আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন সন্ত্রাস' by মির্জা তাসলিমা সুলতানা, সায়েমা খাতুন, নাসরিন খন্দকার

অবস্থাদৃষ্টে অনেকেই মনে করেছিলেন সরকারের টনক নড়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের নোটিশে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ইভ টিজিং নিষেধ’,

বিভিন্ন মহলে আলোচনার ফলে ইভ টিজিং রোধে কঠোর আইনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। সচেতনতার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মনোযোগ আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে সরিয়ে নেওয়ার আগেই দেখা গেল গত ১৫ দিনে পত্রিকায় বারবার শিরোনাম হয়েছে ‘ইভ টিজিং’। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে হয়রানির শিকার নারী আত্মহত্যা করে এবং প্রতিবাদকারী শিক্ষক মিজানুর রহমানকে হত্যা করা হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদকারী মিজানুর রহমানের মৃত্যুর খবর পত্রিকার পাতা থেকে সরে যেতে না যেতেই আবারো মরতে হলো প্রতিবাদী মা চাঁপা রানীকে, যিনি তার কন্যা সন্তানকে নিরন্তর নিপীড়নে পর্যুদস্ত জীবন থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
মরেছে আরো অনেকে- সিমি, মহিমা, ফাহিমা, সাবিনা, ইন্দ্রাণী, তৃষা, রুমীর মত কিশোরী-তরুণীদের দুর্ভাগ্যজনকভাবে আত্মহত্যা ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে বিবস্ত্র, পদদলিত, পিষ্ট হয়ে ছাত্রী ও নারী শিক্ষক মৃত্যুবরণ করেছে। ২০০০ সাল বরণের উৎসবে একটি মেয়েকে এক দঙ্গল ছাত্র প্রকাশ্য রাস্তায় বিবস্ত্র করে ফেলে। এত এত মৃত্যু, এত ভয়াবহ নিপীড়নের পরিণতিতে আত্মহত্যা, তবু এই অপরাধকে চিহ্নিত হতে দেখি না গুরুত্বের সঙ্গে।
হাওয়ার হয়রানি? : একে বলা হচ্ছে ‘ইভ টিজিং’। যৌনগন্ধী, আক্রমণাত্মক, সহিংস মন্তব্য ও আচরণকে বোঝানোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় কথ্য ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ‘ইভ টিজিং’ প্রত্যয়টি প্রচারিত ও প্রচলিত হয়েছে। যৌন হয়রানিকে সারা বিশ্বে দেখা গেলেও এই বিশেষ রকমটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে (যেমন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা প্রভৃতি) বিভিন্ন মহল থেকে বেশি উল্লেখিত আকারে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেকের কাছে ‘যৌন’ শব্দটি ঠিক সভ্য-ভব্য বিবেচিত না হওয়ায় যৌন হয়রানিকে একটু রেখে-ঢেকে হালকা করে বলবার জন্য কেতাদুরস্ত ‘ইভ টিজিং’ পদটি চালু করা হয়। বাংলায় যার অনুবাদ হতে পারে ‘হাওয়ার হয়রানি’ হিসেবে। বলা বাহুল্য, আদমকে ছলনায় ভুলিয়ে বিপথগামী করায় পারদর্শী হিসেবে বিবেচিত বিবি হাওয়া। হাওয়ার উত্তরসূরি হিসেবে তাই এই প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে নারীর সার্বিক অস্তিত্বকে পুরুষের চারিত্রিক স্খলনের কারণ করে তোলা হয়, ফলত জায়েজ হয়ে যায় তার প্রতি কৃত যৌন নিপীড়ন।
নারীবিদ্বেষী পৌরুষের উদযাপন : সমাজে নির্মিত পৌরুষের ধারণার সঙ্গে আক্রমণকারী, বলপ্রয়োগকারী ইমেজযুক্ত। নারীকে সেই ‘পৌরুষ’-এর দ্বারা পরাজিত দেখার মধ্য দিয়েই এটি প্রতিষ্ঠা পায়। পৌরুষ হলো নারীকে আয়ত্ত, বশীভূত, পদানত রাখা, যার মধ্য দিয়েই সামাজিক মননে অতি যত্নে লালিত হয় নারীবিদ্বেষ। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেরা তাদের যৌনতার মাধ্যমে তার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বকেও প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে তার যৌন সক্রিয়তা কার্যকর হয়ে ওঠে মেয়েদের ওপর আগ্রাসী আচরণের মধ্য দিয়ে। নারীকে হেনস্থা ও লাঞ্ছিত করবার মধ্য দিয়েই সেটা সে দেখায়; তার ব্যাটাগিরির প্রমাণ দেয়, নারীবিদ্বেষী পৌরুষের ঘোষণা ব্যক্ত করে। ‘ছোকরা’ বা ‘চ্যাংড়া’ অর্থাৎ কিশোর ছেলে ‘ব্যাটা’ বা ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ ও সহিংস সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে। পুরুষ আধিপত্যের কাঠমোতে পুরুষের যৌনতার উন্মেষ ঘটে নারীর ভেতর ভীতি সঞ্চারের মধ্য দিয়ে, আতঙ্কিত করবার মধ্য দিয়ে। এই পৌরুষকে যতক্ষণ ভেঙে নতুন করে নারী-বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা না হচ্ছে, ততক্ষণ নারীর প্রতি এই নিপীড়নের অবসান ঘটতে পারে না।
যৌন নিপীড়নের প্রকাশ্য ও গুপ্ত হনন : শারীরিকভাবে সরাসরি আক্রান্ত না হওয়ার কারণে আপাতদৃষ্টিতে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকে খানিকটা সাদামাটা ও নিরীহ গোছের অপরাধ মনে করা হয়। আমরা পত্রিকার পাতায় এই ধরনের নিরন্তর নিপীড়নের শুধু কিছু নির্বাচিত ঘটনা জানতে পারি। বিশেষত তখনই, যখন এটি হত্যা বা আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ দৃশ্যমান পরিণতি সৃষ্টি করে। কিন্তু যৌন হয়রানির কদর্য অভিজ্ঞতা ও অপমান দ্বারা ঘটিত মেয়েদের জীবনের গুপ্তহত্যা নিয়ে আমরা কতটুকু সজাগ? এটি হার মেনে নেওয়ার অনুভূতির মধ্য দিয়ে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার মৃত্যু ঘটায়; নিজের শক্তির ওপর আস্থা নষ্ট করে ফেলে, সাবলীলতা নষ্ট করে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল, দ্বিধাগ্রস্ত, ভীত-চকিত, উদ্বিগ্ন করে ফেলে। বহুক্ষেত্রে মেয়েদের লেখাপড়া, উপার্জন করে স্বাবলম্বী হওয়া ও পরিবারকে সাহায্য করার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অল্পবয়েসী অনভিজ্ঞ মেয়েদের নিয়ে পরিবার প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনযাপন করে। তাদের নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসা নিয়ে অস্বাভাবিক, অবর্ণনীয় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এমনকি কোথাও কোথাও নিজের বাড়ির ছাদে কাপড় শুকাতে আসা, বিকেলে একটু হাওয়া খাওয়া কিংবা খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ানো, জানালার ধারে বসে থাকাও যেন আর সম্ভব হয় না। তার ঘর-বাড়িতেও মধ্যরাতে ঢিল ছুঁড়ে মারে শিকারী পুরুষ। নারীজন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ও স্বাভাবিক হিসেবে এই প্রাত্যহিক নিপীড়নকে জুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় সে প্রাকৃতিকভাবেই নিচু, জন্মমাত্রই সে নিপীড়নযোগ্য।
তামাশা নয় ধীর ঘাতক : সিনেমা-নাটকে অনেকসময়ই নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেমের সূত্রপাত হিসেবে যা দেখানো হয়, তা আসলে যৌননিপীড়ন ছাড়া কিছুই নয়। পুরুষ নারীর চলার পথে এই হয়রানির চর্চার মধ্য দিয়ে তার আত্মমর্যাদাকে আঘাত করে, তাকে নাজেহাল করে, খাটো করে এবং তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করে। একে ঠাট্টা-মশকরা হিসেবে হালকা করে দেয়ার ফলে এই তামাশাকরণ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়ে। অপরাধ হিসেবে এর গুরুত্বকে খাটো করে ফেলা হয়। ফলে একে শনাক্ত করা ও দমন করা দূরুহ হয়ে পড়ে। এর আক্রমণাত্মক চরিত্রটি উধাও হয়ে এমনভাবে পিছল হয়ে পড়ে যে তাকে বিব্রতকর, অসম্মানজনক, অন্যায় আচরণ বলে ধরার উপায় থাকে না। তাই একে দমন করার জন্য প্রথমে গুরুতর করে উল্লেখ করা এবং এর ঘাতক শক্তিকে উন্মোচন করা দরকার।
আইনের ফোকরগলা সমাজ : সরকার আইনি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি জরুরি পদক্ষেপ। এ ধরনের হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধমূলক আইন এজন্য থাকা দরকার যে, এই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্র কর্তৃক নৈতিক অর্থে অপরাধ চিহ্নিত করে। শাস্তির ভয় এ ধরনের আচরণকে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু এর ভয়াবহতা ও সামাজিকভাবে এই অপরাধ বিকশিত হওয়ার প্রেক্ষাপটকে চিহ্নিত করা ছাড়া একে দমন করা অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের দ্বারস্থ হতে গেলে ব্যক্তিগত, মানবিক, সামাজিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম ও জটিল দিকগুলোকে যথার্থভাবে মোকাবিলা করা যায়ও না, যা কিনা কেবল কতগুলো আইনি অধিকারের ব্যাপার নয়। মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী, মানবিক সম্পর্কের বোধের গভীর কিছু ব্যাপার। আদালত পর্যন্ত পৌছার আগের স্তরগুলোতেই সেসব ধরা পড়ে। আবার অনেকক্ষেত্রে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা উত্ত্যক্তকারীদের বিপরীতে দাঁড়াবার পরিস্থিতি শুধু আইন নিশ্চিত করতে পারে না।
আইন যেমন থাকা দরকার, তেমনি এটাও সত্য যে, কেবল আইনি সমস্যা বলে একে চিহ্নিত করলে এর শেকড়ের ব্যাপ্তিকে ধরা যাবে না এবং তার মূলোৎপাটনও সম্ভব হবে না। আমরা একে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-কারখানার ব্যবস্থাপনা কিংবা দেশের ল’ এন্ড অর্ডারের সমস্যার চাইতেও গভীর মনে করি এবং একে তলিয়ে দেখতে চাই সমাজ ও সংস্কৃতির গঠন-প্রকৃতির মধ্যে; আধিপত্যমূলক, নারী-বিদ্বেষী ও সহিংস একটি সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি পুরুষের অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাবের প্রকাশ হিসেবে। তবে এই সংস্কৃতি অনড়, অচল, চিরকালীন নয়, বরং প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তনযোগ্য ;সমাজের ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বপূর্ণ।
সাহসী ও প্রতিবাদী মননের সম্ভাবনা : অপমানে, ভয়ে, নিজের প্রতি দায় নিয়ে কিংবা স্বপ্নের মৃত্যুতে প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করেছে অনেক মেয়ে। অপ্রকাশ্যে এই নারীবিদ্বেষী, নিপীড়নমূলক বাস্তবতার ছাঁচে নিজেকে সীমায়িত করে জ্যান্তমরা হয়ে বেঁচেছে আরো অনেকে। কিন্তু তাতে নিপীড়ন কমেনি। এখন মরছে মিজানুর, মরেছে চাঁপা রানী। কিন্তু এই মৃত্যু প্রতিবাদের, তাই গর্বের ও অনুপ্রেরণার। প্রতিবাদী মানুষ মরে না, প্রতিবাদী মনন মরে না। আজ মিজানুর বা চাঁপা রানী পথিকৃত হয়েছেন। এখানেই আছে তাই পরিবর্তনের সম্ভাবনার বীজ। কেননা, একমাত্র প্রতিবাদী মানুষই পারে যৌন নিপীড়নের ভিত এই নারীবিদ্বেষী পৌরুষের উদযাপন ঠেকাতে, পারে ঠেকাতে আমাদের মেয়েদের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য অসংখ্য মরণ।
========================
সাহিত্যালোচনা- 'মারিও ভার্গাস ইয়োসা'র সাহিত্যে নোবেলের রাজনৈতিক মোড়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা by নূরুল কবীর  রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ  নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি'  গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা  আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর  গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী



সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে
লেখকঃ মির্জা তাসলিমা সুলতানা, সায়েমা খাতুন, নাসরিন খন্দকার
[লেখকবৃন্দ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক]


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.