সিরিয়া যুদ্ধে নতুন সমীকরণ
নতুন
মেরুকরণ শুরু হয়েছে সিরিয়া নিয়ে। গত সপ্তাহে বড় ধরনের মোড় নিয়েছে সিরিয়া
ইস্যু। একদিকে সিরিয়াভিত্তিক কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে
ক্রসবর্ডার সামরিক অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক। সিরিয়ার অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে
সেখানে তুরস্কবিরোধীদের শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ দিতে চায় না আঙ্কারা।
ইতোমধ্যে এই অভিযানে তারা হত্যা করেছে অনেক পিকেকে মিলিশিয়াকে। অন্য দিকে,
রাশিয়ার সোচিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সিরিয়ার সঙ্ঘাত নিরসনের লক্ষ্যে রাশিয়ার
উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপ, যা কংগ্রেস অব দ্য সিরিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ নামে
পরিচিত। শুরু হওয়ার আগেই অবশ্য বিভিন্ন কারণে এই সংলাপ নিয়ে হতাশা প্রকাশ
করেছেন বিশ্লষকেরা। এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে নিহিত রয়েছে সিরিয়া সঙ্ঘাতের
নানা সীমকরণ। সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, পরাশক্তির দ্বন্দ্ব আর সেই সাথে
আঞ্চলিক রাজনীতি জড়িয়ে আছে এর সাথে। একটির সাথে রয়েছে আরেকটি নেপথ্য সংযোগ।
তুরস্ককে সিরিয়ার অভ্যন্তরে অভিযান চালাতে নীরব সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া,
বিনিময়ে তারা চেয়েছে সোচি সংলাপে আঙ্কারার সমর্থন। তুরস্কের স্বার্থ নিজের
সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত করা আর রাশিয়া চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে বড়
মিত্র বাশার আল আসাদের আধিপত্য বজায় রেখে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা আনতে। দু’টি
ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই বিষয়টি আরো জটিল থেকে
জটিলতর হবে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। সঙ্ঘাত নিরসনের লক্ষ্যে সোচি সংলাপ আয়োজনের
কথা বলা হলেও এই সংলাপ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অ্যাজেন্ডা
বাস্তবায়ন করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। যার কিছু নমুনা পাওয়াও গেছে।
কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী রাশিয়ার সোচি নগরীর এক রিসোর্টে যে উদ্দেশ্যে মিলিত
হওয়ার কথা বিভিন্ন পক্ষের, তা নিয়েও ছিল মতভেদ।
সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়া
চাইছে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগকে পাশ কাটিয়ে যেতে। জাতিসঙ্ঘ অনেক দিন ধরেই
জেনেভায় সিরিয়া নিয়ে সংলাপ আয়োজন করছে, যেটি মূলত বাশার সরকারের জন্য
নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। আর সে জন্যই মস্কো উদ্যোগ নিয়েছে পাল্টা শান্তি
প্রক্রিয়ার। মস্কোর সব উদ্যোগের নেপথ্যে যে বাশার আল আসাদের ক্ষমতা সুসংহত
করার, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগটি মস্কোর জন্য
দু’টি কারণে নেতিবাচক। এই পরিকল্পনা সফল হলে বা এই পথে সিরিয়ায়
শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হলে তাতে বাশার আল আসাদকে নিশ্চিতভাবেই বিদায় নিতে
হবে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছেÑ জাতিসঙ্ঘের প্রক্রিয়া অলিখিতভাবেই
যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রাধান্য থাকবে। যেটি রাশিয়ার জন্য এক
অর্থে মর্যাদার লড়াই। ভøাদিমির পুতিনের শাসনামলে রাশিয়া আগের চেয়ে অনেকগুণ
সুসংহত। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের বিশ্ব রাজনীতিতেও বিষয়টির প্রভাব পড়েছে। তাই
জাতিসঙ্ঘের মোড়কে মার্কিন সমাধান তারা মানতে চাইবে না সেটি স্বাভাবিক। এ
দু’টি কারণেই হয়তো পুতিনের বিকল্প শান্তি আলোচনার উদ্যোগ। জাতিসঙ্ঘের
উদ্যোগে অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনা ইতোমধ্যেই কয়েক ধাপ পার করেছে। এমন অবস্থায়
সেটিকে পাশ কাটিয়ে নতুন আরেকটি উদ্যোগ এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।
বাশারকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া পুতিন প্রশাসন তাই বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু
করেছে। বিষয়টিতে পুরোপুরিই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, সোচি সংলাপে
বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের
বিষয়ে জোর দিয়েছে রাশিয়া। সংলাপ কতটা সফল হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না, সেটি
স্পষ্ট হতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তবে এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে সফলতার
পাল্লা শূন্য। সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিটি নামের প্রধান বিদ্রোহী গ্রুপটি গত
সপ্তাহে ভিয়েনা সংলাপের পরই জানিয়ে দিয়েছে তারা সোচি সংলাপে অংশ নেবে না।
আলোচনায় অংশ নিতে আসা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের আরেকটি গ্রুপ সোচি বিমানবন্দর
থেকেই বের হতে চায়নি। সেখান থেকেই তারা ফিরতি ফ্লাইটে রাশিয়া ত্যাগ করার
চেষ্টা করে। কারণ বিমানবন্দরেই তারা দেখেছে, সোচি সংলাপের প্রচার-প্রচারণায়
সর্বত্র সিরিয়ার সরকারের পতাকা শোভা পাচ্ছেÑ যা মূলত বাশার সরকারের
প্রাধান্যকেই ইঙ্গিত করে। তা ছাড়া তুরস্কের সীমান্তবর্তী কুর্দি অঞ্চলের
বিদ্রোহীরা তুর্কি অভিযানের প্রতিবাদে আলোচনায় যোগ দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রকে
উপেক্ষা করলেও এ ক্ষেত্রে রাশিয়া পাশে পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এই
সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় তুরস্ককে। সিরিয়ার সাত বছরের গৃহযুদ্ধে
বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। তারা চেষ্টা করেছে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে
সোচি আলোচনায় অংশ নেয়াতে। এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি বিষয়। সবচেয়ে বড় কারণটি
হলো সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে রাশিয়ার মৌন সমর্থন। কুর্দি
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র সংগঠন পিকেকের বিরুদ্ধে তুরস্কের লড়াই বেশ
পুরনো। পৃথক কুর্দি ভূখণ্ডের দাবিতে তারা আন্দোলন করলেও তাদের সন্ত্রাসী
হামলায় নিহত হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে
সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল আফরিন ও মানবিজে একটি কুর্দি সশস্ত্র
মিলিশিয়াগোষ্ঠী গঠনের চেষ্টার কথা জানার পরই তা আঁতুড়ঘরে ধ্বংস করে দিতে
সামরিক অভিযান চালায় তুরস্ক। সীমান্ত এলাকায় নতুন করে কুর্দিরা সশস্ত্র হলে
তা তুরস্কের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। যে কারণে নিজ
ভূখণ্ডের সুরক্ষায় তৎপর তুরস্ক বিষয়টিকে আর বাড়তে দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি।
‘অলিভ ব্রাঞ্চ’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করেছে সেনা ও বিমানবাহিনী। সিরিয়ায়
কুর্দি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযান চলছে এমন একটি সময়, যখন
দেশটিতে রয়েছে রাশিয়ার সরাসরি উপস্থিতি। বাশার সরকারের দেশ পরিচালনা বিশেষ
করে নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটাই রাশিয়ানির্ভর। তাই এমন সময়ে সে দেশে ঢুকে
তুরস্কের অভিযান কিছুতেই রাশিয়ার সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। তুরস্ক
পিকেকেবিরোধী অভিযানে ব্যবহার করছে সিরিয়ার আকাশসীমা, যেটি পুরোপুরিই
রাশিয়ার অধীন। রাশিয়ার বিমানসেনারা সরাসরি যুদ্ধ করছে দেশটিতে ঘাঁটি গেড়ে।
ধারণা করা হচ্ছে, তিনটি কারণে রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছে তুরস্কের সামরিক
অভিযানে। এক. মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ও ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সাথে
সম্পর্কোন্নয়ন। যাদের সাথে মিত্রতাই রাশিয়ার জন্য লাভজনক। দুই. সোচি সংলাপ
সফল করতে তুরস্কের সহযোগিতা ও সর্বশেষ তুরস্ক থেকে রাশিয়া পর্যন্ত
গ্যাসপাইপ লাইন নির্মাণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কুর্দিদের একটি অংশের সাথে
রাশিয়ার সুসম্পর্ক রয়েছে। কুর্দিবিরোধী তুর্কি অভিযানে সমর্থন দেয়ার কারণে
তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে মস্কোর ওপর। কুর্দিদের পিপলস প্রটেকশন ইউনিটের
(ওয়াইপিজি) কমান্ডার জেনারেল সিপান হেমো রাশিয়ার এই আচরণকে সরাসরি
বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাশিয়া তার কুর্দি মিত্রদের তুলনায়
সিরিয়ায় নিজের প্রভাব ধরে রাখা এবং বাশারকে টিকিয়ে রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব
দিয়েছে। অর্থাৎ বড় মিত্রকে বাঁচাতে ছোট মিত্রকে বিসর্জন দিয়েছে। যেমনিভাবে
তুরস্ক সবার আগে দেখছে তার জাতীয় নিরাপত্তাকে। সোচি সংলাপে সিরিয়ার
বিদ্রোহীদের দাবির যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও তুরস্ক তার
সার্বভৌমত্বের বিষয়টিতে কোনো আপস করতে চাইছে না। আর রাশিয়ার সম্মতি ছাড়া
সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোও সম্ভব নয়। একদিক থেকে এটি তুরস্কের একটি বড়
অর্জন যে, রাশিয়া তাদের সুযোগ দিয়েছে সিরীয় কুর্দি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে
অভিযান চালাতে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয় হবে তুরস্ক ও
রাশিয়ার এই সামরিক সমঝোতা। তুরস্ক আফরিন ও মানবিজকে নিরাপদ করতে পারলে সেটি
সিরীয় উদ্বাস্তুদের জন্যও হবে আশাব্যঞ্জক। ওই দু’টি এলাকার কয়েক লাখ
উদ্বাস্তু ইতোমধ্যেই দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, যারা
গৃহযুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে। পুরো বিষয়টির আরো একটি অধ্যায় রয়ে
গেছে। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যের
কুর্দিদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। পেন্টাগন নানাভাবেই তাদের সামরিক সহযোগিতা
করে; কিন্তু তুরস্কের এই অভিযানের মুখে তারা কুর্দি মিত্রদের বাঁচাতে কোনো
পদক্ষেপই নিচ্ছে না। এর আগে বাশার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিজয়ী করতে
পারেনি তারা। এবার কুর্দিরাও এই বার্তা পেল, ওয়াশিংটন তাদের বাঁচাতে সক্ষম
নয়। ফলে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরো দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সাত
বছর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার
দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা এখন পুরোপুরিই পরাশক্তিগুলোর ছায়াযুদ্ধে
রূপ নিয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত আরো দূরে সরে যাচ্ছে সিরিয়ার রাজনৈতিক
সমাধানের স্বপ্ন। পুতিনের সমাধানের উদ্যোগ হয়তো সফল হচ্ছে না বা হলেও সেটি
বাশার সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। যার অর্থ, সেই বাশারের স্বৈরশাসন
বহাল থাকা। আবার জাতিসঙ্ঘের শান্তির উদ্যোগ নিয়েও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু
এখনো তৈরি হয়নি।
No comments