তিন কারণে বাংলাদেশের ডেনিম এখন বিশ্বের বিস্ময় by শফিকুল ইসলাম
বিশ্ববাজারে ডেনিম কাপড়ে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ব্রান্ড।
প্রধানত সাশ্রয়ী দাম আর গুণগত মানে সেরা হওয়ায় বাংলাদেশের ডেনিম পোশাকের
জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী তুঙ্গে। তবে এ দুটি কারণের পাশাপাশি রয়েছে ডেনিম
তৈরিতে ‘বাংলাদেশি নৈপুণ্য’।
তুলা এবং বুননের বিশেষত্বের কারণে বিশ্বব্যাপী কাপড়টি ‘ডেনিম’ নামে
পরিচিত। তবে জনপ্রিয়তার বিচারে এখন জিন্স নামেই বেশি চেনেন ব্যবহারকারীরা।
ইউরোপের বাজারে ডেনিম পোশাক এখন এক নম্বরে। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এর
অবস্থান তৃতীয় বলে জানা গেছে।
উন্নতমানের ডেনিম রফতানি, বিশ্বমানের কারখানা এবং শ্রমিকদের দক্ষতা
উন্নয়নের ফলে এই অবস্থানে উন্নীত হওয়া গেছে। ডেনিমে বাংলাদেশের প্রধান
প্রতিযোগী এখন চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ইউরো স্টেটের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য আমদানি করে
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৭৬ মিলিয়ন
ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে। তথ্যমতে, ইউরোপের বাজারে ২০১০ সালে ৪৪৪
মিলিয়ন, ২০১১ সালে ৫৯১ মিলিয়ন, ২০১২ সালে ৭২৫ মিলিয়ন, ২০১৩ সালে ৮০৮
মিলিয়ন, ২০১৪ সালে ৯৩৯ মিলিয়ন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন, ২০১৬ সালে ১
হাজার ২২৭ মিলিয়ন এবং ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩২০ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য
রফতানি হয়েছে ইউরোপে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন কারণে বাংলাদেশের ডেনিম পণ্য এখন বিশ্বসেরা।
এর প্রথম কারণ হচ্ছে ডেনিম ফেব্রিক্সের কাঁচামাল বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। ফলে
দাম কম। দ্বিতীয় কারণ হলো অভিনব ডিজাইন এবং সৃজনশীল ডেনিম পোশাক প্রস্তুত
করতে বাংলাদেশের নৈপুণ্য। এবং তৃতীয় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ডেনিমের
কারখানাগুলো অত্যাধুনিক এবং ওয়াশিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উৎকৃষ্ট। ফলে
উৎপাদিত পণ্যের ফিনিশিং হয় আকর্ষণীয়। মূলত এ তিন কারণেই বাংলাদেশে ডেনিম
এখন বিশ্বের বিস্ময়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাট ও তুলা এবং একই রকম আঁশ
জাতীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণে সাশ্রয়ী মূল্যে সুতা উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার
করেছে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে উন্নতমানের ডেনিম কাপড় তৈরি করা যাবে।
বাংলাদেশের পাট ও তুলার মিশ্রণে সুতা তৈরি করা হবে। সেই সুতা থেকে বানানো
হবে ডেনিম কাপড়। উৎপাদিত কাপড় থেকে প্যান্ট, জ্যাকেট ও শার্টের মতো পোশাক
বানিয়ে রফতানি করা হবে। পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতে কাপড় সরবরাহ করার
পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের পাটের উৎপাদন বাড়াতে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং
ডেনিমের বিশ্ববাজার ধরতেই এ উদ্যোগ নিয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়।
ডেনিম খাতকে এগিয়ে নিতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক
মুদ্রা আয় সম্ভব। দেশে ডেনিম পণ্য তৈরি করছে এমন কারখানার সংখ্যা সোয়া
৫শ’। এসব কারখানার বেশিরভাগই আমদানিকৃত কাঁচমালের (ফেব্রিক) ওপর নির্ভরশীল।
তবে বাংলাদেশে এখন ৩১টি বড় ডেনিম কারখানা কাজ করছে। এই খাতে উদ্যোক্তারা
বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৩৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ থেকে ব্লু ডেনিম ট্রাউজার্স,
স্কার্ট, জ্যাকেট, স্যুট-কোট, প্লে স্যুট রফতানি হয়। এইচঅ্যান্ডএম,
ইউনিকলো, টেস্কো, লেভিস, ডিসেল, ওয়াংলার, জি-স্টার, এস অলিভার, হুগো বস ও
গ্যাপ এখন বাংলাদেশের ডেনিমের ক্রেতা।
বিজিএমইএ সূত্রমতে, উচ্চমান ও সাশ্রয়ী মূল্যের পাশাপাশি ফ্যাশনেবল
ডেনিমের উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছেন এ শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা। নতুন নতুন
প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবছরই ডেনিম কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন
বাড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের ডেনিম বিশ্বে এখন অলরাউন্ডার। চীন ও
তুরস্কের ডেনিমের বাজার বাংলাদেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা ব্যাপক। এ সুযোগ কাজে
লাগাতে উদ্যোক্তারা কাজ করছেন।’
জানা গেছে, বিশ্বে ডেনিমের বাজার প্রায় ৫ হাজার ৬২০ কোটি ডলারের।
বিশ্বাজারে বাংলাদেশ ডেনিম পণ্য রফতানি করছে ৩৫০ কোটি ডলারের। বছরে ডেনিম
পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের ওপরে। দেশে প্রতিবছর ডেনিম কাপড়ের
চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি
গজের। অর্থাৎ চাহিদার অর্ধেক কাপড় উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। ২০২১ সালের মধ্যে এ
চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়াবে। সুতরাং এ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক জায়গা রয়েছে
বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশে স্কয়ার ডেনিম দীর্ঘদিন ধরেই সুতা
উৎপাদন করছে।
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের অলিপুরে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা
হয়েছে স্কয়ার ডেনিম লিমিটেডের ডেনিম ফেব্রিকস উৎপাদনের বিশাল কারখানা। এ
ছাড়াও দেশের বৃহত্তম পারটেক্স ডেনিমের উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি
বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় ডেনিমের কর্ণধার আবদুস
সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘ডেনিম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ব্যাপক।
বিশ্ববাজারে ডেনিমের চাহিদার কোনও শেষ নেই। প্রবৃদ্ধিও ভালো। এটিকে এগিয়ে
নিতে পারলে রফতানিতে বিশাল ভূমিকা পালন করবে ডেনিম।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ইউরো স্টেটের তথ্যমতে, বাংলাদেশি
ডেনিমের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ৭০
শতাংশ মানুষ নিয়মিত ডেনিম পণ্য ব্যবহার করে। ইউরোপে সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর
একটি হলো যুক্তরাজ্য। সেখানে জনপ্রতি গড়ে ১৭টি ডেনিম পণ্য ব্যবহার করে।
বিশ্বব্যাপী ডেনিমের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে প্রথম
ফিলিপাইন ও হংকংয়ের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে বাংলাদেশে ডেনিম পোশাক তৈরির
দুটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম ডেনিম
সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর আগের বছরের তুলনায় সরবরাহ ৭৫
শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় মেলে এ স্বীকৃতি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সাল থেকে তৈরি পোশাক
প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ডেনিম কাপড়ের ওপর নির্ভরতা শুরু করে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে ১৭ কোটি পিসের কিছু বেশি ডেনিম পোশাক
বিক্রি করে প্রায় ৯৪ কোটি ডলার আয় করে। একই সময়ে চীন ইউরোপের বাজারে বিক্রি
করে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি পিস।
আশা করা হচ্ছে ডেনিম শিল্পের অভিযাত্রা সফল হলে এ দশকেই বছরে লাখো কোটি টাকা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
No comments