সামরিক কারখানায় তৈরি সরকার by রবার্ট ফিস্ক
ইতিহাসে এমন ঘটনা প্রথম ঘটল যেখানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু তাকে সামরিক অভ্যুত্থান নামে ডাকা হচ্ছে না।
ক্ষমতা
নিয়েছে সেনাবাহিনী, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করে
বন্দী রাখা হয়েছে, সংবিধান স্থগিত, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে টেলিভিশন চ্যানেল।
রাজধানীর রাজপথ দখলে নিয়ে চলছে সাঁজোয়া যান। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান নামক
শব্দটা মহান ওবামার ঠোঁট থেকে বেরোচ্ছে না, বেরোতে পারবেও না। জাতিসংঘের
মহাসচিব বেচারা বান কি মুনেরও সাধ্য নেই এ রকম মারাত্মক একটি শব্দ উচ্চারণ
করেন। ব্যাপার এই নয় যে, কী ঘটছে, তা ওবামা জানেন না। গুপ্ত বন্দুকধারীরা
ছাদের ওপর থেকে গুলি করে এ সপ্তাহেই ১৫ মিসরীয়কে হত্যা করেছে। এই
হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, যেখানে ওবামা ২০০৯ সালে
মুসলিম দুনিয়ার উদ্দেশে বক্তৃতা করেছিলেন।
লাখো মিসরীয় এ রকম একটা অভ্যুত্থান দাবি করেছিল বলেই কি ওবামা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন? অবশ্য মুরসিবিরোধীরাও একে ক্যু বলছে না। এবং এভাবেই ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে আসল ক্যু ঘটার ঠিক আগে আগেই তার জন্য গণদাবি উঠল। ক্যু হয়েছে স্বীকার করে নিলে মিসরের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের বাধ্যবাধকতা চলে আসার ভয়েই কি ওবামা ভীত? যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি কায়েম করে আছে, তখন কীভাবে তিনি এত নিষ্ঠুর হবেন? নাকি তাহলে ক্যুর নায়কেরা চিরকালের মতো ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সামরিক সহায়তা হারাবে বলে তিনি চুপ করে আছেন? এই ভয় যদি থাকত, তাহলে বাস্তবে মিসরের সেনাবাহিনী কোনো ক্যু ঘটানোর সাহস করত না। ওবামা তাই চুপ করে দেখে যাওয়ার নীতি নিয়েছেন।
গত কয়েক দিনে মিসরের ঘটনাবলির মধ্যে এক বাস্তব সত্য লক্ষ করা যায়। সিরিয়ার আসাদের থেকে কেউ যেন বেশি খুশি নয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর থেকে আর কেউ ‘ইসলামপন্থী’ ও ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগ্রামে এত বেশি সন্তুষ্টও নয়, সজাগও নয়। আসাদকে ধ্বংসের কসরত করতে গিয়ে পশ্চিমারা নিজেদের ভিজিয়ে ফেলেছে। অথচ মিসরীয় সেনাবাহিনী যখন আসাদের প্রতিপক্ষ সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের পক্ষ নেওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফেলে দেয়, তখন তারা একটি আঙুলও নড়ায়নি। সেনাবাহিনীও মুরসির সমর্থকদের ‘সন্ত্রাসী ও গর্দভ’ বলে অভিহিত করে। ঠিক এই সম্ভাষণই কি আসাদও তাঁর শত্রুদের প্রতি করেন না? তাই আসাদ যখন বলেন, কারোরই উচিত নয় ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা অর্জন করা, তখন অবাক হওয়ার কিছু নেই। এসব দেখে আমরা কেবল আড়ালে ফাঁকা হাসি হেসে নিতে পারি।
কিন্তু তাতেই ওবামা রেহাই পেতে পারেন না। যেসব পশ্চিমা নেতা আমাদের নরম বদনে বলছেন যে মিসর এখনো ‘গণতন্ত্রের’ পথে আছে, বলছেন ‘আরে, এটা তো কেবল সাময়িক ব্যবস্থা’ তাঁদের মনে রাখা দরকার এ এমন এক ‘সাময়িক’ সরকার, যা তৈরি হয়েছে সামরিক কারখানায়। আরও মনে রাখা দরকার, মুরসি সত্যিকার ও পশ্চিমাদের অনুমোদিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, তিনি ৫১ শতাংশ অথবা ৫২ শতাংশ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু জর্জ ডব্লিউ বুশ কি আসলেই প্রথমবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন? মুরসি নিশ্চিতভাবেই বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের চেয়ে বেশি ভোটের অনুপাতে জয়ী হয়েছিলেন। হ্যাঁ, আমরা বলতে পারি, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সেবা করতে ব্যর্থ হওয়াতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনও তিনি খুইয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে, যখন জনমত জরিপে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীদের জনপ্রিয়তা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে আসে, তখন ইউরোপীয় সেনাবাহিনীগুলোর উচিত দেশের ক্ষমতা দখল করা? কথা এখানেই শেষ নয়, মুসলিম ব্রাদারহুডকে কি মিসরের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে দেয়া হবে? নাকি তাদের নিষিদ্ধ করা হবে? আর তারা যদি নির্বাচনে দাঁড়াতেও পারে, আবারও জয়ী হলে কী ঘটবে?
তবে ইসরায়েল ব্যাপক খুশি। ক্যু কেমন জিনিস, তা তারা ভালোই চেনে ও জানে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ঘোষিত একমাত্র ‘গণতন্ত্র’ হয়ে তারা দিব্যি আড়াল থেকে খেলছে অতি চেনা খেলা। ইসরায়েল কেবল একধরনের প্রতিবেশীদেরই পছন্দ করে: সেনাশাসক। আর মিসরের বিত্তশালী কিংমেকার সেনাবাহিনী যত দিন ওয়াশিংটনের কাছ থেকে বছরে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পেতে থাকবে তত দিন ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের দেশের শান্তি চুক্তিও অক্ষত থাকবে। হোক না তা মিসরের জনগণের একেবারেই অপছন্দের সম্পর্ক, অথচ তাদের নামেই তারা ঘটিয়েছে এক ক্যু-কিন্তু-ক্যু-না। তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা, যত দিন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সেই অভ্যুত্থানপীড়িত দেশ সফরে আসবে। এবং তখনই আপনারা জানতে পারবেন, তারা আসলে কী বিশ্বাস করে এবং নিশ্চিতভাবেই কায়রোয় যাদের সঙ্গে তারা দেখা করবে, তারা আর কেউ নয়, সেনা কর্মকর্তা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: বিখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ
লাখো মিসরীয় এ রকম একটা অভ্যুত্থান দাবি করেছিল বলেই কি ওবামা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন? অবশ্য মুরসিবিরোধীরাও একে ক্যু বলছে না। এবং এভাবেই ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে আসল ক্যু ঘটার ঠিক আগে আগেই তার জন্য গণদাবি উঠল। ক্যু হয়েছে স্বীকার করে নিলে মিসরের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের বাধ্যবাধকতা চলে আসার ভয়েই কি ওবামা ভীত? যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি কায়েম করে আছে, তখন কীভাবে তিনি এত নিষ্ঠুর হবেন? নাকি তাহলে ক্যুর নায়কেরা চিরকালের মতো ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সামরিক সহায়তা হারাবে বলে তিনি চুপ করে আছেন? এই ভয় যদি থাকত, তাহলে বাস্তবে মিসরের সেনাবাহিনী কোনো ক্যু ঘটানোর সাহস করত না। ওবামা তাই চুপ করে দেখে যাওয়ার নীতি নিয়েছেন।
গত কয়েক দিনে মিসরের ঘটনাবলির মধ্যে এক বাস্তব সত্য লক্ষ করা যায়। সিরিয়ার আসাদের থেকে কেউ যেন বেশি খুশি নয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর থেকে আর কেউ ‘ইসলামপন্থী’ ও ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগ্রামে এত বেশি সন্তুষ্টও নয়, সজাগও নয়। আসাদকে ধ্বংসের কসরত করতে গিয়ে পশ্চিমারা নিজেদের ভিজিয়ে ফেলেছে। অথচ মিসরীয় সেনাবাহিনী যখন আসাদের প্রতিপক্ষ সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের পক্ষ নেওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফেলে দেয়, তখন তারা একটি আঙুলও নড়ায়নি। সেনাবাহিনীও মুরসির সমর্থকদের ‘সন্ত্রাসী ও গর্দভ’ বলে অভিহিত করে। ঠিক এই সম্ভাষণই কি আসাদও তাঁর শত্রুদের প্রতি করেন না? তাই আসাদ যখন বলেন, কারোরই উচিত নয় ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা অর্জন করা, তখন অবাক হওয়ার কিছু নেই। এসব দেখে আমরা কেবল আড়ালে ফাঁকা হাসি হেসে নিতে পারি।
কিন্তু তাতেই ওবামা রেহাই পেতে পারেন না। যেসব পশ্চিমা নেতা আমাদের নরম বদনে বলছেন যে মিসর এখনো ‘গণতন্ত্রের’ পথে আছে, বলছেন ‘আরে, এটা তো কেবল সাময়িক ব্যবস্থা’ তাঁদের মনে রাখা দরকার এ এমন এক ‘সাময়িক’ সরকার, যা তৈরি হয়েছে সামরিক কারখানায়। আরও মনে রাখা দরকার, মুরসি সত্যিকার ও পশ্চিমাদের অনুমোদিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, তিনি ৫১ শতাংশ অথবা ৫২ শতাংশ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু জর্জ ডব্লিউ বুশ কি আসলেই প্রথমবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন? মুরসি নিশ্চিতভাবেই বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের চেয়ে বেশি ভোটের অনুপাতে জয়ী হয়েছিলেন। হ্যাঁ, আমরা বলতে পারি, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সেবা করতে ব্যর্থ হওয়াতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনও তিনি খুইয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে, যখন জনমত জরিপে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীদের জনপ্রিয়তা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে আসে, তখন ইউরোপীয় সেনাবাহিনীগুলোর উচিত দেশের ক্ষমতা দখল করা? কথা এখানেই শেষ নয়, মুসলিম ব্রাদারহুডকে কি মিসরের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে দেয়া হবে? নাকি তাদের নিষিদ্ধ করা হবে? আর তারা যদি নির্বাচনে দাঁড়াতেও পারে, আবারও জয়ী হলে কী ঘটবে?
তবে ইসরায়েল ব্যাপক খুশি। ক্যু কেমন জিনিস, তা তারা ভালোই চেনে ও জানে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ঘোষিত একমাত্র ‘গণতন্ত্র’ হয়ে তারা দিব্যি আড়াল থেকে খেলছে অতি চেনা খেলা। ইসরায়েল কেবল একধরনের প্রতিবেশীদেরই পছন্দ করে: সেনাশাসক। আর মিসরের বিত্তশালী কিংমেকার সেনাবাহিনী যত দিন ওয়াশিংটনের কাছ থেকে বছরে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পেতে থাকবে তত দিন ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের দেশের শান্তি চুক্তিও অক্ষত থাকবে। হোক না তা মিসরের জনগণের একেবারেই অপছন্দের সম্পর্ক, অথচ তাদের নামেই তারা ঘটিয়েছে এক ক্যু-কিন্তু-ক্যু-না। তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা, যত দিন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সেই অভ্যুত্থানপীড়িত দেশ সফরে আসবে। এবং তখনই আপনারা জানতে পারবেন, তারা আসলে কী বিশ্বাস করে এবং নিশ্চিতভাবেই কায়রোয় যাদের সঙ্গে তারা দেখা করবে, তারা আর কেউ নয়, সেনা কর্মকর্তা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: বিখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ
No comments