ব্রেইন ড্রেইন নাকি ব্রেইন গেইন?
বিজ্ঞান
গবেষণার আর্টিকেল প্রকাশের সংখ্যায় চীন এই প্রথমবারের মতো আমেরিকাকে
ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৬ সালে চীন প্রায় সোয়া চার লাখ আর্টিকেল প্রকাশ করেছে।
আমেরিকা করেছে চার লাখ নয় হাজার। বিজ্ঞান ইতিহাসের এই স্বর্ণযুগে আমেরিকাকে
ছাড়িয়ে শুধু চীনই এমন অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এই
চীনের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ ভাগ সেরা সেরা তরুণ-তরুণী সারা দুনিয়াতে কাজ করে।
তাহলে চীনের কি ব্রেইন ড্রেইন হচ্ছে না? যদি হয়েই থাকে, তাহলে এত ব্রেইন
ড্রেইনের পর কী করে চীন এতটা হুংকার দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল? আপনি যেটাকে
দেখছেন সিক্স, সেটাকেই উল্টিয়ে কেউ দেখছেন নাইন। দুনিয়াতে কেউ যখন কোনো
কিছুতে সমস্যা দেখে, কেউ দেখে সম্ভাবনা। আমরা যেটাকে বলি ব্রেইন ড্রেইন,
চীন সেটাকে বলে ব্রেইন গেইন! চীন সরকার চায় তাদের আরও বেশি ছেলেমেয়ে সারা
দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক।
সে লক্ষ্যে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা
হয়েছে। চীনের তরুণেরা নিজ দেশে পড়াশোনা করে ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে হিমশিম খায়
না। চীন সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেধাবী তরুণদের আমেরিকায়
পাঠায়। সে দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার তরুণ-তরুণী শুধু আমেরিকায় আসে
এক্সচেঞ্জ রিসার্চ প্রোগ্রামে। চীনের ছেলেমেয়েরা গড়ে ২৬–২৭ বছর বয়সে
ইউরোপ-আমেরিকা থেকে পিএইচডি শেষ করে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে
সেটা গড়ে ৩০–৩২ কিংবা আরও বেশি। চীনের প্রায় নব্বই ভাগ ছেলেমেয়ে বিদেশে
উচ্চশিক্ষা নিতে এসে সফলতার সঙ্গে শেষ করে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের
ক্ষেত্রে সেটা অনেক কম (সম্ভবত পঞ্চাশেরও নিচে)। অজস্র ছেলেমেয়ে দেশের পাট
চুকিয়ে বিদেশে এসে ঝরে পড়ে। কারণ, শিক্ষার মানে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা!চীন
সরকার তার দেশের সেরা মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বহু প্রকল্প চালু করেছে।
মেধাবীরা বিদেশ থেকেই সেসব প্রকল্পের ফান্ডের জন্য আবেদন করতে পারে।
প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেধাবীদের গবেষণার জন্য অর্থ প্রদান করা হয়। তাদের
জন্য দেওয়া হয় অধিক সুযোগ-সুবিধা। সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণা
প্রতিষ্ঠানগুলো লাল-নীল দল দিয়ে পূর্ণ করে রাখা হয়নি। চীনের পরিকল্পনা হলো,
তাদের ছেলেমেয়েরা সারা দুনিয়ার সেরা সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে শিখবে। সেসব
তৈরিকৃত ছেলেমেয়েদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চীন তার নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে কাজে
লাগাবে।আমার মতে, এই বিশ্বায়নের যুগে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বলে কিছু নেই। জ্ঞান
অর্জন করতে পারলে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সমাজের কাজে আসা যায়। তা ছাড়া যে
সমাজ তার সম্ভাবনাকে পরিচর্যা করে না, সে সমাজে পড়ে থেকে নিজের সম্ভাবনাকে
খুন করার নাম দেশপ্রেম নয়! বরং যেখানে গেলে মেধাকে বিকশিত করা যায় সেখানে
গিয়ে বড় হয়ে, নিজের দেশের জন্যও নানা ভাবে কাজ করা যায়। অধিকন্তু, বিকশিত
না হয়ে দেশকেও কিছু দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের জাহিদ হাসান যদি আমেরিকায় না
আসত, তাহলে জাহিদ হাসান হতে পারত না। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হতে
পারত না। ফার্মিয়ন আবিষ্কার করতে পারত না। সাইফ ইসলাম যদি আমেরিকায় না
আসতেন, তাহলে ইউসি-ডেভিসের প্রফেসর হতে পারতেন না। তেমনি, সাইফ সালাহউদ্দিন
এই তরুণ বয়সে হতে পারতেন না ইউসি-বার্কলের প্রফেসর।উন্নয়নশীল দেশের সরকার
সকল শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগান দিতে পারে না।
সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না। সুতরাং উন্নয়নশীল দেশের ছেলেমেয়েদের মেধার
বিকাশের জন্য উন্নত দেশের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। চীনের অসংখ্য
ছেলেমেয়ে সারা দুনিয়া থেকে এই সুযোগটা নিয়েছেন। এখনো নিচ্ছেন। তাদের
যোগ্যতা দিয়েই তারা এই সুযোগ নিচ্ছেন। তাদের দেশ তাদের এই সুযোগ লুফে
নেওয়ার জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করছে। গত পঞ্চাশ বছরে চীন এভাবেই দাঁড়িয়েছে।
ভারত এভাবেই দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশকেও এভাবেই দাঁড়াতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ
শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়ন করলে, প্রচুর ছেলেমেয়ে অনায়াসে বিদেশে পড়তে
যেতে পারবে। বিদেশে পড়তে গিয়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে ঝরে পড়বে না। তরুণেরা তাদের
নিজের প্রচেষ্টা, মেধা ও শ্রম দিয়ে উন্নত দেশ থেকে শিখবে। রাষ্ট্র যদি
তাদের সামান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিতে না চায়, তাহলে নিজ ভাগ্য
হত্যা করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে ভাগ্য পরিবর্তন হবে না।
রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলে, ব্রেইন ড্রেইন না হয়ে বহুগুণে ব্রেইন গেইন হবে। সে
লক্ষ্যেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে।
ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <rauful.alam15@gmail.com>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>
ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <rauful.alam15@gmail.com>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>
No comments