মার্কিনদের একচেটিয়া শাসনের অবসান by কামাল গাবালা
মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে
স্বীকৃতি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গত ২১
ডিসেম্বর বাতিল হয়ে গেল। এই অধিকৃত শহরের মর্যাদা আগের মতোই থাকল। এর মধ্য
দিয়ে আরব ও আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর আবারও উঠে আসতে শুরু করল। এই মতৈক্যের
মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে এই সিদ্ধান্ত ওল্টানোর বা একে গুরুত্বহীন
সিদ্ধান্তে পরিণত করার কূটনৈতিক কাঠামো নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হলো।
মানুষও যুক্তরাষ্ট্রের অবিবেচক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক
সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এই ব্যক্তি প্রকাশ্যে বলেছেন, যারা
তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেবে না, তাদের সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যে
সিদ্ধান্তের কথা বললাম তার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক
আধিপত্যের অবসান হবে। দেখা যাচ্ছে, একাধিক মেরু ও ব্লকভিত্তিক নতুন এক
পৃথিবী গড়ে উঠতে শুরু করেছে, যে পৃথিবী মার্কিন মেরুর প্রভুত্ব,
নির্বুদ্ধিতা ও কদর্যতার বিরুদ্ধে দক্ষতার সঙ্গে খেলতে শুরু করেছে। আর
সিদ্ধান্তটি জোরালোভাবে প্রয়োগের বন্দোবস্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে এ রকম
একটি পরামর্শ এসেছে যে নিরাপত্তা পরিষদে ফিরে গিয়ে নতুন একটি সিদ্ধান্ত
নেওয়া হোক, যাতে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দুই-তৃতীয়াংশ
সদস্য ভোট দিলে নিরাপত্তা পরিষদে কেউ যেন তাতে ভেটো দিতে না পারে। মানে
যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলছি, তার এই ভেটো ক্ষমতা থাকবে না আর তাতে প্রস্তাব
পাস হয়ে যাবে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে
মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তির বাণী ফেরি করে বেড়াত।
ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তারা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করাকে
‘শতাব্দীর সেরা বন্দোবস্ত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ফাঁস হওয়া তথ্যে জানা
যায়, এই বন্দোবস্ত অনুসারে পশ্চিম তীরে এক দুর্বল ফিলিস্তিন সীমান্ত তৈরির
কথা আছে, যার কোনো সার্বভৌমত্ব বা সীমান্তরেখা থাকবে না। এর মধ্য দিয়ে
অধিকৃত জেরুজালেমকে ইহুদি ইসরায়েলি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি
দেওয়া হয়েছিল। ‘শতাব্দীর সেরা বন্দোবস্তে’ আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন
ভূখণ্ডের ক্ষমতা খুবই সীমিত হবে; সেই ক্ষমতা প্রদেশের চেয়ে বেশি হবে না।
গাজার সরু এক জায়গায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার মধ্যে কিছু
জমি মিসরের সিনাই মরুভূমি থেকে নেওয়া। আর ফিলিস্তিন সরকারকে ১ হাজার কোটি
ডলার ঘুষ দেওয়া হবে—এই পরিকল্পনাও ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন ভেবেছিল, গত কয়েক
মাসের চেষ্টায় তারা আরব নেতাদের কাছে অধিকৃত জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন
সমস্যাকে গৌণ করে ফেলতে পেরেছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে এই ‘শতাব্দীর সেরা
চুক্তি’ তারা পাস করিয়ে নিতে পারবে। তারা ভেবেছিল, আরব নেতাদের এটা বোঝানো
যাবে যে মূল সমস্যা হচ্ছে ইরান। আর ইরানের সঙ্গে আরব অঞ্চলের অন্যান্য
দেশের যুদ্ধ লাগলে ইসরায়েল আরবদের সমর্থন দেবে। তারা সৌদি আরব, ফিলিস্তিন ও
মিসরকে চাপ দিয়েছে। দেখা গেল, নিরাপত্তা পরিষদে অধিকৃত জেরুজালেমের আইনি
মর্যাদা নিয়ে যে ভোটাভুটি হয়েছে, তাতে নিরাপত্তা পরিষদ মোটামুটি সর্বসম্মত
রায় দিয়েছে।
১৪ সদস্যরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী করার বিরুদ্ধে
ভোট দেয়, যদিও শুধু যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দেয়। সাধারণ পরিষদের ১২৮ সদস্য
এর বিপক্ষে ভোট দেয়, আর পক্ষে ভোট দেয় মাত্র ৯ সদস্যরাষ্ট্র। এই ফলাফলের পর
আরব দেশগুলো মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি স্থগিত করার
আহ্বান জানিয়েছে। তারা এও বলেছে যে ওয়াশিংটনে আরব ও ইসলামি দেশগুলোর
প্রতিনিধিত্ব হ্রাস করতে হবে। আর ইসরায়েল রাষ্ট্র যে যুদ্ধাপরাধ ও
মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা
বলেছেন তাঁরা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও তৃতীয় ফিলিস্তিনি
বিক্ষোভের লোকপ্রিয় আহ্বানও শোনা গেছে। শুধু তা-ই নয়, ফিলিস্তিনি ও আরবদের
পূর্ণাঙ্গভাবে অসলো চুক্তি ত্যাগের আহ্বানও জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের অধীনে
গিয়ে দুই-রাষ্ট্র সমাধান এবং ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুসারে ফিলিস্তিন
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বানও জানানো হয়েছে, যার রাজধানী হবে জেরুজালেম।
জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তে আরব দেশগুলো জয়ের গন্ধ পেলেও আফ্রিকার দেশগুলো যে
ফিলিস্তিনের দাবিতে সমর্থন দিচ্ছে না, তার ওপর আলোকপাত করা দরকার। গত কয়েক
বছরে আফ্রিকায় ইসরায়েলি প্রভাব বৃদ্ধি এবং এই মহাদেশের প্রতি আরবদের
উপেক্ষার কারণে এমনটা হয়েছে। জাতিসংঘে আফ্রিকার যেসব দেশ মার্কিনদের পক্ষে
ভোট দিয়েছে, তার মধ্যে আছে টোগো। অন্য আরও সাতটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
অন্যরা সভায় অনুপস্থিত ছিল। মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশ তুর্কমেনিস্তান ভোটদানে
বিরত থাকলে তা আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় এক
ঘাঁটি আছে, সম্ভবত সেটাই তার কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ জার্মানি,
ফ্রান্স ও অন্যদিকে ব্রিটেন এ ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিলেও চেক
রিপাবলিক, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া ও রোমানিয়া ভোটদানে বিরত থাকে। সাধারণ
পরিষদে সুইসদের অনুপস্থিতিও অন্যদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। বিশেষ করে
সুইজারল্যান্ড মানবিক তৎপরতার জন্য খ্যাত। রেডক্রস ও জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর
দপ্তরও সেখানে অবস্থিত। ফলে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাদের অনুপস্থিতি
প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়া ভোটদানে বিরত থাকলে অনেকে
রাগান্বিত হন, যদিও আরবরা সব সময় তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল
থেকেছে। বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়ার শান্তির জন্য স্বাক্ষরিত ডেটন অ্যাকর্ডের
একটি প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল আছে, সেটিতে বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট—এই
তিনটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব আছে। বসনিয়ার প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের
সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেও সার্ব ও ক্রোয়েশীয়রা এর বিপক্ষে ছিল। সে কারণে তারা
ভোটদানে বিরত থাকে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কামাল গাবালা: মিসরীয় সাংবাদিক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কামাল গাবালা: মিসরীয় সাংবাদিক।
No comments