উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে এশিয়ার শহরগুলো
জাপানের
রাজধানী টোকিও এবং অন্যান্য শহর ২০১৮ সালের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা
দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বেসামরিক সুরক্ষার অবকাঠামো এবং পারমাণবিক হামলার
সরঞ্জামগুলো চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। স্কুলের শিশুরা
পারমাণবিক নিরাপত্তা মহড়া অনুশীলন করছে, যেমনটি কিনা আমরা আমাদের শৈশবে
করেছি স্নায়ু যুদ্ধের চূড়ান্ত সময়। পুলিশ ও জরুরি অবস্থায় প্রথমে যারা সাড়া
দেয়, তারা ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে যেসব উদ্যোগ এত দিন পরিত্যক্ত ছিল,
সেগুলো নিতে উদ্যোগী হয়েছে। হাসপাতালগুলো চাপ নিতে প্রস্তুত কি না, তার
পরীক্ষা চলছে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ থেকে লোকজনকে সুরক্ষা দেওয়ার
আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেসামরিক নাগরিকদের
সুরক্ষার জন্য নতুন উদ্ভাবন ও সম্পদগুলোর সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখা
হচ্ছে। এই প্রস্তুতির বেশির ভাগ উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকি ও
যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষ করে জাপানের ওপর দিয়ে
ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কারণে এই প্রস্তুতি। জাপানের বাইরে এশিয়ার অন্যান্য
শহরেও তাদের বেসামরিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য একই ধরনের
উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে শহরগুলো আরও অনেক কিছু করতে পারে, যা জরুরি অবস্থার
প্রস্তুতির পথকে আরও সুগম করবে। আর এ কারণে আমাদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে
মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় টোকিওর গভর্নরদের মতো আমিও
মনে করি না যে আমরা সত্যিই পরমাণু হামলার ভয়াবহতার মুখে পড়ব। টোকিওর
নাগরিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয়টি যখন সামনে আসে, তখন আমার সরকার ও
নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যে নির্দেশ দেয়, তা কখনোই খুব একটা সতর্কতামূলক হয়
না। আমাদের সামর্থ্যের চেয়ে যদি আমাদের প্রস্তুতি কম হয়, তা শুধু হঠকারিতাই
হবে না, ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলায় যারা মারা
গেছে, তাদের স্মৃতি অপমান করা হবে। পারমাণবিক হামলার ব্যাপারে জাপানের
একান্ত কিছু স্মৃতি থাকলেও এই সতর্কতা শুধু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। যদিও
টোকিওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমার প্রধান দায়িত্ব এবং আমার সব চিন্তা ও
পরিকল্পনার মূলে আছে শহরটি, তারপরও আমি দক্ষিণ কোরিয়ার ভাগ্য নিয়েও
উদ্বিগ্ন। আমি কোরিয়ার জনগণকে ভালোভাবে জানি। আমার মনে সন্দেহ নেই যে
তাঁরাও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার উগ্র ও নিষ্ঠুর
নেতা কিম জং-উনের খামখেয়ালিপনার কারণে সিউল বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আসলে এই অঞ্চলের কোনো শহর নিরাপদ নয়। এ কারণে এশিয়ার মেগা সিটিগুলোর
নেতাদের উচিত হবে এমন সব নীতি গ্রহণ করা, যা শুধু নিজের শহরই নয়, যেকোনো
ধরনের হুমকি থেকে গোটা অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে। আমরা মনে করি
জাতীয় সরকারগুলো আমাদের কথা শুনবে। মূলত, এশিয়ার অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার
জন্য এই অঞ্চলের শহরগুলোর অবদান রয়েছে। তাদের অবদান ছাড়া গত চার দশকে
এশিয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হতো না।
এবং এই শহরগুলোই এখন
আধুনিক এশীয় সমাজের মূল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সময় এসেছে, এখনই এশিয়ার
নগরনেতাদের এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে সবাইকে একত্র করে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম
জং-উনের হুমকির মাত্রা হ্রাস করতে হবে। এই লড়াই শুরু করার অর্থ এটা
নিশ্চিত করা যে অতীতে যেমনটি হয়েছে-উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের
নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল চিঠিতেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। একই সময়ে উত্তর কোরিয়ায়
অবৈধ সম্পদ স্থানান্তর প্রতিরোধ করতে এশিয়ার পৌরনেতাদের অবশ্যই পুলিশি
ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং অর্থ
স্থানান্তরের বেসরকারি নেটওয়ার্কগুলোর ওপর চাপ দিতে হবে, যাতে উত্তর
কোরিয়ায় কোনো ধরনের তহবিল না যায়। এশিয়ার বড় নেতাদের অবশ্যই চীনা
কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাঁদের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে,
যাতে সি চিন পিংয়ের প্রশাসন কিম জং-উনের শাসনের লাগাম টেনে ধরতে সর্বোচ্চ
চেষ্টা চালায়। সি চিন পিং এ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান
নিতে অনাগ্রহই দেখিয়েছেন। হয়তো কিম জং-উনের পতন ঘটলে চীনের সম্ভাব্য
পরিণতির কথা ভেবে চীনা নেতৃত্ব এমনটা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এশিয়ার
অন্যান্য দেশের মতো চীনও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে একই ধরনের হুমকির মুখে
রয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য শহরের মতো চীনের শহরগুলোও আজ অরক্ষিত। প্রকৃতপক্ষে
চীন এখন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করছে, যা কিনা উত্তর কোরিয়ার কাছে
বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে মনে হতে পারে। এ ব্যাপারে শুধু কথা বলে লাভ হবে
না, কারণ উত্তর কোরিয়ার উদ্দেশে সবচেয়ে উত্তপ্ত বাক্যটিও একেবারে অকার্যকর
প্রমাণিত হয়েছে। কথাকে কাজে পরিণত করা যায়নি। চীনকে এখন উত্তর কোরিয়াকে
পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া জাপান, দক্ষিণ
কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে চীনের সঙ্গে
চুক্তি করতে হবে, যাতে করে কোরীয় উপদ্বীপে কিম জং-উনের শাসনের পতন ঘটে। এ
ধরনের চুক্তি করা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ
কোরিয়া সবাই দুই কোরিয়ার শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের আশা করছে। তবে চীন যে
পরিণতির ভয়ে ভীত, তা দূর করার জন্য তাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে দক্ষিণ
কোরিয়ায় যে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি রয়েছে, তা চীন সীমান্তের দিকে যাবে
না। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি থাকলেও দুই দশক ধরে তাদের
সংখ্যা ক্রমেই কমছে এবং কোনো ধরনের পরমাণু অস্ত্রও সংযুক্ত হয়নি। দক্ষিণ
কোরিয়ার সরকার জাপানি ও মার্কিন মিত্রদের সমর্থন নিয়ে চীনকে আশ্বস্ত করার
কাজটি করতে পারে এই বলে যে দুই কোরিয়ার মধ্যকার বেসামরিক অঞ্চলে বিদেশি
সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে একটি চুক্তির প্রস্তাব
জাতিসংঘকে দেওয়া হয়েছে। এই বেসামরিক জোনই দুই কোরিয়াকে বিভক্ত করেছে। উত্তর
কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি একবার দূর হলে দক্ষিণ কোরিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাড সরিয়ে
ফেলতে পারবে। চীনও ভুলভাবে মনে করে যে থাড সিস্টেম তার পারমাণবিক সক্ষমতার
প্রতি হুমকি। আর এ ধরনের উদ্যোগ দুই দেশের ক্ষত উপশমে সাহায্য করতে পারে। এ
ব্যাপারে জাতিসংঘও ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনকে আরও অন্যান্য বিষয়ে
আশ্বস্ত করে এবং দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি না রেখে
জাতিসংঘ সেই সব দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী ও পরিদর্শক মোতায়েন করতে পারে।
অল্পসংখ্যক চীনা সৈন্য ও পরিদর্শককে এই দলে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এরা
জাতিসংঘের নিযুক্ত নেতাদের নির্দেশে কাজ করবে। এশিয়ার নগরগুলোর লক্ষ্য
হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের ভবিষ্যৎ পরমাণু যুদ্ধের
হুমকি থেকে মুক্ত থাকবে-এটা নিশ্চিত করার জন্য এখন আমরা অবশ্যই আমাদের সব
প্রভাবকে কাজে লাগাব।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান।
ইউরিকো কোইকে: জাপানের রাজধানী টোকিওর গভর্নর।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান।
ইউরিকো কোইকে: জাপানের রাজধানী টোকিওর গভর্নর।
No comments