পরিচালক পুরস্কৃত, ব্যাংকার জেলে, ব্যবসায়ী পলাতক by ফখরুল ইসলাম
বেসিক
ব্যাংকের কেলেঙ্কারির সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সব নিরাপদে আছেন।
তাঁরা ঘুরছেন-ফিরছেন, স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। পদ-পদোন্নতি দিয়ে সরকার
উল্টো তাঁদের পুরস্কৃতও করেছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেসব
ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে, তাঁরা সবাই জামিনে। আদালত থেকে জামিন পেয়ে
তাঁদের কেউ দেশে আছেন, কেউবা জামিন পাওয়ার দিনই পালিয়ে চলে গেছেন বিদেশে।
আর পর্ষদের হুকুম তামিল করা ব্যাংকাররা সবাই জেলে। কিন্তু বাংলাদেশের
ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান এই আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যাঁর প্রধান দায়
রয়েছে বলে অভিযোগ আছে, সেই আবদুল হাই বাচ্চু রয়েছেন বহালতবিয়তে। এ বিষয়ে এক
মাসের বেশি সময় ধরে দুদকের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই।
আদালতের নির্দেশে গত
৪ ও ৬ ডিসেম্বর দুদক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ডেকেছিল। এরপর সর্বশেষ গত ৮
জানুয়ারি দুদক তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বেসিক
ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার পাঁচ বছরে (২০০৯-১৪) নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির
মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়। ২০০৯ সালের ব্যাংকটির খেলাপি
ঋণ ছিল ৫ শতাংশ, আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশ। ওই পাঁচ বছরে
ব্যাংকটির এই অবস্থার জন্য দায়ী মূলত পরিচালনা পর্ষদ। কেলেঙ্কারির পর এখন
পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে বাজেট থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।
তবে তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। ব্যাংকটি এখনো ধুঁকছে। দুদক বেসিক ব্যাংক
কেলেঙ্কারি নিয়ে এখন পর্যন্ত ৫৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত
পর্ষদ সদস্যদের কারও নাম নেই। নাম নেই সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়েরও।
মামলাগুলোর আসামি ১২০ জন। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী ৮২, জরিপকারী ১১ জন এবং ২৭
জন ব্যাংকার। আসামিদের মধ্যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক, যাঁদের মধ্যে
ব্যবসায়ী ১০ জন, ব্যাংকার ৫ জন এবং জরিপকারী ১ জন।
পর্ষদ সদস্যরা পুরস্কৃত
আবদুল হাইকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের যে নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার, সেই পর্ষদই ব্যাংকটির পতনের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়। ওই দিন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম। বেসিক ব্যাংক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুভাশীষ বসু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান। কেলেঙ্কারির পুরো সময় তিনি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি বাণিজ্যসচিব। ব্যাংকটির পরিচালক হওয়ার বছরেই বিজয় ভট্টাচার্যকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে সরকার নিয়োগ দেয়। জেনেভা থেকে দেশে ফিরলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান। বিজয় ভট্টাচার্য জেনেভা যাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ পরিচালক হন। কেলেঙ্কারির পুরো সময়টাতেই তিনি এ ব্যাংকের পরিচালক থাকেন। এই ফাঁকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানেও এই পদে আছেন।
পর্ষদ সদস্যরা পুরস্কৃত
আবদুল হাইকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের যে নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার, সেই পর্ষদই ব্যাংকটির পতনের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়। ওই দিন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম। বেসিক ব্যাংক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুভাশীষ বসু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান। কেলেঙ্কারির পুরো সময় তিনি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি বাণিজ্যসচিব। ব্যাংকটির পরিচালক হওয়ার বছরেই বিজয় ভট্টাচার্যকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে সরকার নিয়োগ দেয়। জেনেভা থেকে দেশে ফিরলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান। বিজয় ভট্টাচার্য জেনেভা যাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ পরিচালক হন। কেলেঙ্কারির পুরো সময়টাতেই তিনি এ ব্যাংকের পরিচালক থাকেন। এই ফাঁকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানেও এই পদে আছেন।
পর্ষদ সদস্য হওয়ার পর রাজিয়া বেগম পদোন্নতি পেয়ে
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। ২০১০ সালের ৩১ জুলাই ব্যাংকের
টুঙ্গিপাড়া শাখা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা
যান সচিব রাজিয়া বেগম ও বিসিক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান। অতিরিক্ত সচিব
ফখরুল ইসলাম নতুন বিসিক চেয়ারম্যান হলে তাঁকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ
দেয় সরকার। এরপর তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল
কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান এবং ব্যাংকের পরিচালক পদটিও তাঁর থেকে যায়।
পরে বিসিক চেয়ারম্যান হন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য শ্যামসুন্দর সিকদার।
পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব।
বর্তমানে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব। শেখ আবদুল হাইয়ের ৫ বছরের
মেয়াদে এ ছাড়া পরিচালক ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র মাসিক উত্তরণ পত্রিকার
সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক
অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। আনিস আহমেদ এখন উত্তরণ পত্রিকার
বার্তা সম্পাদক। আর আবদুল হাইয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩
সালের জুলাইয়ে রেজাউর রহমান চিঠি পাঠালে তিনি এবং কামরুল ইসলাম বেসিক
ব্যাংকে আর যেতেই পারেননি। সাবেক পরিচালক ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে
দাবি করেন, তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন স্বাভাবিক নিয়মে এবং ব্যাংকের পরিচালক
থাকার সময় অনিয়ম হয়নি। এ বিষয়ে বিশদ কথা বলতে তিনি বিব্রত বলেও জানান।
এআরএস লুভের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার তিন বছরের
মাথায় বাংলাদেশ যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। আগে তিনি যুবলীগের কোনো পদে
ছিলেন না। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এবং তাঁর মতো সব সদস্যই
পর্ষদ সভায় অন্ধকারে থাকতেন।
ব্যবসায়ীরা সব জামিনে
ফারসি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়জুন নবী চৌধুরী বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। দুদকের দুটি মামলায় ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ গ্রেপ্তার হন ফয়জুন নবী চৌধুরী এবং নিম্ন আদালত থেকে তিনি জামিনের আবেদন করলে ২৫ মে তা নামঞ্জুর হয়। এরপর হাইকোর্ট থেকে দুই মামলায় ছয় মাসের জামিন নিয়ে ৩০ মে কারাগার থেকে ছাড়া পান ফয়জুন নবী চৌধুরী। জামিন পেয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন। এশিয়ান শিপিং বিডির স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেনও আছেন জামিনে। একই ঘটনা ঘটে সৈয়দ হাসিবুল গণি ওরফে গালিবের ক্ষেত্রে। এমারেল ড্রেস, এমারেল অটোব্রিকস, এমারেল কোল্ড স্টোরেজ এবং ভয়েস এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নেন ১৩২ কোটি টাকা। চারটি আলাদা মামলার আসামি সৈয়দ হাসিবুল গণিও দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ। একই কায়দায় তিনিও হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বিদেশে চলে যান। এ ছাড়া ৬৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য ভাসাভি ফ্যাশনের ইয়াসির আহমেদ খান, ৫৫ কোটি টাকার জন্য তাহমিনা ডেনিম ও তাহমিনা নিটওয়্যারের এমডি কামাল জামাল মোল্লা, ৮৫ কোটি টাকার জন্য এ আর এস এস ইন্টারন্যাশনালের মো. সাবির হোসেন, ৩০ কোটি টাকার জন্য নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। তবে তাঁরা দেশে না বিদেশে আছেন তা জানা যায়নি। রূপসা সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রধান সার্ভেয়ার (জরিপকারী) শাহজাহান আলী দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৬ সালের আগস্ট। হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে তিনিও জামিনে আছেন। শাহজাহান আলীর মামলার শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের যৌথ বেঞ্চ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেন। এরপরই বাধ্য হয়ে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়েছে দুদক। তবে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু শুনানির সময় পরিবর্তনের আবেদন করে যাচ্ছেন। তিনি এখনো সময় দেননি বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
জেল খাটছেন ব্যাংকাররা
ব্যাংকার ২৭ জনের মধ্যে আবদুল হাইয়ের সব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকটির পলাতক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম। তাঁর আগের এমডি এ কে এম সাজেদুর রহমান ২০১০ সালের শেষ দিকে পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত এমডি হন তৎকালীন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শেখ মঞ্জুর মোরশেদ। কাজী ফখরুল ইসলাম এরপরই এমডি হয়ে আসেন, যাঁকে ২০১৪ সালের মে মাসে বরখাস্ত করা হয়। আসামিদের মধ্যে এই তিনজনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকাররা রয়েছেন। যাঁদের কেউ বরখাস্ত, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউবা অপসারিত হয়েছেন। দুদক ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকারদের মধ্যে গ্রেপ্তার করে দুই ডিএমডি মো. ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিমকে। একই মাসে গ্রেপ্তার হন গুলশান শাখার প্রধান শিপার আহমেদ। মার্চে সহকারী ব্যবস্থাপক ইকরামুল বারী এবং এপ্রিলে গ্রেপ্তার হন মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন। দুই বছর পার হলেও তাঁদের কেউ জামিন পাননি। দুদকও চায় তাঁরা জেলে থাকুন। যেমন ডিএমডি মো. সেলিম জামিন পেলেও গত ৭ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা সব জামিনে
ফারসি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়জুন নবী চৌধুরী বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। দুদকের দুটি মামলায় ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ গ্রেপ্তার হন ফয়জুন নবী চৌধুরী এবং নিম্ন আদালত থেকে তিনি জামিনের আবেদন করলে ২৫ মে তা নামঞ্জুর হয়। এরপর হাইকোর্ট থেকে দুই মামলায় ছয় মাসের জামিন নিয়ে ৩০ মে কারাগার থেকে ছাড়া পান ফয়জুন নবী চৌধুরী। জামিন পেয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন। এশিয়ান শিপিং বিডির স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেনও আছেন জামিনে। একই ঘটনা ঘটে সৈয়দ হাসিবুল গণি ওরফে গালিবের ক্ষেত্রে। এমারেল ড্রেস, এমারেল অটোব্রিকস, এমারেল কোল্ড স্টোরেজ এবং ভয়েস এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নেন ১৩২ কোটি টাকা। চারটি আলাদা মামলার আসামি সৈয়দ হাসিবুল গণিও দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ। একই কায়দায় তিনিও হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বিদেশে চলে যান। এ ছাড়া ৬৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য ভাসাভি ফ্যাশনের ইয়াসির আহমেদ খান, ৫৫ কোটি টাকার জন্য তাহমিনা ডেনিম ও তাহমিনা নিটওয়্যারের এমডি কামাল জামাল মোল্লা, ৮৫ কোটি টাকার জন্য এ আর এস এস ইন্টারন্যাশনালের মো. সাবির হোসেন, ৩০ কোটি টাকার জন্য নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। তবে তাঁরা দেশে না বিদেশে আছেন তা জানা যায়নি। রূপসা সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রধান সার্ভেয়ার (জরিপকারী) শাহজাহান আলী দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৬ সালের আগস্ট। হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে তিনিও জামিনে আছেন। শাহজাহান আলীর মামলার শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের যৌথ বেঞ্চ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেন। এরপরই বাধ্য হয়ে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়েছে দুদক। তবে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু শুনানির সময় পরিবর্তনের আবেদন করে যাচ্ছেন। তিনি এখনো সময় দেননি বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
জেল খাটছেন ব্যাংকাররা
ব্যাংকার ২৭ জনের মধ্যে আবদুল হাইয়ের সব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকটির পলাতক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম। তাঁর আগের এমডি এ কে এম সাজেদুর রহমান ২০১০ সালের শেষ দিকে পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত এমডি হন তৎকালীন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শেখ মঞ্জুর মোরশেদ। কাজী ফখরুল ইসলাম এরপরই এমডি হয়ে আসেন, যাঁকে ২০১৪ সালের মে মাসে বরখাস্ত করা হয়। আসামিদের মধ্যে এই তিনজনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকাররা রয়েছেন। যাঁদের কেউ বরখাস্ত, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউবা অপসারিত হয়েছেন। দুদক ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকারদের মধ্যে গ্রেপ্তার করে দুই ডিএমডি মো. ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিমকে। একই মাসে গ্রেপ্তার হন গুলশান শাখার প্রধান শিপার আহমেদ। মার্চে সহকারী ব্যবস্থাপক ইকরামুল বারী এবং এপ্রিলে গ্রেপ্তার হন মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন। দুই বছর পার হলেও তাঁদের কেউ জামিন পাননি। দুদকও চায় তাঁরা জেলে থাকুন। যেমন ডিএমডি মো. সেলিম জামিন পেলেও গত ৭ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়েছে।
গ্রেপ্তার না হওয়া
ব্যাংকারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বরখাস্ত হওয়া আরও দুই ডিএমডি এ মোনায়েম
খান ও কনক কুমার পুরকায়স্থ, শান্তিনগর শাখাপ্রধান মোহাম্মদ আলী চৌধুরী,
গুলশান শাখাপ্রধান এস এম ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ
বেসিক ব্যাংকের মামলা নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আদালত থেকে ব্যবসায়ীদের
জামিন পাওয়া এবং ব্যাংকারদের জামিন না পাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কিছু বলার নেই।
আর পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নেওয়া হচ্ছে। শেষ হওয়ার পর বোঝা যাবে তাঁদের
অপরাধের ধরন কতটুকু। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্যাংক ও কোম্পানি আইন
নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক লুট
করা হয়েছে। যদি লুটের সঙ্গে জড়িত পর্ষদ সদস্যরা নিরাপদ থাকেন, ব্যবসায়ীরা
জামিনে থাকেন আর ব্যাংকাররা জেলে থাকেন; এটাকে একটা টাইরানি, অলিগার্কি বা
প্লুটোক্রাসি পরিস্থিতি আখ্যা দেওয়া যায়।’ তিন ইংরেজি শব্দের অর্থ করেছেন
তিনি এভাবে-মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণে দুর্বল লোকদের
পিষ্ট হওয়া। সামগ্রিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চেয়ারম্যান আবদুল
হাইসহ জড়িত পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করা ব্যাংক খাতের
সুস্থতার জন্য জরুরি। নইলে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে
এবং এর মূল্য দিতে হবে গোটা অর্থনীতিকে।
No comments