এমনিতেই ধসে পড়ছে ভবন ভূমিকম্পে কী দশা হবে?
দেশে
ভবন ধসের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভূমিকম্প ছাড়াই হেলে পড়ছে, ধসে পড়ছে ভবন।
ভূমিকম্পজনিত কারণ ছাড়াই যখন এভাবে ভবন হেলে পড়ে তখন প্রশ্ন, ভূমিকম্প হলে
কী হবে? বস্তুত এমন নয় যে, কোনো কারণ ছাড়াই ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। কারণ তো
আছেই। কারণ ছাড়া কি কোনো ভবন হেলে পড়ে? ৪ তলার অনুমোদন নিয়ে ৫ তলা কিংবা ৮
তলার অনুমোদন নিয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করলে ভবন তো ধসবে, হেলে পড়বেই।
সংশ্লিষ্টদের রাজি-খুশি করে নিয়ম ভঙ্গ করে ভবন তৈরি করছেন অনেকে। ফলে যা
হওয়ার তাই হচ্ছে। সর্বশেষ ২১ জানুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ থানা
এলাকায় ৫ তলা ভবন পাশের একটি ভবনে হেলে পড়েছে। ৪ তলার অনুমোদন নিয়ে
অবৈধভাবে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেন বাড়িটির মালিক। ফলে সেটি হেলে পড়ে।
ভাগ্যিস, কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে ঘটতে পারত। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবন থেকে
বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
(রাজউক)। ভবনটি হেলে না গিয়ে দেবে কিংবা ভেঙে পড়লে শতাধিক লোকের জীবন
হুমকির মুখে পড়ার ভয় ছিল। উদ্বেগের বিষয় হল, ইদানীং দেশে ভবন হেলে পড়ার
ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। আলোচিত
সাভারের রানা প্লাজা ধসে ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর গত কয়েক বছরে রাজধানী
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ভবন হেলে পড়ার সংবাদ
পত্রিকায় এসেছে। প্রশ্ন হল, এভাবে ভবনগুলো ধসে বা হেলে পড়ছে কেন? দেখা
গেছে, এ যাবত দেশে যতগুলো ভবন ধস কিংবা হেলে যাবার ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটিই
যথাযথ ও সঠিক নিয়ম মেনে নির্মিত হয়নি।
সর্বশেষ ঢাকার লালবাগের হেলে পড়া
ভবনটির ক্ষেত্রেও অনিয়মের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ৪ তলার অনুমোদন নিয়ে ৫ তলা
ভবন তৈরি করেছিলেন বাড়িটির মালিক। হেলে পড়া বা ধসে পড়া ভবনগুলোর ক্ষেত্রে
দেখা গেছে, সেগুলো ভয়াবহ নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে তৈরি হয়েছে। উদ্বেগের বিষয়
হল, অনেক ভবন ডোবা কিংবা পুকুর ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরো দেশে কমপক্ষে ৫
লাখ ভবন ধসে পড়বে! ৫ লাখ ভবন ধসের ঘটনা ঘটলে বাঁচার কোনো পথ আছে কি? এ যাবত
সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, কয়েক বছর আগে জাপানে ৮
দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বিশ্বের ইতিহাসে ষষ্ঠ শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল
এটি। জাপান ব্যতীত পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত অপর ৫টি শক্তিশালী ভূমিকম্প
ঘটেছে ১৯৬০ সালের ২২ মার্চ চিলিতে (৯ দশমিক ৫), ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় (৯ দশমিক ২), ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ায়
(৯ দশমিক ১), ১৮৬৮ সালের ১৩ আগস্টে পেরুতে (৯ দশমিক ০) এবং ১৯৫২ সালের ৪
নভেম্বর রাশিয়ায় (৯ দশমিক ০)। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পন
বলয়ে অবস্থিত। ইরানের তেহরান শহরের পরেই ঢাকা শহরের অবস্থান। তাছাড়া মধুপুর
ফল্টে ভূমিকম্প হওয়ার পর ১২৫ বছর পেরিয়ে গেছে, কাজেই ১০০ বছরের ভূমিকম্পের
সাইকেল অনুযায়ী ঢাকায় আরও একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
যেভাবে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরে অপরিকল্পিতভাবে বিল্ডিং
কোড না মেনে ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে, তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু
অধিক সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে প্রলয়ংকরী ধ্বংসলীলা। ভূমিকম্প
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ৬ রিখটার মানের বেশি কিংবা ১৮৯৭ সালের মতো একটি
ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বাড়িঘর ও স্থাপনা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন
টাওয়ারের মতো ধুলায় পরিণত হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সমসাময়িককালে নির্মিত
অনেক আধুনিক ভবনও দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। ভবন নির্মাণে
নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারসহ ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন ও নানা অনিয়ম
এজন্য দায়ী হলেও তা প্রতিকারে কর্তৃপক্ষের রয়েছে চরম গাফিলতি ও উদাসীনতা।
ফলে দেশের নানা স্থানে প্রায়ই ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। ইতিপূর্বে রাজধানীর
বেগুনবাড়ি, শেওড়াপাড়া, কল্যাণপুর, গ্রীনরোডসহ বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবন
ধসের ঘটনা ঘটেছে। সাভারের রানা প্লাজা ধসে প্রচুর মানুষ হতাহত হওয়ার খবর
সর্বজনবিদিত। বহুতল ভবন নির্মাণে প্রায় ক্ষেত্রেই জাতীয় বিল্ডিং কোড
যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এটিও দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ। এর ফলে
ভূমিকম্প হলে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
অনেক বেশি হবে। ভূমিকম্পের মতো একটি পূর্বাভাসবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ
মোকাবেলার মতো মজবুত অর্থনীতি আমাদের না থাকায় কম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করার
উপায় হিসেবে জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা অপরিহার্য। যখনই
কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কর্তৃপক্ষ এর হোতাদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত কমিটি
প্রভৃতির আয়োজন করে কিছুদিন বেশ সরব ভূমিকা পালন করে থাকে। তারপর সবকিছুই
আবার বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে দুর্ঘটনা ঘটলে আধুনিক
প্রযুক্তি, জনবল, অর্থবল প্রভৃতির কল্যাণে খুব সহজেই তারা তা সামাল দিতে
পারে। আমাদের না আছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, না আছে জনবল ও আর্থিক সঙ্গতি। এ
অবস্থায় আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সামাল দেয়া দুরূহ- তা বলার অপেক্ষা
রাখে না। কাজেই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে যথাযথ মান
বজায় রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com
সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com
No comments