হাজরে আসওয়াদের ইতিকথা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
‘হাজরে আসওয়াদ’ বা কালো পাথর একটি প্রাগৈতিহাসিক ইসলামি নিদর্শন এবং বেহেশতের বহু মূল্যবান বরকতময় উপকরণ। এটি পবিত্র কাবাগৃহের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে প্রায় চার ফুট উঁচু দেয়ালের কিছুটা ভেতরে পোঁতা কালো থালার মতো একটি গোল পাথর। কালো বর্ণের বলে এর নাম রাখা হয়েছে হাজরে আসওয়াদ। কিন্তু এটা প্রথমে কালো ছিল না; এর রং সম্পূর্ণ সাদা ছিল। ক্রমান্বয়ে এর মাথার রংটুকু কালো হয়ে গেছে; তা-ও হঠাৎ করে নয়। বরং আস্তে আস্তে দীর্ঘদিন ধরে কালো হয়েছে। আদম সন্তানের গুনাহ পাথরটিকে কালো করে দিয়েছে। মূলত হাজরে আসওয়াদ ছিল রুপার মতো ধবধবে সাদা বেহেশতের একটি ইয়াকুত পাথর। কোনো এক দুর্ঘটনায় তা কয়েকটি টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এ টুকরোগুলো মূল্যবান ধাতুর সাহায্যে জোড়া দিয়ে একত্র করা হয়েছে। একটি চাঁদির পাত্রে কাবাগৃহের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা দেখলে ও স্পর্শ করলে একটু উঁচু অনুভূত হবে। হাদিস শরিফে হাজরে আসওয়াদকে বেহেশতি পাথর বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোকনে আসওয়াদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেশতের দুটো ইয়াকুত পাথর।’ (তিরমিজি)
প্রতিবছর হজের সময় হাজিদের অন্যতম কাজ আল্লাহর প্রেমে ব্যাকুল হয়ে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত ও তাওয়াফ করা। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ শুরুর স্থানে অবস্থিত। প্রথমে এখান থেকেই তাওয়াফ শুরু করতে হয়। ‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবাগৃহ তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা সুন্নত। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন বা সম্মান দেখানোর কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন রকমের মতামত ও কাহিনি বর্ণিত আছে। সর্বজনস্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমতে বলা হচ্ছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণকাজ শেষ করেন, তখন একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। অবশিষ্ট এ পাথরটি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথিরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে, কেবল আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম।’ আল্লাহ তাআলা তার ফরিয়াদের প্রতি-উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদনুযায়ী এ পাথরটিকে কাবাঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয় এবং তাওয়াফকারীকে এ পাথরে চুম্বন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনিভাবে কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল, কালো পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়।
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর নাজিল হওয়ার সময়ে হাজরে আসওয়াদও বেহেশত থেকে নাজিল হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তাআলা এ পাথরটিকে কাবা শরিফের স্থানে রেখে দিয়েছিলেন। তখন কাবাঘর ছিল না। জমিন ছিল পবিত্র, এতে কোনো গুনাহ সংঘটিত হতো না। হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় যখন সবকিছু ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) পাথরটি আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হলে তাওয়াফ শুরু করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল (আ.) একটি পাথর তালাশ করার সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা বায়তুল্লাহ শরিফের সবচেয়ে মর্যাদাবান জায়গায় তথা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করেন। তাই এ পাথরটি সাধারণ কোনো পাথর নয়। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তৈরি মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশ কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বহস্তে কাবাগৃহে সর্বসম্মতিক্রমে যথাস্থানে কৃষ্ণপাথর স্থাপন করেন। নবী করিম (সা.) হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়েছেন এবং এর ওপর দুই হাত বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এতে চুম্বন করার ফজিলত অনেক বেশি। মূলত এই পাথরকে চুমু দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য করা। এই চুমু খাওয়া সুন্নত। পরকালীন কিছু কল্যাণ লাভের আশায় মুসলমানেরা এতে চুমু খায়। হাজরে আসওয়াদ উভয় হাত দিয়ে স্পর্শ ও চুম্বনের মাধ্যমে স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী বান্দা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হস্ত মোবারকে বায়আত করার গৌরব অর্জন করবেন।
নবী করিম (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরাম হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত উমর ফারুক (রা.) হাজরে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, তুমি একখানা পাথর, তোমার উপকার ও ক্ষতিসাধন করার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে তোমার গায়ে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুমু দিতাম না।’
সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারীর কাছে হজের সময় হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর অত্যন্ত মূল্যবান। পাথরটির চারপাশে রুপার বৃত্ত লাগানো। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হাজরে আসওয়াদ [হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে] জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। তখন তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল; কিন্তু আদম সন্তানের গুনাহ একে কালো করে দিয়েছে।
প্রতিবছর হজের মৌসুমে মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক আছেন, যাঁরা বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেন। যদি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন দেওয়া সম্ভব না হয়, ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও হবে। কালো পাথরটির দিকে সম্প্রসারিত করে স্বীয় হস্তে চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের অশেষ সওয়াব ও বরকত দান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন হজযাত্রীদের নবী-রাসুলদের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com
প্রতিবছর হজের সময় হাজিদের অন্যতম কাজ আল্লাহর প্রেমে ব্যাকুল হয়ে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত ও তাওয়াফ করা। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ শুরুর স্থানে অবস্থিত। প্রথমে এখান থেকেই তাওয়াফ শুরু করতে হয়। ‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবাগৃহ তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা সুন্নত। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন বা সম্মান দেখানোর কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন রকমের মতামত ও কাহিনি বর্ণিত আছে। সর্বজনস্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমতে বলা হচ্ছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণকাজ শেষ করেন, তখন একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। অবশিষ্ট এ পাথরটি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথিরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে, কেবল আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম।’ আল্লাহ তাআলা তার ফরিয়াদের প্রতি-উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদনুযায়ী এ পাথরটিকে কাবাঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয় এবং তাওয়াফকারীকে এ পাথরে চুম্বন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনিভাবে কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল, কালো পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়।
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর নাজিল হওয়ার সময়ে হাজরে আসওয়াদও বেহেশত থেকে নাজিল হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তাআলা এ পাথরটিকে কাবা শরিফের স্থানে রেখে দিয়েছিলেন। তখন কাবাঘর ছিল না। জমিন ছিল পবিত্র, এতে কোনো গুনাহ সংঘটিত হতো না। হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় যখন সবকিছু ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) পাথরটি আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হলে তাওয়াফ শুরু করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল (আ.) একটি পাথর তালাশ করার সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা বায়তুল্লাহ শরিফের সবচেয়ে মর্যাদাবান জায়গায় তথা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করেন। তাই এ পাথরটি সাধারণ কোনো পাথর নয়। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তৈরি মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশ কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বহস্তে কাবাগৃহে সর্বসম্মতিক্রমে যথাস্থানে কৃষ্ণপাথর স্থাপন করেন। নবী করিম (সা.) হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়েছেন এবং এর ওপর দুই হাত বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এতে চুম্বন করার ফজিলত অনেক বেশি। মূলত এই পাথরকে চুমু দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য করা। এই চুমু খাওয়া সুন্নত। পরকালীন কিছু কল্যাণ লাভের আশায় মুসলমানেরা এতে চুমু খায়। হাজরে আসওয়াদ উভয় হাত দিয়ে স্পর্শ ও চুম্বনের মাধ্যমে স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী বান্দা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হস্ত মোবারকে বায়আত করার গৌরব অর্জন করবেন।
নবী করিম (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরাম হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত উমর ফারুক (রা.) হাজরে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, তুমি একখানা পাথর, তোমার উপকার ও ক্ষতিসাধন করার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে তোমার গায়ে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুমু দিতাম না।’
সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারীর কাছে হজের সময় হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর অত্যন্ত মূল্যবান। পাথরটির চারপাশে রুপার বৃত্ত লাগানো। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হাজরে আসওয়াদ [হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে] জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। তখন তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল; কিন্তু আদম সন্তানের গুনাহ একে কালো করে দিয়েছে।
প্রতিবছর হজের মৌসুমে মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক আছেন, যাঁরা বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেন। যদি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন দেওয়া সম্ভব না হয়, ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও হবে। কালো পাথরটির দিকে সম্প্রসারিত করে স্বীয় হস্তে চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের অশেষ সওয়াব ও বরকত দান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন হজযাত্রীদের নবী-রাসুলদের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments