নির্বাচনী ফল এবং টেলিভিশনের ফলাহার by জাহিদ নেওয়াজ খান
টেলিভিশনে নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে ১৫
জুন চার সিটির নির্বাচনের আগে বাংলানিউজে ১২ জুন একটি লেখায় যে আশংকা
করেছিলাম, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৬ জুলাই তা সত্য হয়েছে।
বড়
কোনো অঘটন ঘটে না গেলেও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একে ‘ঘুম ভাঙার সতর্ক সংকেত’
হিসেবে না দেখলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় যে অপেক্ষা করছে তাতে কোনো সন্দেহ
নেই।
সম্ভাব্য এই বিপর্যয়ের কারণ, ফল প্রচারে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অপরিণামদর্শী প্রতিযোগিতা। আগের চার সিটিতেও ঘটেছিলো, তবে সর্বশেষ গাজীপুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতাটি চরমে উঠেছিলো। এতে হার-জিতের মূল ফলাফলে কোনো পরিবর্তন না হলেও কিছু চ্যানেলে এমন ভোট সংখ্যা দেখানো হয়, যাতে দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের পার্থক্য দুই লাখ, কাস্টিং ভোট ৮৫ শতাংশ; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
নির্বাচনে বিরোধীদল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করায় কোনো দল এবং প্রার্থীর পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু সেখানে যদি সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করতো, আর ভোটের ওইরকম তারতম্য দেখানোর পর তা অনেক কমে আসতো, তাহলে ভোট কারচুপি-মিডিয়া ক্যু’র অভিযোগে শুধু গাজীপুর নয়, তছনছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় থাকতো ঢাকাসহ অনেক শহর।
মিডিয়ার এরকম ভুলে বাংলাদেশের মতো দেশে কী হতে পারে তার একটি নমুনা ৬ মে আমরা দেখেছি। প্রায় সব টেলিভিশন চ্যানেলে সেদিন কিছুক্ষণের জন্য হেফাজতের আমির আহমদ শফিকে গ্রেফতারের ভুল খবর প্রচার হয়েছিলো। সর্বশেষ ‘তেঁতুল’ শফির খেতাব পাওয়া আহমদ শফিকে গ্রেফতার করা না করার সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক, সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ওইদিন লালবাগের মাদ্রাসা থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ তাকে বের করে নিয়ে আসার পর প্রায় সব চ্যানেলে গ্রেফতারের যে ভুল খবর প্রচার হয়, তাতে হাটহাজারিতে তুলকালাম ঘটে যায়। এক সেনা সদস্যসহ নিহত হন বেশ কয়েকজন।
ভাগ্য ভালো যে এবারের ভুলে সেরকম কিছু ঘটেনি। কিন্তু নির্বাচনী ফল প্রচারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এই যে অপরিণামদর্শিতা, তা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে তা শুধু অনুমানই করা যেতে পারে।
আগের লেখাতেও বলেছিলাম, আবারও বলি, নির্বাচনী ফল জানানোর ক্ষেত্রে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা গত জাতীয় নির্বাচনে শুরু।
বেসরকারি ফলাফল যে নির্বাচন আয়োজনের মূল কেন্দ্র রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়, সেটা অনেকে না জেনে, অথবা জেনেও এগিয়ে থাকার লোভে, কিংবা কোনো উদ্দেশ্যে; টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যার যেরকম ইচ্ছা ইলেকশন রেজাল্ট প্রচারের এক সংস্কৃতিতে নেমেছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের কথিত সূত্র কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন পরিচালনাকারী দপ্তর, স্বয়ং প্রার্থী, প্রার্থীদের এজেন্ট, পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং গোয়েন্দা সংস্থা। গত জাতীয় নির্বাচনে এইরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বেসরকারি চ্যানেলগুলো কিছুটা খেলো হলেও চট্টগ্রামে কিছুটা ছাড়া স্থানীয় অন্য নির্বাচন এবং উপনির্বাচনেও সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। এই প্রতিযোগিতায় এখন পর্র্যন্ত কোনো ফল বিপর্যয় না ঘটলেও মানুষের মধ্যে সন্দেহ এবং বিশ্বাসহীনতার জন্ম দিয়েছে অনেক।
১৫ জুন চার সিটি এবং ৬ জুলাই গাজীপুর নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই বলেছিলাম, এবারও যদি প্রার্থী, প্রার্থীদের এজেন্ট, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুমের বরাতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় কিংবা নির্বাচন কমিশনের আগে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফল ঘোষণা করা হয় তাহলে তা বড় ধরনের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। মূল ফল বদলে না গেলেও আগে-পরে ভোটের হিসাবে কোনো পার্থক্য থাকলে তা জন্ম দিতে পারে বড় কোনো প্রশ্নের।
গাজীপুরের নির্বাচনতো সেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলানিউজেই এক লেখায় তুষার আবদুল্লাহ তা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের মতো সঠিক ফলাফল জানানোও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সেখানে টেলিভিশন চ্যানেলে কিভাবে সঠিক ফল ঘোষণা হয়, তাও তাই নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নির্বাচন কমিশন কোনো বিধির আওতায় আনলে তা হয়তো অনেকের পছন্দ হবে না, কোনো বেড়াজাল দিলে তার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ফল ঘোষণা নিয়ে যে কোনো বিতর্ক এড়াতে, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নিজের দায়িত্বও কম নয়। এজন্য তাদের নিজ থেকেই উদ্যোগী হওয়া জরুরি।
এ জরুরি বিষয়টা আর কিছুই নয়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাগজের প্রমাণ ছাড়া টেলিভিশন পর্দায় কোনো ফল প্রচার করা হবে না। জাতীয় নির্বাচনে হাজার হাজার কেন্দ্রে দূরের কথা, একটি চ্যানেল যেহেতু একটি সিটির নির্বাচনে কয়েকশ’ কেন্দ্রেই সংবাদ কর্মী নিয়োগ দিতে পারে না; তাই কাগজের প্রমাণে সেই রেজাল্ট পাওয়ার জায়গা হলো রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়। সেখান থেকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত টেলিভিশনগুলো কি ধৈর্য্য দেখাতে পারে না!
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, রিটার্নিং অফিসারের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে তিনি তো কোনো কেন্দ্রের ফলাফল পাল্টেও দিতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় এরকম আশংকা খুবই কম। আর যদি সত্যিই রেজাল্ট পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে ওই কেন্দ্রের ফল সত্যিই কোনো রিপোর্টার কিংবা টেলিভিশনের কাছে থাকলে সেটা চ্যালেঞ্জ করা খুবই সম্ভব, সেটাও হতে পারে বড় কোনো খবর।
কিন্তু এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, কোনো লিখিত প্রমাণের ভিত্তিতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে ঘোষণার আগে টেলিভিশনগুলোতে ফল দেখানো হয়। এর পুরোটাই হয়, প্রার্থী কিংবা তার নির্বাচনী এজেন্ট এবং পুলিশ কন্ট্রোলরুম অথবা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে। যদি প্রার্থী অথবা তার এজেন্ট হন তাহলে সেটা তাদের দাবি, আর যদি পুলিশ কন্ট্রোল রুম অথবা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে হয়; তাহলে নিশ্চিতভাবেই সুনির্দিষ্ট সূত্র হিসেবে তারা তাদের নাম উল্লেখ করতে রাজি হবে না। যে সূত্র উল্লেখ করা যায় না, তাদের তথ্যের ভিত্তিতে কিভাবে টেলিভিশনে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা যায়!
শৈশব পেরোনো আমাদের টেলিভিশনগুলো যতো দ্রুত বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারবে ততোই মঙ্গল। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রাকিবউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। নিজের চেয়ার রক্ষায় বিরোধীদলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় পাস মার্ক পেয়ে যাওয়ার পর তিনি হয়তো টিভি চ্যানেলগুলোর সমালোচনা করে তাদের কাছে অপ্রিয় হতে চান না। তবে তারও মনে রাখা উচিত, এ বিষয়ে তিনি এখনই সতর্ক না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রাতে ফল ঘোষণা নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখনকার মতো যথেচ্ছাচার করলে তার পরিণতির দায়ভার তার উপরই আসবে।
মনে আছে, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে গভীর রাতে আমার এক বন্ধু ফোন করলেন। তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। আমাকে জানালেন, তার কাছে সব কেন্দ্র থেকে ফল এসেছে, তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আমরা কেনো তখনও তার ফল জানাচ্ছি না জানতে চাইলে বলেছিলাম, রিটার্নিং অফিসার কি পুরো ফল ঘোষণা করেছেন? তিনি ‘না’ বলার পর জানালাম, ওই কারণেই এখনও আমরা পুরো ফল দিতে পারছি না। তার কাছে পুরো ফল আছে জানানোর পর আবারও বলেছিলাম, রিটার্নিং অফিসারের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঘন্টা তিনেক পর পুরো ফল পেয়ে রিটার্নিং অফিসার তাকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন, আমরাও স্ক্রলে দেখাই, তিনি বিজয়ী। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি তার মেয়াদ প্রায় শেষ করে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আমি সেদিন ব্যক্তিগত বন্ধুর আবদার প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলাম, কারণ এটাই সাংবাদিকতার শিক্ষা। এখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নির্বাচনী ফল ঘোষণায় তাদের রাজনৈতিক বন্ধুত্বের আবদার প্রত্যাখ্যান করে সাংবাদিকতাটা করবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
তবে আশার দিক, সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ’র লেখা প্রমাণ করে টিভি চ্যানেলগুলো আত্মসমালোচনা শুরু করেছে। গাজীপুরের নির্বাচনে চ্যানেল আই প্রথম কয়েক ঘণ্টা শুধু রিটার্নিং অফিসারের আনুষ্ঠানিক বেসরকারি ফলাফল প্রচার করেছে। পরে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সামিল হতে বাধ্য হয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ঘোষিত ফলাফলের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে পাওয়া কিছু অনানুষ্ঠানিক ফলও প্রচার করেছে চ্যানেল আই। পর্দায় তাই আমরা দেখেছি, উপরে রিটার্নিং অফিসার দপ্তর সূত্রের ফলাফলের পাশাপাশি স্থানীয় সূত্রের বরাতে নীচে অনানুষ্ঠানিক ফলও প্রচার করা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচন যেহেতু খুব বেশি দূরে নয়, তাই নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ না নিলেও টিভি চ্যানেলগুলোর নিজেদেরই এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করা উচিত। কেউ পাঁচ লাখ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে দেখানোর পর তার প্রাপ্ত ভোট তিন লাখ দেখানো সাংবাদিকতার কোনো নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই, znewaz@gmail.com
সম্ভাব্য এই বিপর্যয়ের কারণ, ফল প্রচারে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অপরিণামদর্শী প্রতিযোগিতা। আগের চার সিটিতেও ঘটেছিলো, তবে সর্বশেষ গাজীপুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতাটি চরমে উঠেছিলো। এতে হার-জিতের মূল ফলাফলে কোনো পরিবর্তন না হলেও কিছু চ্যানেলে এমন ভোট সংখ্যা দেখানো হয়, যাতে দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের পার্থক্য দুই লাখ, কাস্টিং ভোট ৮৫ শতাংশ; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
নির্বাচনে বিরোধীদল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করায় কোনো দল এবং প্রার্থীর পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু সেখানে যদি সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করতো, আর ভোটের ওইরকম তারতম্য দেখানোর পর তা অনেক কমে আসতো, তাহলে ভোট কারচুপি-মিডিয়া ক্যু’র অভিযোগে শুধু গাজীপুর নয়, তছনছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় থাকতো ঢাকাসহ অনেক শহর।
মিডিয়ার এরকম ভুলে বাংলাদেশের মতো দেশে কী হতে পারে তার একটি নমুনা ৬ মে আমরা দেখেছি। প্রায় সব টেলিভিশন চ্যানেলে সেদিন কিছুক্ষণের জন্য হেফাজতের আমির আহমদ শফিকে গ্রেফতারের ভুল খবর প্রচার হয়েছিলো। সর্বশেষ ‘তেঁতুল’ শফির খেতাব পাওয়া আহমদ শফিকে গ্রেফতার করা না করার সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক, সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ওইদিন লালবাগের মাদ্রাসা থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ তাকে বের করে নিয়ে আসার পর প্রায় সব চ্যানেলে গ্রেফতারের যে ভুল খবর প্রচার হয়, তাতে হাটহাজারিতে তুলকালাম ঘটে যায়। এক সেনা সদস্যসহ নিহত হন বেশ কয়েকজন।
ভাগ্য ভালো যে এবারের ভুলে সেরকম কিছু ঘটেনি। কিন্তু নির্বাচনী ফল প্রচারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এই যে অপরিণামদর্শিতা, তা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে তা শুধু অনুমানই করা যেতে পারে।
আগের লেখাতেও বলেছিলাম, আবারও বলি, নির্বাচনী ফল জানানোর ক্ষেত্রে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা গত জাতীয় নির্বাচনে শুরু।
বেসরকারি ফলাফল যে নির্বাচন আয়োজনের মূল কেন্দ্র রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়, সেটা অনেকে না জেনে, অথবা জেনেও এগিয়ে থাকার লোভে, কিংবা কোনো উদ্দেশ্যে; টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যার যেরকম ইচ্ছা ইলেকশন রেজাল্ট প্রচারের এক সংস্কৃতিতে নেমেছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের কথিত সূত্র কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন পরিচালনাকারী দপ্তর, স্বয়ং প্রার্থী, প্রার্থীদের এজেন্ট, পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং গোয়েন্দা সংস্থা। গত জাতীয় নির্বাচনে এইরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বেসরকারি চ্যানেলগুলো কিছুটা খেলো হলেও চট্টগ্রামে কিছুটা ছাড়া স্থানীয় অন্য নির্বাচন এবং উপনির্বাচনেও সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। এই প্রতিযোগিতায় এখন পর্র্যন্ত কোনো ফল বিপর্যয় না ঘটলেও মানুষের মধ্যে সন্দেহ এবং বিশ্বাসহীনতার জন্ম দিয়েছে অনেক।
১৫ জুন চার সিটি এবং ৬ জুলাই গাজীপুর নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই বলেছিলাম, এবারও যদি প্রার্থী, প্রার্থীদের এজেন্ট, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুমের বরাতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় কিংবা নির্বাচন কমিশনের আগে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফল ঘোষণা করা হয় তাহলে তা বড় ধরনের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। মূল ফল বদলে না গেলেও আগে-পরে ভোটের হিসাবে কোনো পার্থক্য থাকলে তা জন্ম দিতে পারে বড় কোনো প্রশ্নের।
গাজীপুরের নির্বাচনতো সেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলানিউজেই এক লেখায় তুষার আবদুল্লাহ তা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের মতো সঠিক ফলাফল জানানোও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সেখানে টেলিভিশন চ্যানেলে কিভাবে সঠিক ফল ঘোষণা হয়, তাও তাই নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নির্বাচন কমিশন কোনো বিধির আওতায় আনলে তা হয়তো অনেকের পছন্দ হবে না, কোনো বেড়াজাল দিলে তার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ফল ঘোষণা নিয়ে যে কোনো বিতর্ক এড়াতে, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নিজের দায়িত্বও কম নয়। এজন্য তাদের নিজ থেকেই উদ্যোগী হওয়া জরুরি।
এ জরুরি বিষয়টা আর কিছুই নয়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাগজের প্রমাণ ছাড়া টেলিভিশন পর্দায় কোনো ফল প্রচার করা হবে না। জাতীয় নির্বাচনে হাজার হাজার কেন্দ্রে দূরের কথা, একটি চ্যানেল যেহেতু একটি সিটির নির্বাচনে কয়েকশ’ কেন্দ্রেই সংবাদ কর্মী নিয়োগ দিতে পারে না; তাই কাগজের প্রমাণে সেই রেজাল্ট পাওয়ার জায়গা হলো রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়। সেখান থেকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত টেলিভিশনগুলো কি ধৈর্য্য দেখাতে পারে না!
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, রিটার্নিং অফিসারের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে তিনি তো কোনো কেন্দ্রের ফলাফল পাল্টেও দিতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় এরকম আশংকা খুবই কম। আর যদি সত্যিই রেজাল্ট পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে ওই কেন্দ্রের ফল সত্যিই কোনো রিপোর্টার কিংবা টেলিভিশনের কাছে থাকলে সেটা চ্যালেঞ্জ করা খুবই সম্ভব, সেটাও হতে পারে বড় কোনো খবর।
কিন্তু এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, কোনো লিখিত প্রমাণের ভিত্তিতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে ঘোষণার আগে টেলিভিশনগুলোতে ফল দেখানো হয়। এর পুরোটাই হয়, প্রার্থী কিংবা তার নির্বাচনী এজেন্ট এবং পুলিশ কন্ট্রোলরুম অথবা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে। যদি প্রার্থী অথবা তার এজেন্ট হন তাহলে সেটা তাদের দাবি, আর যদি পুলিশ কন্ট্রোল রুম অথবা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে হয়; তাহলে নিশ্চিতভাবেই সুনির্দিষ্ট সূত্র হিসেবে তারা তাদের নাম উল্লেখ করতে রাজি হবে না। যে সূত্র উল্লেখ করা যায় না, তাদের তথ্যের ভিত্তিতে কিভাবে টেলিভিশনে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা যায়!
শৈশব পেরোনো আমাদের টেলিভিশনগুলো যতো দ্রুত বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারবে ততোই মঙ্গল। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রাকিবউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। নিজের চেয়ার রক্ষায় বিরোধীদলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় পাস মার্ক পেয়ে যাওয়ার পর তিনি হয়তো টিভি চ্যানেলগুলোর সমালোচনা করে তাদের কাছে অপ্রিয় হতে চান না। তবে তারও মনে রাখা উচিত, এ বিষয়ে তিনি এখনই সতর্ক না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রাতে ফল ঘোষণা নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখনকার মতো যথেচ্ছাচার করলে তার পরিণতির দায়ভার তার উপরই আসবে।
মনে আছে, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে গভীর রাতে আমার এক বন্ধু ফোন করলেন। তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। আমাকে জানালেন, তার কাছে সব কেন্দ্র থেকে ফল এসেছে, তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আমরা কেনো তখনও তার ফল জানাচ্ছি না জানতে চাইলে বলেছিলাম, রিটার্নিং অফিসার কি পুরো ফল ঘোষণা করেছেন? তিনি ‘না’ বলার পর জানালাম, ওই কারণেই এখনও আমরা পুরো ফল দিতে পারছি না। তার কাছে পুরো ফল আছে জানানোর পর আবারও বলেছিলাম, রিটার্নিং অফিসারের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঘন্টা তিনেক পর পুরো ফল পেয়ে রিটার্নিং অফিসার তাকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন, আমরাও স্ক্রলে দেখাই, তিনি বিজয়ী। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি তার মেয়াদ প্রায় শেষ করে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আমি সেদিন ব্যক্তিগত বন্ধুর আবদার প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলাম, কারণ এটাই সাংবাদিকতার শিক্ষা। এখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নির্বাচনী ফল ঘোষণায় তাদের রাজনৈতিক বন্ধুত্বের আবদার প্রত্যাখ্যান করে সাংবাদিকতাটা করবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
তবে আশার দিক, সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ’র লেখা প্রমাণ করে টিভি চ্যানেলগুলো আত্মসমালোচনা শুরু করেছে। গাজীপুরের নির্বাচনে চ্যানেল আই প্রথম কয়েক ঘণ্টা শুধু রিটার্নিং অফিসারের আনুষ্ঠানিক বেসরকারি ফলাফল প্রচার করেছে। পরে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সামিল হতে বাধ্য হয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ঘোষিত ফলাফলের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে পাওয়া কিছু অনানুষ্ঠানিক ফলও প্রচার করেছে চ্যানেল আই। পর্দায় তাই আমরা দেখেছি, উপরে রিটার্নিং অফিসার দপ্তর সূত্রের ফলাফলের পাশাপাশি স্থানীয় সূত্রের বরাতে নীচে অনানুষ্ঠানিক ফলও প্রচার করা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচন যেহেতু খুব বেশি দূরে নয়, তাই নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ না নিলেও টিভি চ্যানেলগুলোর নিজেদেরই এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করা উচিত। কেউ পাঁচ লাখ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে দেখানোর পর তার প্রাপ্ত ভোট তিন লাখ দেখানো সাংবাদিকতার কোনো নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই, znewaz@gmail.com
No comments