সুস্থ সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও তার ভাষা by ড. মীজানূর রহমান শেলী
প্রবাদ আছে 'নামে কী আসে যায়, বলা হয়,
গোলাপকে যে নামেই ডাকে, গন্ধ বিলাবে।' সেই সূত্র ধরে কি বলা যায়, যে
ভাষাতেই কথা বলা হোক না কেন, গণতন্ত্রের রূপ অক্ষুণ্ন থাকে।
আজকের বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতিতে যে ভাষার প্রয়োগ আমরা দেখি বা শুনি,
তাকে কি গণতন্ত্রসম্মত, গণতন্ত্রবান্ধব বলা যায়? যদি যেত তাহলে আগের চেয়ে
ভয়াবহ ভাষায় কোনো কোনো নারী সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে বিপক্ষ দলের
নেতা-নেত্রী বা তাঁদের পরিবারের নিন্দা করতেন না।
গত ২০ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এক মহিলা সদস্য অত্যন্ত অপরিশ্রুত ভাষায় বিরোধী দলের শীর্ষ নেত্রী ও তাঁর পূর্বপুরুষ এবং উত্তরপুরুষদের সম্পর্কে তীব্র নিন্দা করেন। কথায় বলে, 'ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।' তিন দিন যেতে না যেতেই বিরোধী দলের এক মহিলা সংসদ সদস্য তীক্ষ্ন, অপরিশীলিত বাক্যবাণে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেত্রী, তাঁর পূর্বপুরুষ ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে নিন্দাসূচক বক্তব্য দেন। সংসদের অভিভাবক স্পিকার যিনি নিজেও একজন মহিলা, ছয় ছয়বার সংশ্লিষ্ট সদস্যের মাইক বন্ধ করেও তাঁর বাক্যস্রোতের অনর্গল প্রবাহ রোধ করতে পারেননি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ ও ভাষ্যে বলা হয়, 'আবারও অশ্লীলতা, চরিত্রহনন ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঝড় বইল জাতীয় সংসদে। চরিত্রহননের এই ধারা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাদ যাননি। তারেক রহমান, সজীব ওয়াজেদ জয় আর আরাফাত রহমান কোকোর নাম তো ছিলই। স্পিকারের রুলিং, বারবার মাইক বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও সংসদে অশ্লীল ঝগড়ার তুবড়ী থামেনি।' (দৈনিক ইত্তেফাক ২৪ জুন, ২০১৩ খ্রি., প্রথম পৃষ্ঠা)।
কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন বক্তব্য আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করে আসছে বেশ কিছু বছর ধরেই। শুধু মেঠো রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গনেই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আইন সভা জাতীয় সংসদেও এই কলঙ্কিত ভাষার অনুরণন শোনা যায়। সবাই নন, কিছু কিছু রাজনীতিবিদ, বিশেষত মধ্য বা পেছনের সারির রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশ স্পষ্টই পরিলক্ষিত হয়। সামনের সারির রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সচরাচর এমন ভাষা ব্যবহার না করলেও যেসব দলীয় কর্মী ও সমর্থক বা সংসদ সদস্য এ ধরনের নিন্দনীয় ভাষা ব্যবহার করেন, তাঁদের দৃশ্যতই প্রশ্রয় দেন। কোনো বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেতাই প্রকাশ্যে বা গোপনে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। বরং গুজব রয়েছে অনেক উঁচু পর্যায়ের নেতা-নেত্রীই কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বক্তব্য যাঁরা দেন, তাঁদের উৎসাহ জোগান, পুরস্কার দেন এবং সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতিও দেন।
এতে করে পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন যে রাজনীতির ভাষার এই বিকৃতি এবং মারাত্মক অবনতি সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির অবক্ষয় ও অধোন্নতিরই স্পষ্টসূচক।
আসলে ভাষা নয়, মনেরই অবক্ষয় ও অধঃপতন ঘটেছে। যে মানসিকতা না থাকলে, যে দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ঘটলে এবং যে সংস্কৃতির অবক্ষয় হলে গণতন্ত্র বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রের মত পরিশীলিত ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে না, তা-ই আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক করুণ দশার জন্য দায়ী।
এই অবক্ষয়ই মন-মানসিকতায় পরমতসহিষ্ণুতার প্রচণ্ড অভাব। যে সহনশীলতা ও সহযোগিতা না থাকলে আধুনিক গণতন্ত্র সুস্থভাবে কাজ করতে পারে না, তার দুর্ভিক্ষে দেশ ও জাতি জর্জরিত। অন্তঃরসারশূন্য, জীর্ণশীর্ণ এই তথাকথিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাই সাংবিধানিক বিরোধী দলের অর্থবহ অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতাসীন দল তা অতীতেরই হোক বা বর্তমানের বিরোধী দলকে তার ন্যায্য অধিকার রক্ষার ও যথার্থ রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার অবকাশ দেয় না। এ ব্যাপারে প্রায় সব দলই একই আচরণ করে যায়। ক্ষমতায় গেলেই তারা অতীত ভুলে যায়, ভবিষ্যতের কথাও মনে করে না। ক্ষমতাসীন হয়ে তারা ক্ষমতাকে নিজেদের জন্য এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করে। তার ফলেই বিরোধী দলের ওপর নেমে আসে নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের প্রবল খৰাঘাত।
পক্ষান্তরে কোণঠাসা বিরোধী দল সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথ-পন্থা ছেড়ে অনেক সময়ই সহিংস ও সন্ত্রাসী পন্থায় সরকারকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চায়, ক্ষমতা থেকে চায় তাদের আশু অপসারণ এবং চির নির্বাসন। এই পরিস্থিতিতে ধৈর্যশীলতা এবং সহিষ্ণুতা দুই পক্ষ থেকেই বিদায় নেয়। সেই শূন্যতা পূরণ করে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন পারস্পরিক নিন্দাবাদ।
যাদের আমরা কোমলমতি এবং সুশীল বলে জানি, সেই নারী সমাজের কোনো কোনো অংশ, তা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, এই বিষাক্ত ও কলঙ্কিত বাক্যবাণে সারা পরিবেশ কলুষিত করে, তখন হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। উদাহরণস্বরূপ পত্রিকায় প্রকাশিত বিরোধী দলের এক মহিলা সদস্য জাতীয় সংসদে বলেন, 'আমরা এত সুন্দর ভাষায় কথা বলছি। অথচ তারা বলে আমরা নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষায় কথা বলি। কিন্তু তাদের নারী সদস্যরা যে ভাষায় কথা বলে সেটা তো নিষিদ্ধ পল্লীর সর্দারনীর ভাষা।' (দৈনিক ইত্তেফাক ২৪ জুন, ২০১৩ খ্রি., পৃষ্ঠা পঞ্চম)।
বর্তমানের এই বেদনাদায়ক ও যন্ত্রণাকর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে এ দেশেরই সংসদে বাক্য বিনিময় ও বিতর্কের কথা অলীক স্বপ্ন মনে হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, পাকিস্তানের অন্তরলীন ঔপনিবেশিক সময়েও এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে কিছুকাল আগেও আমরা সংসদে দেখেছি সুন্দর এবং পরিশীলিত বাগ্বিতণ্ডা। তখন রাজনীতি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই জাতীয় সংসদেও সুশীল সভ্য ভাষায় শানিত যুক্তি-তর্ক পেশ করতেন সরকারি ও বিরোধী উভয় দলেরই সংসদ সদস্যরা। শুধু সময়ের হেরফেরে, কালের অবক্ষয়ী পরিবর্তনে আজ সারা রাজনীতির মতো সর্বোচ্চ আইন পরিষদেও স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় যুক্তি-যৌক্তিকতাহীন বাক্যবাণে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করে চলছে। এতে না সংশ্লিষ্ট দল, না গণতন্ত্রের, না দেশের মঙ্গল হচ্ছে।
সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার ধারক অন্যান্য দেশে অত্যন্ত দুর্দিনেও বোধ হয় এমনটি হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত যুক্তরাজ্য বা গ্রেট ব্রিটেনে মহাযুদ্ধ বিধ্বস্ত, বিব্রত ব্যতিব্যস্ত থাকাকালেও সংসদীয় বিতর্কে দেখা গেছে বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক বাগ্বিতণ্ডার নজির। বলা হয়, লেডি অ্যাস্টর যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, If I were his wife, I would have put poison in his coffee এমন মারাত্মক বাক্য-হামলায়ও নির্বিকার চার্চিল নাকি সমান জোরালো রসিকতায় উত্তর দেন, If I were your husband, my lady, I would have gladly drunk that coffee - 'আমি যদি আপনার স্বামী হতাম, তাহলে আমি সানন্দে সেই কফি পান করতাম।'
এ ঘটনারও আগের কালের কথা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডিজারেয়লি ও বিরোধী নেতা গ্ল্যাডস্টোনের মধ্যে উত্তপ্ত অথচ রসময় বাক্যবিনিময়ের নজির দেখা গেছে। গ্ল্যাডস্টোন একদিন পার্লামেন্টের অধিবেশনে রাগান্বিত হয়ে বলেন, 'My friend, the Prime Minister does not know the deference between misfortune and disaster! 'আমার বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী দুর্ভাগ্য এবং দুর্বিপাকের মধ্যকার তফাৎ জানেন না।' উত্তরে ডিজরায়লি হাসিমুখে বলেন, মি. স্পিকার I know the difference. If my friend opposition leader Gladstone, were to fall in the frozen river Themes, it would have been a misfortune, if somebody rescued him, it would have been a disaster! মি. স্পিকার আমার বন্ধু বিরোধীদলীয় নেতা গ্ল্যাডস্টোন যদি বরফে জমাট বাঁধা টেমস নদীতে পড়ে হাবুডুবু খেতেন তা হতো একটা দুর্ভাগ্য, আর কেউ যদি তাঁকে উদ্ধার করত তাহলে তা হয়ে দাঁড়াত এক দুর্বিপাক!' এই শানিত অথচ পরিশীলিত ভাষায় সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান নায়করা পারস্পরিক আক্রমণের শালীন উদাহরণ রেখে গেছেন। আজকের রাজনীতিকদের মধ্যে অনেক সময়েই আমরা সেই শালীনতা ও সুস্থ সংস্কৃতির নজির দেখতে পাই না।
দেশে রাজনীতি যখন দিশাহারা, নীতি-নৈতিকতা যখন সমাজের উচ্চস্তরে কিছুসংখ্যক প্রভাবশালীর মধ্যে অনুপস্থিত, লোভ এবং ঘুষের বিস্তৃত বেড়াজালে অর্থনীতি যখন করুণ দশায়, তখন সংসদে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির অশালীন কথাবার্তা, প্রতিপক্ষের চরিত্রহনন সমাজের মন ও মানুষকে আরো বিভ্রান্ত ও বিষণ্ন করে।
তবে আশার কথা, এই সময়েই দুই পক্ষের দায়িত্বশীল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই অসংযত আচরণ ও বাক্যবাণ রোধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি ও সমাজের ব্যাধি আরো গভীর, এই রোগ নিরাময় করতে হলে শিকড় ধরে টান দিতে হবে। ক্ষমতার লড়াইয়ে সংকীর্ণ, কুটিল ও স্বার্থান্ধ পথে না চলে যাত্রা করতে হবে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে। সে পথ পারস্পরিক সহনশীলতার পথ, সহযোগিতার পথ।
লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক
mrshelley43@gmail.com
গত ২০ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এক মহিলা সদস্য অত্যন্ত অপরিশ্রুত ভাষায় বিরোধী দলের শীর্ষ নেত্রী ও তাঁর পূর্বপুরুষ এবং উত্তরপুরুষদের সম্পর্কে তীব্র নিন্দা করেন। কথায় বলে, 'ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।' তিন দিন যেতে না যেতেই বিরোধী দলের এক মহিলা সংসদ সদস্য তীক্ষ্ন, অপরিশীলিত বাক্যবাণে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেত্রী, তাঁর পূর্বপুরুষ ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে নিন্দাসূচক বক্তব্য দেন। সংসদের অভিভাবক স্পিকার যিনি নিজেও একজন মহিলা, ছয় ছয়বার সংশ্লিষ্ট সদস্যের মাইক বন্ধ করেও তাঁর বাক্যস্রোতের অনর্গল প্রবাহ রোধ করতে পারেননি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ ও ভাষ্যে বলা হয়, 'আবারও অশ্লীলতা, চরিত্রহনন ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঝড় বইল জাতীয় সংসদে। চরিত্রহননের এই ধারা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাদ যাননি। তারেক রহমান, সজীব ওয়াজেদ জয় আর আরাফাত রহমান কোকোর নাম তো ছিলই। স্পিকারের রুলিং, বারবার মাইক বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও সংসদে অশ্লীল ঝগড়ার তুবড়ী থামেনি।' (দৈনিক ইত্তেফাক ২৪ জুন, ২০১৩ খ্রি., প্রথম পৃষ্ঠা)।
কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন বক্তব্য আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করে আসছে বেশ কিছু বছর ধরেই। শুধু মেঠো রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গনেই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আইন সভা জাতীয় সংসদেও এই কলঙ্কিত ভাষার অনুরণন শোনা যায়। সবাই নন, কিছু কিছু রাজনীতিবিদ, বিশেষত মধ্য বা পেছনের সারির রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশ স্পষ্টই পরিলক্ষিত হয়। সামনের সারির রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সচরাচর এমন ভাষা ব্যবহার না করলেও যেসব দলীয় কর্মী ও সমর্থক বা সংসদ সদস্য এ ধরনের নিন্দনীয় ভাষা ব্যবহার করেন, তাঁদের দৃশ্যতই প্রশ্রয় দেন। কোনো বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেতাই প্রকাশ্যে বা গোপনে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। বরং গুজব রয়েছে অনেক উঁচু পর্যায়ের নেতা-নেত্রীই কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বক্তব্য যাঁরা দেন, তাঁদের উৎসাহ জোগান, পুরস্কার দেন এবং সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতিও দেন।
এতে করে পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন যে রাজনীতির ভাষার এই বিকৃতি এবং মারাত্মক অবনতি সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির অবক্ষয় ও অধোন্নতিরই স্পষ্টসূচক।
আসলে ভাষা নয়, মনেরই অবক্ষয় ও অধঃপতন ঘটেছে। যে মানসিকতা না থাকলে, যে দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ঘটলে এবং যে সংস্কৃতির অবক্ষয় হলে গণতন্ত্র বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রের মত পরিশীলিত ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে না, তা-ই আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক করুণ দশার জন্য দায়ী।
এই অবক্ষয়ই মন-মানসিকতায় পরমতসহিষ্ণুতার প্রচণ্ড অভাব। যে সহনশীলতা ও সহযোগিতা না থাকলে আধুনিক গণতন্ত্র সুস্থভাবে কাজ করতে পারে না, তার দুর্ভিক্ষে দেশ ও জাতি জর্জরিত। অন্তঃরসারশূন্য, জীর্ণশীর্ণ এই তথাকথিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাই সাংবিধানিক বিরোধী দলের অর্থবহ অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতাসীন দল তা অতীতেরই হোক বা বর্তমানের বিরোধী দলকে তার ন্যায্য অধিকার রক্ষার ও যথার্থ রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার অবকাশ দেয় না। এ ব্যাপারে প্রায় সব দলই একই আচরণ করে যায়। ক্ষমতায় গেলেই তারা অতীত ভুলে যায়, ভবিষ্যতের কথাও মনে করে না। ক্ষমতাসীন হয়ে তারা ক্ষমতাকে নিজেদের জন্য এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করে। তার ফলেই বিরোধী দলের ওপর নেমে আসে নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের প্রবল খৰাঘাত।
পক্ষান্তরে কোণঠাসা বিরোধী দল সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথ-পন্থা ছেড়ে অনেক সময়ই সহিংস ও সন্ত্রাসী পন্থায় সরকারকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চায়, ক্ষমতা থেকে চায় তাদের আশু অপসারণ এবং চির নির্বাসন। এই পরিস্থিতিতে ধৈর্যশীলতা এবং সহিষ্ণুতা দুই পক্ষ থেকেই বিদায় নেয়। সেই শূন্যতা পূরণ করে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন পারস্পরিক নিন্দাবাদ।
যাদের আমরা কোমলমতি এবং সুশীল বলে জানি, সেই নারী সমাজের কোনো কোনো অংশ, তা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, এই বিষাক্ত ও কলঙ্কিত বাক্যবাণে সারা পরিবেশ কলুষিত করে, তখন হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। উদাহরণস্বরূপ পত্রিকায় প্রকাশিত বিরোধী দলের এক মহিলা সদস্য জাতীয় সংসদে বলেন, 'আমরা এত সুন্দর ভাষায় কথা বলছি। অথচ তারা বলে আমরা নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষায় কথা বলি। কিন্তু তাদের নারী সদস্যরা যে ভাষায় কথা বলে সেটা তো নিষিদ্ধ পল্লীর সর্দারনীর ভাষা।' (দৈনিক ইত্তেফাক ২৪ জুন, ২০১৩ খ্রি., পৃষ্ঠা পঞ্চম)।
বর্তমানের এই বেদনাদায়ক ও যন্ত্রণাকর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে এ দেশেরই সংসদে বাক্য বিনিময় ও বিতর্কের কথা অলীক স্বপ্ন মনে হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, পাকিস্তানের অন্তরলীন ঔপনিবেশিক সময়েও এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে কিছুকাল আগেও আমরা সংসদে দেখেছি সুন্দর এবং পরিশীলিত বাগ্বিতণ্ডা। তখন রাজনীতি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই জাতীয় সংসদেও সুশীল সভ্য ভাষায় শানিত যুক্তি-তর্ক পেশ করতেন সরকারি ও বিরোধী উভয় দলেরই সংসদ সদস্যরা। শুধু সময়ের হেরফেরে, কালের অবক্ষয়ী পরিবর্তনে আজ সারা রাজনীতির মতো সর্বোচ্চ আইন পরিষদেও স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় যুক্তি-যৌক্তিকতাহীন বাক্যবাণে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করে চলছে। এতে না সংশ্লিষ্ট দল, না গণতন্ত্রের, না দেশের মঙ্গল হচ্ছে।
সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার ধারক অন্যান্য দেশে অত্যন্ত দুর্দিনেও বোধ হয় এমনটি হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত যুক্তরাজ্য বা গ্রেট ব্রিটেনে মহাযুদ্ধ বিধ্বস্ত, বিব্রত ব্যতিব্যস্ত থাকাকালেও সংসদীয় বিতর্কে দেখা গেছে বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক বাগ্বিতণ্ডার নজির। বলা হয়, লেডি অ্যাস্টর যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, If I were his wife, I would have put poison in his coffee এমন মারাত্মক বাক্য-হামলায়ও নির্বিকার চার্চিল নাকি সমান জোরালো রসিকতায় উত্তর দেন, If I were your husband, my lady, I would have gladly drunk that coffee - 'আমি যদি আপনার স্বামী হতাম, তাহলে আমি সানন্দে সেই কফি পান করতাম।'
এ ঘটনারও আগের কালের কথা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডিজারেয়লি ও বিরোধী নেতা গ্ল্যাডস্টোনের মধ্যে উত্তপ্ত অথচ রসময় বাক্যবিনিময়ের নজির দেখা গেছে। গ্ল্যাডস্টোন একদিন পার্লামেন্টের অধিবেশনে রাগান্বিত হয়ে বলেন, 'My friend, the Prime Minister does not know the deference between misfortune and disaster! 'আমার বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী দুর্ভাগ্য এবং দুর্বিপাকের মধ্যকার তফাৎ জানেন না।' উত্তরে ডিজরায়লি হাসিমুখে বলেন, মি. স্পিকার I know the difference. If my friend opposition leader Gladstone, were to fall in the frozen river Themes, it would have been a misfortune, if somebody rescued him, it would have been a disaster! মি. স্পিকার আমার বন্ধু বিরোধীদলীয় নেতা গ্ল্যাডস্টোন যদি বরফে জমাট বাঁধা টেমস নদীতে পড়ে হাবুডুবু খেতেন তা হতো একটা দুর্ভাগ্য, আর কেউ যদি তাঁকে উদ্ধার করত তাহলে তা হয়ে দাঁড়াত এক দুর্বিপাক!' এই শানিত অথচ পরিশীলিত ভাষায় সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান নায়করা পারস্পরিক আক্রমণের শালীন উদাহরণ রেখে গেছেন। আজকের রাজনীতিকদের মধ্যে অনেক সময়েই আমরা সেই শালীনতা ও সুস্থ সংস্কৃতির নজির দেখতে পাই না।
দেশে রাজনীতি যখন দিশাহারা, নীতি-নৈতিকতা যখন সমাজের উচ্চস্তরে কিছুসংখ্যক প্রভাবশালীর মধ্যে অনুপস্থিত, লোভ এবং ঘুষের বিস্তৃত বেড়াজালে অর্থনীতি যখন করুণ দশায়, তখন সংসদে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির অশালীন কথাবার্তা, প্রতিপক্ষের চরিত্রহনন সমাজের মন ও মানুষকে আরো বিভ্রান্ত ও বিষণ্ন করে।
তবে আশার কথা, এই সময়েই দুই পক্ষের দায়িত্বশীল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই অসংযত আচরণ ও বাক্যবাণ রোধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি ও সমাজের ব্যাধি আরো গভীর, এই রোগ নিরাময় করতে হলে শিকড় ধরে টান দিতে হবে। ক্ষমতার লড়াইয়ে সংকীর্ণ, কুটিল ও স্বার্থান্ধ পথে না চলে যাত্রা করতে হবে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে। সে পথ পারস্পরিক সহনশীলতার পথ, সহযোগিতার পথ।
লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক
mrshelley43@gmail.com
No comments