ভিন্নমত-মিসরে সেনা অভ্যুত্থান এবং অতঃপর by আবু আহমেদ
দুর্ভাগ্য, মিসরীয়দের বিপ্লব সহ্য হলো না।
মাত্র এক বছরের মধ্যে তারা তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির
বিরুদ্ধে সেই ইতিহাসখ্যাত তাহরির স্কয়ারে আবার জড়ো হলো।
স্লোগান তুলল, মুরসিকে আর চাই না, মুরসি তুমি নিপাত যাও, তোমার দল মুসলিম
ব্রাদারহুড নিপাত যাক। মুরসি এবং তাঁর বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষে দুই ডজনেরও
বেশি লোক মারাও গেল। সেনাবাহিনী যে বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হওয়ার কারণে আগেই
মুরসির ওপর বিক্ষুব্ধ ছিল, তারা মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিল। হয়
রাজনৈতিক সমঝোতা করো, নতুবা ক্ষমতা ছাড়ো। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী মুরসিকে
বন্দি করল, তাঁর দলের ৩০০ শীর্ষ নেতাকেও বন্দি করল। আনা হলো মঞ্চে সেই
প্রধান বিচারপতি মুনসুরকে, যিনি বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হওয়া সেই হোসনি
মুবারকের সময়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এখন অবস্থা হলো, দৃশ্যপটে হোসনি মুবারক নেই, কিন্তু ভিন্ন পোশাকে আবির্ভূত হয়েছে তাঁর পুরনো লোকেরাই। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কট্টর মুরসিবিরোধী সেক্যুলার মহিলাদের একাংশ এবং সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা। এখন মিসরে ক্ষমতায় যে পুনর্বিন্যাস হয়েছে, সেটাতে আর যাই হোক অন্তত অনেক দিনের জন্য বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বিদায় নেবে, নির্বাচন কখন হয়, কিভাবে হয় কেউ জানে না। নির্বাচন একটা হলেও সেই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হবে হোসনি মুবারকের সময়ের নির্বাচনের মতো- বিরোধী দলকে নানা শর্তের বেড়াজালে ফেলে দূরে রাখা হবে। পশ্চিমের এবং ইউরোপীয় নেতারা সেই অভ্যুত্থানকে ওপরে ওপরে না বলবে, তবে অবশেষে বলবে বাস্তবতার খাতিরে তারা মিসরের নতুন নেতৃত্বকে স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা নতুন সরকারের প্রতিও অব্যাহত থাকবে। সত্য হলো, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি হটে গেছেন, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না, তাদের কাছে মুরসি অনেক কারণেই অপছন্দের একজন ব্যক্তি। তারা এও জানে, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া অন্য কোনো দলের এমন কোনো নেতা নেই যে মিসরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে। তারা এও জানে যে যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তারা হলো আগা-গোড়ায় দুর্নীতিবাজ। লোকজন তাদের আপাতত মুরসির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পছন্দ করলেও অতি অল্পদিনের মধ্যে আবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে- মুরসির অনেক দোষ ছিল বটে, এর মধ্যে অনেকের কাছে অন্যতম দোষ হলো তিনি তাঁর ধর্ম ইসলামকে গৌরবের স্থানে বসাতে চেয়েছেন। মুরসি আর যাই হোক, অন্তত মুবারকের অনুসারীদের মতো দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। হ্যাঁ, মুরসির পক্ষে মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থনীতিকে আগের স্থানে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিপ্লবের সময় এবং পরে মিসর থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ বিদেশে চলে গেছে। ফলে সব মিসরীয়ই বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে নিজেকে দরিদ্র অনুভব করতে লাগল। তাদের অনেকের ধারণা, তারা তো আয়-রোজগারের দিক দিয়ে মুবারকের সময়ে ভালো ছিল। বেকার এবং দরিদ্র লোকদের হতাশা যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্রাদারহুডের ইসলামঘেঁষা সরকার উঁচুস্তরের অনেকের কাছে পছন্দ হয়নি। ফলে তাহরির স্কয়ার আবার বিক্ষুব্ধ লোকদের দ্বারা পূর্ণ হলো। সুযোগ নিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যারা সিদ্ধহস্ত, তারা। জনগণের রায়কে এক বছরের মধ্যে নস্যাৎ করে দিয়ে বন্দুকের জোরে মিসরে ভিন্ন নামে ফিরে এলো আবার সেনা শাসন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেনা শাসন তো আইন মানে না! তাদের কাজই হলো শাসনতন্ত্র স্থগিত করা। বিরোধীদের ঠেলে নেওয়া আর জাতিকে ঐক্যবদ্ধতার নামে অনেক আশ্বাসের কথা শোনানো। ইতিমধ্যে তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে রাজতন্ত্রের সৌদি আরব। নানা কারণে মুরসি সৌদিদের কাছে সন্দেহের ব্যক্তি ছিলেন না। মুরসিও ইসলাম চান, আবার সৌদি রাজা-বাদশাহরাও ইসলাম চান। তাহলে মুরসি এবং তাঁদের মধ্যে বিরোধ কেন? বিরোধ হলো এ জন্যই যে মুরসি চান গণমানুষের জন্য ইসলাম, আর সৌদি রাজতন্ত্র চায় তাদের মতো করে ইসলাম। সে জন্যই প্রায় সব উপসাগরীয় আমিরাত মিসরের নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। আর সেনাবাহিনী এবং প্রধান বিচারপতি মিলে এক দিনের মধ্যে তাঁদের অপছন্দের টিভি স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছেন। সামনে আরো ধরপাকড় হবে। এই ধরপাকড় হবে এ জন্য নয় যে মুরসির লোকেরা মিসরের সম্পদকে লুট করেছে। তাদের ধরা হবে যে জন্য সাবেক স্বৈরশাসক ৩৫ বছর পর্যন্ত তার বিরোধীদের জেলে রেখেছিলেন। মিসরের সামনে শুধুই দুর্দিন আসছে বলে মনে হয়। একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। মিসরীয়দের কাছে যে বিপ্লব এত সহজে তেতো হয়ে গেল, সেই বিপ্লবেরই বা কি প্রয়োজন ছিল? সামনে যে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির উত্থান ঘটবে, এমন আশা করা দুরূহ। অনেক মিসরীয়ই অচিরেই বুঝবে, তারা মস্তবড় একটা ভুল করেছে। তারা যাঁতাকলে নির্যাতিত হতে থাকবে, কিন্তু মত প্রকাশ করতে পারবে না। যে পাথর তাদের বুকের ওপর চেপে বসেছে, এই পাথর সরাতে আবার অনেক রক্তক্ষরণ হবে। অন্যকথা হলো মুরসির সাফল্য-ব্যর্থতা যতই থাকুক না কেন, মুরসি দেশ-বিদেশে অনেক সম্মান পেতেন। সবাই জানত মুরসি কারো ইঙ্গিতে চলেন না। আর আজকে যারা মিসরে ক্ষমতায় এসেছে তাদের লোকে অন্যের ভৃত্য বলেই মনে করবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এখন অবস্থা হলো, দৃশ্যপটে হোসনি মুবারক নেই, কিন্তু ভিন্ন পোশাকে আবির্ভূত হয়েছে তাঁর পুরনো লোকেরাই। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কট্টর মুরসিবিরোধী সেক্যুলার মহিলাদের একাংশ এবং সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা। এখন মিসরে ক্ষমতায় যে পুনর্বিন্যাস হয়েছে, সেটাতে আর যাই হোক অন্তত অনেক দিনের জন্য বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বিদায় নেবে, নির্বাচন কখন হয়, কিভাবে হয় কেউ জানে না। নির্বাচন একটা হলেও সেই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হবে হোসনি মুবারকের সময়ের নির্বাচনের মতো- বিরোধী দলকে নানা শর্তের বেড়াজালে ফেলে দূরে রাখা হবে। পশ্চিমের এবং ইউরোপীয় নেতারা সেই অভ্যুত্থানকে ওপরে ওপরে না বলবে, তবে অবশেষে বলবে বাস্তবতার খাতিরে তারা মিসরের নতুন নেতৃত্বকে স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা নতুন সরকারের প্রতিও অব্যাহত থাকবে। সত্য হলো, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি হটে গেছেন, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না, তাদের কাছে মুরসি অনেক কারণেই অপছন্দের একজন ব্যক্তি। তারা এও জানে, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া অন্য কোনো দলের এমন কোনো নেতা নেই যে মিসরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে। তারা এও জানে যে যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তারা হলো আগা-গোড়ায় দুর্নীতিবাজ। লোকজন তাদের আপাতত মুরসির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পছন্দ করলেও অতি অল্পদিনের মধ্যে আবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে- মুরসির অনেক দোষ ছিল বটে, এর মধ্যে অনেকের কাছে অন্যতম দোষ হলো তিনি তাঁর ধর্ম ইসলামকে গৌরবের স্থানে বসাতে চেয়েছেন। মুরসি আর যাই হোক, অন্তত মুবারকের অনুসারীদের মতো দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। হ্যাঁ, মুরসির পক্ষে মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থনীতিকে আগের স্থানে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিপ্লবের সময় এবং পরে মিসর থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ বিদেশে চলে গেছে। ফলে সব মিসরীয়ই বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে নিজেকে দরিদ্র অনুভব করতে লাগল। তাদের অনেকের ধারণা, তারা তো আয়-রোজগারের দিক দিয়ে মুবারকের সময়ে ভালো ছিল। বেকার এবং দরিদ্র লোকদের হতাশা যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্রাদারহুডের ইসলামঘেঁষা সরকার উঁচুস্তরের অনেকের কাছে পছন্দ হয়নি। ফলে তাহরির স্কয়ার আবার বিক্ষুব্ধ লোকদের দ্বারা পূর্ণ হলো। সুযোগ নিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যারা সিদ্ধহস্ত, তারা। জনগণের রায়কে এক বছরের মধ্যে নস্যাৎ করে দিয়ে বন্দুকের জোরে মিসরে ভিন্ন নামে ফিরে এলো আবার সেনা শাসন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেনা শাসন তো আইন মানে না! তাদের কাজই হলো শাসনতন্ত্র স্থগিত করা। বিরোধীদের ঠেলে নেওয়া আর জাতিকে ঐক্যবদ্ধতার নামে অনেক আশ্বাসের কথা শোনানো। ইতিমধ্যে তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে রাজতন্ত্রের সৌদি আরব। নানা কারণে মুরসি সৌদিদের কাছে সন্দেহের ব্যক্তি ছিলেন না। মুরসিও ইসলাম চান, আবার সৌদি রাজা-বাদশাহরাও ইসলাম চান। তাহলে মুরসি এবং তাঁদের মধ্যে বিরোধ কেন? বিরোধ হলো এ জন্যই যে মুরসি চান গণমানুষের জন্য ইসলাম, আর সৌদি রাজতন্ত্র চায় তাদের মতো করে ইসলাম। সে জন্যই প্রায় সব উপসাগরীয় আমিরাত মিসরের নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। আর সেনাবাহিনী এবং প্রধান বিচারপতি মিলে এক দিনের মধ্যে তাঁদের অপছন্দের টিভি স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছেন। সামনে আরো ধরপাকড় হবে। এই ধরপাকড় হবে এ জন্য নয় যে মুরসির লোকেরা মিসরের সম্পদকে লুট করেছে। তাদের ধরা হবে যে জন্য সাবেক স্বৈরশাসক ৩৫ বছর পর্যন্ত তার বিরোধীদের জেলে রেখেছিলেন। মিসরের সামনে শুধুই দুর্দিন আসছে বলে মনে হয়। একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। মিসরীয়দের কাছে যে বিপ্লব এত সহজে তেতো হয়ে গেল, সেই বিপ্লবেরই বা কি প্রয়োজন ছিল? সামনে যে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির উত্থান ঘটবে, এমন আশা করা দুরূহ। অনেক মিসরীয়ই অচিরেই বুঝবে, তারা মস্তবড় একটা ভুল করেছে। তারা যাঁতাকলে নির্যাতিত হতে থাকবে, কিন্তু মত প্রকাশ করতে পারবে না। যে পাথর তাদের বুকের ওপর চেপে বসেছে, এই পাথর সরাতে আবার অনেক রক্তক্ষরণ হবে। অন্যকথা হলো মুরসির সাফল্য-ব্যর্থতা যতই থাকুক না কেন, মুরসি দেশ-বিদেশে অনেক সম্মান পেতেন। সবাই জানত মুরসি কারো ইঙ্গিতে চলেন না। আর আজকে যারা মিসরে ক্ষমতায় এসেছে তাদের লোকে অন্যের ভৃত্য বলেই মনে করবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments