মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির রিভিউ খারিজের রায় কারাগারে
ফাঁসির
রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ তিন
আসামির করা আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের রায় কারাগারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে
পাঠানো হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার হত্যা চেষ্টা মামলায়
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি হলেন শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও
দেলোয়ার ওরফে রিপন। মঙ্গলবার সকালে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ রায়
প্রদানকারী তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর রায়ের কপি কারাগার, বিচারিক আদালত,
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে পাঠানো হয়। এ
ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. সাব্বির ফয়েজ
যুগান্তরকে বলেন, ৫ পৃষ্ঠার রায়টি সকালে প্রকাশিত হয়। প্রক্রিয়া অনুসারে
আপিল বিভাগ থেকে রায়ের কপিটি হাইকোর্ট বিভাগ ও বিচারিক আদালত হয়ে কারাগারে
যাবে। এর আগে এই তিন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া
রায় রিভিউ চেয়ে করা আবেদন ১৯ মার্চ খারিজ করেন আপিল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে
আসামিদের এই মামলায় আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়। এখন নিয়ম অনুযায়ী রিভিউ
খারিজ আদেশের কপি হাতে পেলে কর্তৃপক্ষ আসামিদের ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে
জেলকোড অনুযায়ী ‘২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয়’ বলে যে বিধান রয়েছে
তা অনুসরণ করবে। পাশাপাশি এর মধ্যে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা
চাওয়ার সুযোগও নিতে পারেন। ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, তাদের ফাঁসি
কার্যকরের প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়েছে।
কিন্তু রিভিউ আবেদন করায় থেমে ছিল।
এখন রিভিউ খারিজের রায় কারাগারে পৌঁছানোর পরে আসামিদের কাছে জানতে চাওয়া
হবে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কী না। প্রাণভিক্ষা চাইলে
রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর তাদের ফাঁসি কার্যকর নির্ভর করবে। আর
প্রাণভিক্ষা না চাইলে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের ফাঁসি কার্যকরের ব্যাপারে
সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে তাদের ক্ষেত্রে জেলকোড প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে জেল
কর্তৃপক্ষ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর থেকে ফাঁসি কার্যকরে ‘২১ দিনের আগে নয়
এবং ২৮ দিনের পরে নয়’ বলে যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ করবে। মামলার ইতিহাস :
সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ২০০৪ সালের ২১ মে তৎকালীন ব্রিটিশ
হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেড হামলার মুখে পড়েন। এতে ঘটনাস্থলেই
পুলিশের এএসআই কামাল উদ্দিন নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশ কনস্টেবল রুবেল আহমেদ ও
হাবিল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি মারা যান হাসপাতালে। আনোয়ার চৌধুরী ও
সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অন্তত ৪০ জন ওই ঘটনায় আহত হন। এ ঘটনায় ওই দিনই
কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। ৫৬ জনের
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
আসামিদের মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মহিবুল্লাহ ও
আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের
আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম
ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ নিন্ম আদালতের রায়
বহাল রাখেন। পরে আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর
সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়েও ওই তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজার
সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। আপিল বিভাগের রায় হাইকোর্ট হয়ে নিন্ম আদালতে যাওয়ার
পর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং তা গত ৩ ফেব্রুয়ারি
গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদন করেন তিন
আসামি। শুনানি শেষে রোববার আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। মঙ্গলবার রিভিউ
খারিজের রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে বলা হয়েছে, এই মর্মে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে
যে, আবেদনকারী মুফতি আবদুল হান্নান একজন হার্ডকোর সন্ত্রাসী। যে এই
সন্ত্রাসী কার্যাক্রমের মূল হোতা এবং বোমা সরবরাহকারী ও অন্য অভিযুক্তরা
ঘটনায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের মতে, এটা বাংলাদেশের অন্যতম
হন্তারক ঘটনা, যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে। ঘটনাটি এতই নৃশংস ছিল
যে, কারও মনেই এটা আসতে পারে না যে, হাইকমিশনারকে হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য
ছিল না। কিন্তু মারাত্মক আহত হয়ে ঘটনাক্রমে তিনি বেঁচে যান। সঙ্গে থাকা
অন্যরা বিস্ফোরকের আঘাতে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদণ্ড বহালের বিষয়ে
আপিল বিভাগ বলেন, ফাঁসি বহাল রেখে এই আদালতের দেয়া রায়ের আইনগত বিষয়ে
আইনজীবী (হান্নানের আইনজীবী) কোনো ভুল দেখাতে পারেননি। তাই আমরা এই রিভিউ
আবেদনের কোনো সারবত্তা পাইনি। এ কারণে এই পুনর্বিবেচনার আবেদনগুলো খারিজ
করা হল। মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : একসময় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল
জিহাদের নেতৃত্বদানকারী মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা
হামলার অভিযোগ ছাড়াও নাশকতার অজস্র অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাসহ একশ’রও বেশি মানুষকে হত্যার ঘটনায় এসেছে তার নাম।
অন্তত ১৩টি মামলায় তার বিচার চলছে।
২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের
কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার
ঘটনায় করা মামলায় মুফতি হান্নানের নাম আসে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু
এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলাতেও তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ
আছে। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মামলাতেও তার
মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ওই হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানসহ আসামিদের ডেথ
রেফারেন্সের ওপর হাইকোর্টে শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গত ৬ মার্চ
একটি মামলার শুনানি শেষে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে
কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ার পথে টঙ্গীতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে
তাদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। জামা’আতুল মুজাহিদীনের যে জঙ্গিদের ফাঁসি
কার্যকর হয় : এর আগে ঝালকাঠিতে দুই বিচারককে বোমা মেরে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ
জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে জেএমবির শীর্ষ দুই নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও
সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষজঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ৩০
মার্চ। এ মামলার অপর আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
গত বছরের ১৬ অক্টোবর।
No comments