ঐতিহ্যের বাঁধনে নকশিকাঁথা by হাজী মোহাম্মদ মহসীন
ঋতুচক্রে
শীতকাল। সকালটা উজ্জ্বল ও সজীবতায় টইটম্বুর। প্রকৃতিপ্রেমিক বলে কখনও
গ্রাম্যপথে আবার কখনও নদী তীরবর্তী মেঠোপথে হাঁটার অভ্যাস নিত্যদিন। যখন
গাঁওগ্রাম দিয়ে হাঁটি তখন দৃষ্টিতে বাধে জেলে সম্প্রদায়ের নানা রকমের হাতের
কাজ। স্থানটি সোনারগাঁ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড রঘুভাঙ্গা গ্রাম।
তার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য নকশিকাঁথা। এই কাঁথা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে সনাতন
ধর্মাবলম্বী বেদেনারানি বর্মণ, রিংকুরানি বর্মণ, তারারানি বর্মণ। একটু কাছে
গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি, বৌদি নকশিকাঁথা বোনছেন, জি ভাই। তড়িঘড়ি করে
বসতে দেয়। পরক্ষণে আন্তরিকতার সঙ্গে কথা হয়। আমরা শহরের মেয়ে জেলে পরিবারের
ছেলের বউ। নকশিকাঁথা বা পত্তনি কাঁথা মনের মাধুরী মিশিয়ে নিখঁতভাবে ফুটিয়ে
তোলাই আমাদের লক্ষ্য। তাতে আমাদের চাহিদাও কম নয়। কদর আছে বলেই
চাহিদামাফিক সাপ্লাইও দেই। সনাতন ধর্মের তারারানি বর্মণ, বেদেনারানি বর্মণ
বলেন, ১টি কাঁথা তৈরিতে তিনজনের সময় লাগে দুই দিন। কাজের বিনিময়ে
পারিশ্রমিক পাই ৩০০ টাকা। এভাবে সপ্তা গড়িয়ে যখন মাস আসে পরিমাণ দাঁড়ায় ৪
হাজার ৫০০ টাকা। ভাই, স্বামী জেলে। সংসার বড়। নদী মোহনায় জাল বেয়ে মাছ
শিকারে পেটের জালা নিবারণ করা যে কত বড় দায় তা আমরা বুঝি। আর গরিব হয়ে
‘জন্মানো’ বড় পাপ। আর বেঁচে থাকার নামই জীবন নয়, কর্মেই জীবন। স্বামীর
পাশাপাশি একটু সহানুভূতি স্ত্রী হিসেবে দুঃখ-কষ্ট লাগবে তিন জা-ই মহাখুশি।
সংসারের অভাব-অনটনে আশুরারানি বর্মণও (শাশুড়ি) জাল শেলাইয়ের কাজে নিজেকে
নিয়োজিত করেছেন। জেলে সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা চাকরি করার যোগ্যতাসম্পন্ন
কমই হয়। তাদের জীবনযাত্রার মান নির্মম ও নিষ্ঠুর অবহেলায় শামিল বলা যায়।
ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, নিজের হাত খরচ স্বামীর ওপর কাজ করি বিধায় নির্ভর করতে
তেমন একটা হয় না। তাদের বাচন ভঙ্গি ও মিষ্টি কথায় সহজেই মুগ্ধ হই। শহর
কিংবা গ্রামে কাপড়ের ওপর নকশা করা কাঁথাই নকশ িকাঁথা বলে চিনে। বাংলায়
বিশদভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, সূক্ষ্ম হাতে সুঁচ আর বিভিন্ন রঙের সুতায়
গ্রামের বউ-শাশুড়ি ও ঝিয়েরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নান্দনিক রূপ ও বৈচিত্র্যের
যে কাঁথা বোনে, তা-ই নকশিকাঁথা। জীবনকাল নানা সৌন্দর্যের প্রতীকের নিদর্শন
ফুটে উঠে নকশিকাঁথায়। আবহমান কাল ধরে নকশিকাঁথায় যে শিল্পকর্ম ফুটে উঠেছে
তা বাংলার শিল্পসাহিত্য আচার আচারণে প্রকৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য বলে গণ্য। আর
নির্মাণশৈলী নকশিকাঁথা সাধারণত দুই পাটের অথবা তিন পাটের হয়ে থাকে।
চার-পাঁচ পাটের কাঁথা শীত নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাতে কোনো নকশা থাকে
না। কাঁথাকে মেঝের ওপর তুলে ধরে তার উপরে বসে কাঁথা সেলাই করতে হয়। আবার
পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা হাট, বাজার, তাঁতিদের কাছ থেকে
বাহারি সুতা ক্রয় করে, লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ প্রভৃতি সুতা ক্রয় করে
নকশিকাঁথা সেলাই করতে হয়। এই নকশিকাঁথা শেলাই এরও নাম আছে, চলমান শেলাই,
লহরি কাঁথা, আনারসি কাঁথা, বাঁকা শেলাই, সুজনি কাঁথা উল্লেখযোগ্য।এতে
বিভিন্ন নকশা যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা, পদ্ম, সূর্য, চন্দ্র,
স্বস্তিকা, চাকা, জীবন বৃক্ষ, কালকা নকশা ইত্যাদি। পুরো বাংলাদেশেই
নকশিকাঁথা তৈরি হয়, তবে রাজশাহী, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও যশোর নকশিকাঁথার জন্য
বিখ্যাত। উনিশ শতকের কিছু কাঁথায় কাঁথাফোঁড়ের উদ্ভাবনী প্রয়োগকে কুশলতার
সঙ্গে ব্যবহার করার ফলে উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়।
কাঁথাফোঁড়ের
বৈচিত্র্য আছে এবং সেই অনুযায়ী এর দুটি নাম আছে- পাটি বা চাটাই ফোঁড় এবং
কাইত্যা ফোঁড় অনুযায়ী নকশিকাঁথা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। নকশিকাঁথার মাঠ
বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য আখ্যানকাব্য। এই আখ্যানকাব্যের লেখক পল্লী কবি
জসীমউদ্দিন। ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যোপন্যাসটি রূপাই ও সাজু নামক দুই
গ্রামের যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী বাস্তব চরিত্র তিনি
লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই তো পল্লী কবি জসিমউদ্দীন নকশিকাঁথায় বিভোর হয়ে
লিখেছেন- নকশিকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে ‘মরিবার কালে বলে গিয়েছিল... তাহার
নকশিকাঁথা, কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!’ অন্যদেশি শীতের
পোশাক কম্বলের আগ্রাসনে বাংলার প্রসিদ্ধ নকশিকাঁথার কদর এখনও টিকে আছে
ইউরোপজুড়ে। রাজধানী শহর ঢাকা থেকে অনেক ‘বুটিক শপ’ মালিকরা প্রাচীন বাংলার
রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিখুঁত কারিগর দ্বারা নকশি করে বাজারজাতের উদ্দেশ্যে
আমদানি-রফতানি করে থাকেন। নকশিকাঁথা বিলাসি মানুষের এক পরম ও প্রত্যাশিত
বস্তু হিসেবে যার কোনো তুলনা হয় না। গ্রাম, শহর, বন্দর সব জাগায় স্থান করে
নেয় নকশিকাঁথা। বাড়িতে নতুন কুটুম (জামাই) আত্মীয়-স্বজন এলে নকশিকাঁথা,
নকশি বালিশ, দস্তরখানা ও নকশি করা কাঁথা উপঢৌকন হিসেবে আপায়ন করা হয়। তাতে
উভয়ে আনন্দ-উপভোগ্যের সীমা নেই। বাংলাদেশ ও ভিনদেশের মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত
রয়েছে চিরচিনা বাংলার নকশিকাঁথা। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর শাহবাগ,
চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের গড়া সোনারগাঁ লোক-কারুশিল্প জাদুঘরের
কারুপল্লীতে পাওয়া যাবে।
লেখক: প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
লেখক: প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
No comments