বিএনপি কি নেতৃত্ব সংকট কাটাতে পারবে? by শ্রুতি এস. পত্নায়েক
জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার
দণ্ডাদেশ ও গ্রেপ্তার অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এনেছে। সেটা কেবলই দলটির
ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, প্রশ্ন উঠেছে ২০১৮ সালের শেষাশেষি অনুষ্ঠেয় পরবর্তী
সংসদীয় নির্বাচন নিয়েও।
৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। তারেক রহমান, যিনি রাজনৈতিক উত্তরসূরি, দলটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁকে দুই লাখ ৫২ হাজার মার্কিন ডলার তছরুপের দায়ে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দোষী সাব্যস্ত করার ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একটি শক্ত দাগ ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ও অন্যুন দুই বছর দণ্ডিত হওয়া এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। যে কোনো গণতন্ত্রে দুর্নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই রায়টি উচ্চ আদালতে সমুন্নত হলে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন এনে দেবে।
বিএনপি এই রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
মাইনাস টু ফর্মুলার অংশ হিসেবে মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের করেছিল। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একই ধরনের মামলা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দায়ের করছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বাতিল করে দেওয়া হলেও মিসেস জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকে। এই মামলা ছাড়াও মিসেস জিয়া অন্যান্য ফৌজদারি মামলায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন, যা দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিচারাধীন রয়েছে।
বিএনপি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে দুর্বলতম অবস্থায় রয়েছে। ২০১৫ সালের শুরুর মাসগুলোতে সহিংস প্রতিবাদে অংশগ্রহণের অভিযোগে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই সহিংসতায় একশ জনের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটে। যাদের অধিকাংশই পেট্রলবোমা হামলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। খালেদা জিয়ার দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিএনপির রাজনৈতিক স্বাস্থ্যের উপর একটি ভয়ানক হুমকি সৃষ্টি করেছে। যদিও এ ধরনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়ে দলের প্রস্তুতি ছিল। দলটি অনতিবিলম্বে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত করছে যে, খালেদা জিয়া কিভাবে তারেক রহমান, যিনি একই মামলায় দশ বছর দন্ডিত, তা সত্ত্বেও দলের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে শীর্ষ পদ হস্তান্তরে শিথিল মনোভাব পোষণ করেছিলেন।
বিএনপি এখন এমন একটি দল দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, যার নেতা ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন এবং যার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। এবং সে কারণে তিনি তৃণমূলের কর্মীদের সংগঠিত করার অবস্থায়ও নেই। তারেক রহমানের দুর্বল নেতৃত্ব এর আগে খুবই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল, যখন ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তাঁর নির্দেশনায় সহিংস প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল। ওই প্রতিবাদ উল্টো ফল বয়ে এনেছিল এবং দলটির রাজনৈতিক ভাগ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। বহু দেশ বিএনপির সহিংস প্রতিবাদের নিন্দা করেছিল এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তারা চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই জামায়াতের ক্যাডাররাই ওই সহিংস প্রতিবাদের পেছনে ছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়।
এসব জিনিস মনে রেখে দলটি একটি বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া তার দণ্ডাদেশের পরে দলীয় কর্মীদের সহিংস পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিএনপি কয়েক মাস ধরে ভোটারদের সমর্থন কুড়িয়ে চলছিল। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল গত বছরের অক্টোবরে। কয়েক মাস লন্ডনে কাটিয়ে দেশে ফিরে এলে জনতা তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছিল। একই মাসে বিপুল সংখ্যক জনগণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। ওই সময় তিনি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন।
বিএনপি অব্যাহতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরুজ্জীবনের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কথা দলটি ঘোষণা করেছে। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি শেখ হাসিনার সরকার পূরণ না করার ক্ষেত্রে, দলটি ভোটারদের কাছে এই ধারণা দিয়ে আসছে যে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসে নি। এই দাবি পূরণ না হওয়ার কারণে ২০১৪ সালে নির্বাচন তারা বয়কট করেছিল। বিএনপি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না। ওই ভুলের কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাদের সম্ভাব্য বিজয় ডাকাতি হয়ে গিয়েছিল। যদিও বিএনপির মহাসচিব, বেগম খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার অঙ্গীকার করছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ও তাঁর ছেলেকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে যে নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপিকে অংশ নিতে দিতে রাজি হবেন কি না? বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ পাঁচ বছর পরে আবারও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনার সুযোগ হাতছাড়া করবেন কি না? বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য হলে দলটি উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়া থেকে বাঁচতে পারবে কি না? আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কিভাবে অনুমান করা হতে পারে? যদিও এসব প্রশ্ন হাইপোথেটিক্যাল। কিন্তু এসব বিষয়ই আগামী নির্বাচনের জন্য কৌশল নির্ধারণ করতে গিয়ে দলটিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
যখন নির্বাচন আবারও বয়কট করা একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প নয়, তেমনি কারাগার এবং লন্ডন থেকে দল নিয়ন্ত্রণ করা সমানভাবে চ্যালেঞ্জিং বলেই প্রমাণিত হবে। দলের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তাদের উপরে দল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণে দলের আস্থাহীনতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালের আগস্টে মীর্জা ফখরুলকে দলের মহাসচিব করা হয়েছিল, এর আগে তাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পাঁচ বছর থাকতে হয়েছিল।
উপরন্তু দলটির প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনহীন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেক ক্যাডার কারাবন্দী। কিংবা অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ফৌজদারী মামলায় লড়ছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, বিএনপি রাজপথের শক্তি প্রদর্শনে যেমন, তেমনি রাজনৈতিক সংকল্প দেখাতেও ঘাটতি দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এটা বেশ ভালই জানা আছে যে, যখন দলটি বিশেষ করে তার ক্যাডাররা বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা মোকাবেলা করছে, তখন একটি হতদ্যম বিএনপির পক্ষে লড়াকু মনোভাব দেখানোর শক্তি দেখানো সম্ভব নয়।
২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি তার রাজপথের শক্তি প্রদর্শন তীব্র করেছিল। তখন পর্যন্ত তাদের চার লাখ তিন হাজার ৮৭৮ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ২১ হাজার ৬৮০ টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে দলীয় চেয়ারপারসন বেগাম খালেদা জিয়সহ ১৫৮ নেতার বিরুদ্ধে চার হাজার তিন শ একত্রিশটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দলটির ১২ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য ২৮৮টি মামলা মোকাবেলা করছেন। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন কারাগারে ১৭ হাজার ৮৫৮ জন বিএনপি নেতাকর্মী বন্দি রয়েছেন। উপরন্তু দলীয় নেতৃবৃন্দ যখন সংসদের সদস্য নন, কিংবা তারা বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক প্রিভিলেজ বা সুবিধা ভোগ করেন না, তখন দলীয় ক্যাডারদের মনোবল ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ দলীয় নেতারা ওই ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন বলেই একটি পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক টিকে থাকে।
সে কারণে বিএনপির অভ্যন্তরে যে বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে সুবিধা উসুলে চেষ্টা করতে পারে আওয়ামী লীগ। গত বছরে দলটি তার কাউন্সিল অধিবেশনের আয়োজন করলে বিএনপির অভ্যন্তরে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছিল। দলটির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা কোণঠাসা হয়েছিলেন এবং কেবলমাত্র নেতৃত্বের প্রতি অনুগতরাই দলের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করেছিল।
যদি প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের জন্য অনুকূল নয়। সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভালই সাফল্য দেখিয়ে চলছে। দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রপ্তানীকারক দেশ। বিএনপি কিভাবে তার ক্ষয় হতে থাকা রাজনৈতিক পুঁজি থেকে নিজকে বাঁচিয়ে পথ চলতে পারে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
(শ্রুতি এস. পত্নায়েক: দিল্লি ভিত্তিক বেসরকারি থিংকট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড অ্যানালাইসিস (আইডিএসএ)-এর রিসার্চ ফেলো। ১৫ ই ফেব্রুয়ারি আইডিএসএ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)
৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। তারেক রহমান, যিনি রাজনৈতিক উত্তরসূরি, দলটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁকে দুই লাখ ৫২ হাজার মার্কিন ডলার তছরুপের দায়ে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দোষী সাব্যস্ত করার ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একটি শক্ত দাগ ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ও অন্যুন দুই বছর দণ্ডিত হওয়া এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। যে কোনো গণতন্ত্রে দুর্নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই রায়টি উচ্চ আদালতে সমুন্নত হলে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন এনে দেবে।
বিএনপি এই রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
মাইনাস টু ফর্মুলার অংশ হিসেবে মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের করেছিল। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একই ধরনের মামলা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দায়ের করছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বাতিল করে দেওয়া হলেও মিসেস জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকে। এই মামলা ছাড়াও মিসেস জিয়া অন্যান্য ফৌজদারি মামলায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন, যা দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিচারাধীন রয়েছে।
বিএনপি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে দুর্বলতম অবস্থায় রয়েছে। ২০১৫ সালের শুরুর মাসগুলোতে সহিংস প্রতিবাদে অংশগ্রহণের অভিযোগে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই সহিংসতায় একশ জনের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটে। যাদের অধিকাংশই পেট্রলবোমা হামলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। খালেদা জিয়ার দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিএনপির রাজনৈতিক স্বাস্থ্যের উপর একটি ভয়ানক হুমকি সৃষ্টি করেছে। যদিও এ ধরনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়ে দলের প্রস্তুতি ছিল। দলটি অনতিবিলম্বে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত করছে যে, খালেদা জিয়া কিভাবে তারেক রহমান, যিনি একই মামলায় দশ বছর দন্ডিত, তা সত্ত্বেও দলের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে শীর্ষ পদ হস্তান্তরে শিথিল মনোভাব পোষণ করেছিলেন।
বিএনপি এখন এমন একটি দল দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, যার নেতা ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন এবং যার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। এবং সে কারণে তিনি তৃণমূলের কর্মীদের সংগঠিত করার অবস্থায়ও নেই। তারেক রহমানের দুর্বল নেতৃত্ব এর আগে খুবই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল, যখন ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তাঁর নির্দেশনায় সহিংস প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল। ওই প্রতিবাদ উল্টো ফল বয়ে এনেছিল এবং দলটির রাজনৈতিক ভাগ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। বহু দেশ বিএনপির সহিংস প্রতিবাদের নিন্দা করেছিল এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তারা চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই জামায়াতের ক্যাডাররাই ওই সহিংস প্রতিবাদের পেছনে ছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়।
এসব জিনিস মনে রেখে দলটি একটি বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া তার দণ্ডাদেশের পরে দলীয় কর্মীদের সহিংস পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিএনপি কয়েক মাস ধরে ভোটারদের সমর্থন কুড়িয়ে চলছিল। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল গত বছরের অক্টোবরে। কয়েক মাস লন্ডনে কাটিয়ে দেশে ফিরে এলে জনতা তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছিল। একই মাসে বিপুল সংখ্যক জনগণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। ওই সময় তিনি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন।
বিএনপি অব্যাহতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরুজ্জীবনের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কথা দলটি ঘোষণা করেছে। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি শেখ হাসিনার সরকার পূরণ না করার ক্ষেত্রে, দলটি ভোটারদের কাছে এই ধারণা দিয়ে আসছে যে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসে নি। এই দাবি পূরণ না হওয়ার কারণে ২০১৪ সালে নির্বাচন তারা বয়কট করেছিল। বিএনপি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না। ওই ভুলের কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাদের সম্ভাব্য বিজয় ডাকাতি হয়ে গিয়েছিল। যদিও বিএনপির মহাসচিব, বেগম খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার অঙ্গীকার করছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ও তাঁর ছেলেকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে যে নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপিকে অংশ নিতে দিতে রাজি হবেন কি না? বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ পাঁচ বছর পরে আবারও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনার সুযোগ হাতছাড়া করবেন কি না? বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য হলে দলটি উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়া থেকে বাঁচতে পারবে কি না? আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কিভাবে অনুমান করা হতে পারে? যদিও এসব প্রশ্ন হাইপোথেটিক্যাল। কিন্তু এসব বিষয়ই আগামী নির্বাচনের জন্য কৌশল নির্ধারণ করতে গিয়ে দলটিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
যখন নির্বাচন আবারও বয়কট করা একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প নয়, তেমনি কারাগার এবং লন্ডন থেকে দল নিয়ন্ত্রণ করা সমানভাবে চ্যালেঞ্জিং বলেই প্রমাণিত হবে। দলের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তাদের উপরে দল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণে দলের আস্থাহীনতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালের আগস্টে মীর্জা ফখরুলকে দলের মহাসচিব করা হয়েছিল, এর আগে তাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পাঁচ বছর থাকতে হয়েছিল।
উপরন্তু দলটির প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনহীন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেক ক্যাডার কারাবন্দী। কিংবা অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ফৌজদারী মামলায় লড়ছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, বিএনপি রাজপথের শক্তি প্রদর্শনে যেমন, তেমনি রাজনৈতিক সংকল্প দেখাতেও ঘাটতি দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এটা বেশ ভালই জানা আছে যে, যখন দলটি বিশেষ করে তার ক্যাডাররা বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা মোকাবেলা করছে, তখন একটি হতদ্যম বিএনপির পক্ষে লড়াকু মনোভাব দেখানোর শক্তি দেখানো সম্ভব নয়।
২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি তার রাজপথের শক্তি প্রদর্শন তীব্র করেছিল। তখন পর্যন্ত তাদের চার লাখ তিন হাজার ৮৭৮ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ২১ হাজার ৬৮০ টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে দলীয় চেয়ারপারসন বেগাম খালেদা জিয়সহ ১৫৮ নেতার বিরুদ্ধে চার হাজার তিন শ একত্রিশটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দলটির ১২ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য ২৮৮টি মামলা মোকাবেলা করছেন। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন কারাগারে ১৭ হাজার ৮৫৮ জন বিএনপি নেতাকর্মী বন্দি রয়েছেন। উপরন্তু দলীয় নেতৃবৃন্দ যখন সংসদের সদস্য নন, কিংবা তারা বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক প্রিভিলেজ বা সুবিধা ভোগ করেন না, তখন দলীয় ক্যাডারদের মনোবল ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ দলীয় নেতারা ওই ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন বলেই একটি পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক টিকে থাকে।
সে কারণে বিএনপির অভ্যন্তরে যে বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে সুবিধা উসুলে চেষ্টা করতে পারে আওয়ামী লীগ। গত বছরে দলটি তার কাউন্সিল অধিবেশনের আয়োজন করলে বিএনপির অভ্যন্তরে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছিল। দলটির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা কোণঠাসা হয়েছিলেন এবং কেবলমাত্র নেতৃত্বের প্রতি অনুগতরাই দলের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করেছিল।
যদি প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের জন্য অনুকূল নয়। সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভালই সাফল্য দেখিয়ে চলছে। দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রপ্তানীকারক দেশ। বিএনপি কিভাবে তার ক্ষয় হতে থাকা রাজনৈতিক পুঁজি থেকে নিজকে বাঁচিয়ে পথ চলতে পারে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
(শ্রুতি এস. পত্নায়েক: দিল্লি ভিত্তিক বেসরকারি থিংকট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড অ্যানালাইসিস (আইডিএসএ)-এর রিসার্চ ফেলো। ১৫ ই ফেব্রুয়ারি আইডিএসএ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)
No comments