সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণতন্ত্রের নিরাপত্তা by সামান্থা ব্র্যাডশ ও ফিলিপ এন হাওয়ার্ড
২০১৬
সালে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট ভোট, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ
পৃথিবীজুড়ে বেশ কিছু নির্বাচনের প্রচারণাকালে ফেসবুক ও টুইটারের মতো
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো রাজনীতি ও জননীতি সম্পর্কে ভোটারদের অনেক রকমের
তথ্য দিয়েছে। সেসব তথ্য অতি নিম্নমানের, প্রায়শই নির্জলা মিথ্যা প্রচার করা
হয়েছে। এ জন্য সেই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু
তা সত্ত্বেও ২০১৭ সালজুড়ে ভুয়া খবর, চাঞ্চল্যকর গল্পগুজব, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও
নানা রকমের মিথ্যা তথ্যের প্রবাহ অব্যাহত থেকেছে। দেশভিত্তিক তথ্য
যাচাইয়ের উদ্যোগ ক্রমশ বাড়ছে, ভেজাল খবর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নতুন নতুন
অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে, কিন্তু ওই সব প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্যবস্থাগত ও
কারিগরিভাবে সমস্যা সমাধানের উপায় তেমন একটা বাতলানো হচ্ছে না। তাহলে
ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কীভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির জন্য
নিরাপদ করা যাবে? আমরা জানি যে বিশ্বজুড়ে গণভোট, নির্বাচন ও সামরিক সংকটের
কালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ জিনিসপত্র
সরবরাহ করে, যেগুলো মানুষকে ব্যাপকভাবে বিভক্ত করে ফেলতে পারে। ২০১৬ সালে
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যত বেশি
পরিমাণে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পেশাদার সংবাদমাধ্যমগুলোতে ততটা হয়নি।
নির্বাচনের ঠিক আগের দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেজাল খবরের প্রচার
সর্বোচ্চ মাত্রায় উঠে গিয়েছিল। ক্রেমলিন-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপ্রতিষ্ঠান যেমন
রাশিয়া টুডে ও স্পুৎনিকও উচ্চমাত্রায় বিভাজন সৃষ্টিকারী খবরাখবর প্রচার
করেছে, উইকিলিকসের মতো ওয়েবসাইটও তাদের পূর্ব-অভিপ্রায় দ্বারা তাড়িত হয়ে
একই কাজ করেছে, অতিমাত্রায় পক্ষপাতপূর্ণ মন্তব্য-বিশ্লেষণ প্রচার করা হয়েছে
খবরের মোড়কে। এসব করা হয়েছে মিশিগান ও পেনসিলভ্যানিয়ার মতো রাজ্যগুলোতে,
যেখানে বিপুলসংখ্যক ভোটার ছিলেন দোদুল্যমান। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে এপ্রিল ও
মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে, জুনে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট
নির্বাচনে এবং জার্মানিতে সেপ্টেম্বরে ফেডারেল নির্বাচন এগিয়ে আসছিল বলে
২০১৭ সালের শুরু থেকেই।
বিশ্বজুড়ে ভেজাল খবর প্রচারের মাধ্যম হিসেবে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সংগঠিতভাবে ব্যবহার করার ফলে জনসাধারণের মধ্যে
সংশয়-সন্দেহের প্রবণতা দেখা দিয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
বিভাজন বেড়েছে এবং বৃহত্তর মিডিয়া অ্যাজেন্ডাও এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
ভেজাল খবর অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাগুলোতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর
তথাকথিত ‘সাফল্য’ প্রতিফলিত হয়। সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা জানেন, যেকোনো
সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ব্যাধিটি কীভাবে ছড়ায়, তা
বোঝা। ভেজাল খবর ছড়ানো হয় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি এবং নির্দিষ্ট মালিকানার
ব্ল্যাক বক্স অ্যালগরিদমের মাধ্যমে, যা নির্ধারণ করে কোনটা প্রাসঙ্গিক বা
প্রয়োজনীয় তথ্য বা খবর, কোনটা তা নয়। আমরা এটাকে বলি ‘গণনাভিত্তিক
উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা’ (কম্পিউটেশনাল প্রোপাগান্ডা)। কারণ এতে থাকে
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, যার
পেছনে থাকে ফেসবুক, গুগল ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
প্ল্যাটফর্মগুলোর শক্তি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত
নির্বাচনগুলোর পুরোটা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক
প্রচারণার বিজ্ঞাপন থেকে আয় করার জন্য অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে দৌড়ঝাঁপ করেছে।
এটা করতে গিয়ে তারা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই অনেক কিছু প্রচার করেছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সান আন্তোনিওতে ট্রাম্পের ডিজিটাল
ক্যাম্পেইন হেডকোয়ার্টারে ফেসবুক, গুগল ও টুইটারের ‘এমবেডেড কর্মী’রা
ছিলেন। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা ও মার্কেটিং ফার্ম
ফেসবুক, গুগল ও টুইটারে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে;
ভোটারদের মন ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারের পেছনে
তারা লাখ লাখ ডলার খরচ করেছে। এই সমস্যাগুলো কত ব্যাপক, তা বোঝার জন্য আমরা
নয়টি দেশে ‘গণনাভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা’ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের
উদ্যোগ নিই। এ ছাড়া আরও ২৮টি দেশে এই ক্ষেত্রের তুলনামূলক চিত্রের দিকে নজর
দিই। প্রথম নয়টি দেশ হলো ব্রাজিল, কানাডা, চীন, জার্মানি, পোল্যান্ড,
রাশিয়া, তাইওয়ান, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর অনুষ্ঠিত সুনির্দিষ্ট
কয়েকটি গণভোট ও নির্বাচনের সময় ‘গণনাভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা’ বেড়ে
যাওয়ার বিষয়টিও আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি (অতীতে আমরা এ রকম গবেষণা করেছি
মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলা নিয়ে)। এসব পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ থেকে আমরা যে
চিত্র পাই, তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ভালো বার্তা দেয় না। আমরা
যা দেখতে পাই, তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো, সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো রাজনৈতিক তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। এগুলোই তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠার প্রাথমিক মাধ্যম।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার রাজনৈতিক খবরাখবর
আদান-প্রদান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়। যেসব
দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটা অংশেরই শুধু ইন্টারনেট ও সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিতভাবে ব্যবহার করার সামর্থ্য ও সুযোগ আছে, সেসব দেশেও
সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের নেতারা ও রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে
আলাপ-আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হচ্ছে এই সব প্ল্যাটফর্ম। জনমত
প্রভাবিত করার কাজেও এগুলো ব্যবহার করা হয়, অবশ্য তা করা হয় ভিন্ন ভিন্ন
উপায়ে ও বিভিন্ন বিষয়ে। স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
ইত্যাদি প্রতিরোধ করার অন্যতম প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসংকটের সময়।
উদাহরণস্বরূপ রুশ টুইটারে যেসব রাজনৈতিক কথাবার্তা প্রচার করা হয়, সেগুলোর
প্রায় অর্ধেকই আসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত অ্যাকাউন্টগুলো থেকে। সবচেয়ে
বেশিসংখ্যক ভুয়া অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হয় পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মার্কেটিং
ফার্মগুলোর দ্বারা। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আমরা দেখতে পাই, সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যম সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে গণনাভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক
প্রচারণার কাজে; এটা করা হয় জনমত প্রভাবিত করার ব্যাপক প্রচেষ্টার মাধ্যমে
অথবা কোনো একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে।
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের নির্বাচনের আগে, ২০১৭ সালের
প্রথম দিকে তাঁর অভিশংসনের সময় এবং চলমান সাংবিধানিক সংকটে জনমত ও
তর্কবিতর্ক সৃষ্টিতে ইন্টারনেট রোবট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রতিটি দেশে আমরা দেখতে পাই, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গ্রুপ সংগঠিত মিথ্যা
প্রচারণা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলে,
তারা এই সব মিথ্যা প্রচারণা প্রতিহত করতে কাজ করবে এবং ইতিমধ্যেই কিছু
ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ভোটারদের প্রভাবিত অন্যান্য
দেশ কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখা শুরু
করেছে। গত বসন্তে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ প্রায়
৩০ হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। জুনে যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট
নির্বাচনের আগে আগে আরও কয়েক হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে, সেপ্টেম্বর
মাসে জার্মান নির্বাচনের আগেও হাজার হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে
দিয়েছে। কিন্তু শুধু ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেই এসব বন্ধ করা যাবে না;
ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে
সহায়তা জোগানোর সক্রিয় ও সৃজনশীল উদ্যোগ। ২০১৮ সালে আরও অনেক জটিল রাজনৈতিক
মুহূর্ত আসবে; মিসর, ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে সাধারণ নির্বাচন হবে এবং আগামী
নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে নীতিকৌশলবিদেরা
ইতিমধ্যে পরিকল্পনা করা শুরু করে দিয়েছেন। সুতরাং এই বছর ফেসবুকের মতো
প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রসারের সহায়ক সক্রিয় ও সৃজনশীল
উদ্যোগের প্রয়োজন আরও বাড়বে। মনে করা যাক, স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা
অব্যাহত রাখবে। আবার এটাও রাখতে হবে যে খ্যাতিমান সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে
পাওয়া খবর ও তথ্যের প্রচার বাড়ানো, নির্বাচনকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করা
এবং নাগরিক তৎপরতাকে উৎসাহিত করা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আদি প্রতিশ্রুতি ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে
সহায়তা করা, সেই প্রতিশ্রুতির সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য এখন সিস্টেম্যাটিক
উপায়ে পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবহারকারীদেরই দোষারোপ করতে চায়। গণতন্ত্রের ওপর
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কী প্রভাব পড়ছে, এসব মাধ্যমে প্রচারিত খবরাখবরের
সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের দায়িত্ব কার, তা জানতে আগ্রহী গবেষকদের সহযোগিতা করতে
ফেসবুক এখনো অস্বীকৃতি জানিয়ে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো নিজেরা ভেজাল, মিথ্যা ও নোংরা জিনিস তৈরি করে না,
কিন্তু তারা এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যার বলে ‘কম্পিউটেশনাল প্রোপাগান্ডা’
অত্যন্ত শক্তিশালী এক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং এখন তা ব্যবহার করা হচ্ছে
গণতন্ত্রের অবনমনের জন্য। সামান্থা ব্র্যাডশ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির
কম্পিউটেশনাল প্রোপাগান্ডা প্রজেক্টের গবেষক। ফিলিপ এন হাওয়ার্ড অক্সফোর্ড
ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের পরিচালক।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: মশিউল আলম
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: মশিউল আলম
No comments