয়ে, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে, বিক্রয়কর্মীর কাজ করে যুদ্ধ করতে হয় হলের গণরুমে একটি আসন, দুবেলা হলের তৈলাক্ত খাবার, ডাল ও পানির অভিনব মিশ্রণ, আজিজ সুপার বা নিউমার্কেটের ১৫০ টাকার একটি গেঞ্জি বা শার্ট, ১২০ টাকার স্যান্ডেল এবং পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে পরিবারের জন্য কিছু পাঠানোর। সেই সাথে অসম সমাজ, ক্লাসের পড়াশুনা, পিতা-মাতার স্বপ্ন, ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, শ্রেণিকক্ষে বা সহপাঠীদের সাথে পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবন-ধারনে খাপ খাওয়ানোর প্রতিবন্ধকতা সর্বোপরি সামাজিক বঞ্চনা তাদের কুরে কুরে খায়।
সবাই নিত্যদিনের এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পেরে উঠে না, যেমন পেরে ওঠেনি আমাদের হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হোসেন কিছুদিন আগেই আত্মহত্যা করেছে, যার মূল কারণ হলো আমাদের অসম সমাজের যাতাকল, নির্যাতন, অত্যাচার ও অবজ্ঞা। এভাবেই সংগ্রামী মানুষগুলো এক সময় নিজের ওপর বিশ্বাসটাও হারিয়ে ফেলে। কোনো কোনো সময় জীবন দিয়ে ধিক্কার জানাতে চায় আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত, সুশীল, শহুরে, স্মার্ট, উচ্চ বংশীয় ও পয়সাওয়ালা অমানুষদের। যদিও আত্মহত্যা কখনোই সমাধান নয়। আমাদের বেঁচে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই অন্ধ সমাজকে প্রতিনিয়ত চপেটাঘাত করতে হবে এবং উপড়ে ফেলতে হবে কলুষিত এই সমাজের শিকড়।
তাইতো বেঁচে থাকার এ জীবন সংগ্রামে তিন বেলা ভোগ করাটাই হয়ে ওঠে মুখ্য; সেখানে জীবন উপভোগ যেন এক আকাশ- কুসুম কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাসফরে অংশগ্রহণ, সহপাঠীদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, প্রিয়ার ভালোবাসা কিংবা নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্য কিছু চিন্তা যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্ণিমার চাঁদের মত একখানা ঝলসানো রুটি। এভাবেই একদিন মরে যায় পিপাসু সেই মন, ভালোবাসাপূর্ণ সেই কোমল হৃদয় এবং আমরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠি এক একটা দানব; যে দানব গিলে ফেলে মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ, মানবতা এমন কি পুরো জগৎটাকে।
বিভাগীয় শিক্ষক জামাল স্যারের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম সেমিস্টারে ৫০০টাকা চাঁদা দিয়ে কুমিল্লা বার্ডে একবার শিক্ষাসফরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এরপর আর কখনোই সহপাঠীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি নয়নাভিরাম সাজেক ভ্যালি, নীলগিরি, মাধবকুণ্ডের ঝর্ণা কিংবা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে বিভাগ থেকে তিন দিনের জন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময় বন্ধুদের সাথে সমুদ্র বিলাস আমার জন্য বিলাসিতাই ছিল। আজ যুক্তরাজ্যে বিশ্বের প্রথম সারির ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে এরাসমাস স্কলার হিসেবে পড়ালেখা করছি। এখানে ছুটির দিনে সবাই প্রকৃতি ভ্রমণে বের হয়। প্রতি সপ্তাহে না পারলেও মাসে অন্তত দু-একদিন আমিও অংশগ্রহণ করার দুঃসাহস করি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সহপাঠীদের অনুরোধ ও উৎসাহে ওয়েলস-এর সর্বোচ্চ মাউন্টেন স্নোডেন চূড়ায় ওঠার মনস্থির করি। ৩৫৬০ ফুট উচূ এই মাউন্টেনের চূড়ায় পৌঁছাতে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। উল্লেখ্য, প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী স্যার এডমুন্ড হিলারি 'স্নোডেন' মাউন্টেনেই অনুশীলন করেছিলেন। যাহোক আমাদের ৫ জনের দল সকাল ১০টায় 'স্নোডেন' মাউন্টেনে ওঠা শুরু করে। সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে আমরা মাত্র তিনজন ২৯৫০ ফুট পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলাম। প্রচুর তুষারপাত, মেঘ ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে ১৭ ফেব্রুয়ারি ৮২০ ফুট উচ্চতা থেকে বরফে পিছলে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাই চূড়ায় যেতে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। চূড়ায় যেতে না পারলেও প্রথমবারের মতো পর্বতারোহণের অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। মেঘের সাথে মিতালি, পাথর, তুষারপাত, বাতাস ও বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ। এ যেন সত্যি সত্যি বেঁচে থাকার লড়াই, একটু বিচ্যুত হলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। নামতে নামতে আমি ভাবছিলাম, কত সহজে এত উঁচুতে উঠে গেলাম! অথচ আজকের এই মাউন্টেন দেখতে আসার পেছনে কত সময় ও পরিশ্রম লেগেছে! এ পর্যন্ত কতগুলো পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে বর্তমানে পৌঁছেছি। জীবনের সংগ্রামটা পর্বতে বেঁচে থাকার সংগ্রামের চেয়ে ঢের। তেমনিভাবে উপলব্ধি করলাম, পর্বতের চূড়ার চেয়ে জীবনের চূড়ায় পৌঁছানো অনেক কঠিন। এই উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জানাই আমার বন্ধু হারিন, নন্দিতা, টেইলর ও প্যাট্রিসিয়াকে।
লেখক: এরাসমাস মুন্ডুস স্কলার, শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
No comments