খরচ অনেক বেশি পড়ছে
২৪০০ মেগাওয়াটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১২৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে দুটি ভিভিইআর রিঅ্যাক্টর আছে। এর সঙ্গে আমরা যদি সম্ভাব্যতা যাচাই ও কেন্দ্র নির্মাণের খরচ হিসাবে আরও ৫৫ কোটি ডলার যোগ করি, তাহলে মোট মূল্য দাঁড়াবে ১৩২০ কোটি ডলার। দেখাই যাচ্ছে, এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। এই অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুতের দরকার আছে, কিন্তু সেটা যেকোনো মূল্যে নয়। আমরা যদি বিভিন্ন আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ তুলনা করি, তাহলে কিলোওয়াটপ্রতি দাম হিসাব করা সুবিধাজনক হবে। এই হিসাবে ২৪০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ১৩২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হলে কিলোওয়াটপ্রতি খরচ পড়বে ৫ হাজার ৫০০ ডলার। স্মরণ করা যেতে পারে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০০৯ সালে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সে বছরের মার্চ মাসে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আমি বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনকে (বিএইসি) পরামর্শ দিই, তারা যেন রূপপুরে ১০০০ মেগাওয়াটের তৃতীয় প্রজন্মের দুটি পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর স্থাপন করে। তখন আশা করা হয়েছিল, ২০১৮-১৯ সাল নাগাদ এই কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে। ভারতে রাশিয়ার নির্মিত দুটি একই রকম রিঅ্যাক্টর স্থাপনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তখন ধারণা করা হয়েছিল, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ কিলোওয়াটপ্রতি দুই হাজার ডলারের বেশি পড়বে না। ভারতের কুন্দনকুলানে ওই দুটি রিঅ্যাক্টর স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে, তার প্রকৃত খরচ ছিল কিলোওয়াটপ্রতি ১ হাজার ৩০০ ডলার। দুর্ভাগ্যবশত, ২০১৩ সাল পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ খুব ধীরে ধীরে এগিয়েছে। তখন বিএইসি সম্ভাব্যতা যাচাই ও কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
বাস্তবতা হলো, ২০০৯ সালে আমিসহ অন্য বিশেষজ্ঞরা বিএইসিকে প্রকৌশলী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম। এরপর তারা সেই আলোকে কাজ শুরু করতে পারত। এত দিনে তারা বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করতে পারত। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার কারণে তারা এ সুযোগ হারিয়েছে। পারমাণবিক কেন্দ্রের জনবল সম্পর্কে আইএইএ বলেছে, ‘যোগ্য জনবল ছাড়া কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র যথাযথভাবে পরিকল্পনা, নির্মাণ ও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এটা ছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘চুক্তিতে যা-ই থাকুক না কেন, কিছু কাজ করা খুবই জরুরি, যার দায়দায়িত্ব স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। এই কাজটা মূলত যোগ্যতাসম্পন্ন স্থানীয় জনশক্তিকে করতে হবে।’ কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ না করেই আমরা দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছি। পরিষ্কারভাবেই ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের মতো হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা শুধু বিএইসিকে দোষারোপ করতে পারি না, কারণ, তারা দিন দিন স্বায়ত্তশাসন হারাচ্ছে। অন্যদিকে রূপপুরসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নিয়ে থাকে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটার পর অনেক দেশই, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর রাশিয়া, চীন ও ভারত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও ডিজাইনে নতুন নিরাপত্তাব্যবস্থা যুক্ত করেছে। এতে পারমাণবিক বিদ্যুতের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, কুন্দনকুলামের নতুন দুটি ইউনিটের ভিভিইআর-১০০০ রিঅ্যাক্টরের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কিলোওয়াটপ্রতি তিন হাজার ডলার, যেখানে প্রথম দুটি ইউনিটের জন্য এই রিঅ্যাক্টরের দাম পড়েছিল কিলোওয়াটপ্রতি ১৩০০ ডলার। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দেরি হওয়ায় ২০১৩ সালের মার্চ মাসে আমি পরামর্শ দিই, দুটি ভিভিইআর-১০০০ রিঅ্যাক্টরের জায়গায় একই সংখ্যক ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টরের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমি বেশ কিছু বিবেচনায় এই পরামর্শ দিয়েছিলাম: ক. এই দেরির কারণে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ২০২৩ সালের আগে কার্যক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা কম। সে সময় নিরাপদভাবেই ১২০০ মেগাওয়াটের রিঅ্যাক্টর জাতীয় গ্রিডের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। অর্থনৈতিক সূত্র অনুসারে (ইকোনমি অব স্কেল), বড় কেন্দ্রের খরচ ছোট কেন্দ্রের খরচের চেয়ে কম। খ. ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টর-সংবলিত কেন্দ্রে মডুলার ও কমপ্যাক্ট ডিজাইন অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এর মাধ্যমে খরচ ব্যাপক হারে কমানো সম্ভব। গ. ভিভিইআর-১০০০ রিঅ্যাক্টরের চেয়ে ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তা-বৈশিষ্ট্য অধিকতর উন্নত। অবশেষে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (বিএইসি) দুটি ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টর কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর জন্য কিলোওয়াটপ্রতি সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার খরচ পড়বে। এটা রীতিমতো ধাক্কা খাওয়ার মতো, কারণ এতে উল্লিখিত খরচ হ্রাসের ব্যাপার নেই। বাস্তবতা হলো, এর দাম কিলোওয়াটপ্রতি ৩ হাজার ডলারের বেশি হওয়ার কথা নয়। দুটি বড় শীতক টাওয়ার ও রূপপুরের মাটির নিম্নমানের কারণে রিঅ্যাক্টর নির্মাণে ভারী ভিত তৈরি করতে হবে। ফলে সব মিলিয়ে খরচ সর্বোচ্চ কিলোওয়াটপ্রতি চার হাজার ডলারের বেশি হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার একেবারেই অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, একই জিনিস রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ ২ ও নভোভোরোনেঝ ২-এ বসাতে রূপপুরের অর্ধেক খরচ হয়েছে। এই মূল্য দেওয়ার কারণ হচ্ছে, আমাদের আলোচনাকারীদের ব্যাপারটা যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করার প্রয়োজনীয় বিশেষ জ্ঞান নেই। কথা হচ্ছে, আমরা যদি ইউরোপ, ভারত ও বাংলাদেশে একই পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর স্থাপন করি, তাহলে আমাদের দেশে খরচ অনেক কম পড়ার কথা। কারণ, আমাদের শ্রমিকের মজুরি ও উপকরণগত খরচ অনেক কম। আমরা সাধারণত বিদ্যুৎ প্রকল্পের খরচকে তিন ভাগে ভাগ করি: ১. যন্ত্রপাতি, ২. উপকরণ, ৩. শ্রমমূল্য। যন্ত্রপাতির খরচ স্থানের ওপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ ইউরোপের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও শ্রমমূল্যের সাপেক্ষে আমাদের দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ হিসাব করা যাবে। সে হিসাবে ভারত ও বাংলাদেশে খরচ কম পড়ার কথা। এখন গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে, রূপপুরের খরচ কেন রাশিয়ার ওই দুটি কেন্দ্রের চেয়ে বেশি পড়বে, যেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকের খরচ রাশিয়ার শ্রমিকের খরচের ছয় ভাগের এক ভাগ। আমাদের আলোচনাকারীরা কি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন? এ ব্যাপারে ভারতের কিছু বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা আছে। ফলে তারা কুন্দনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর খরচের ব্যাপারে সফলভাবে আলোচনা করতে পেরেছে।
আমাদের আলোচনাকারীরা তা করতে পারেননি। এমনকি তাঁরা স্বাধীন পরামর্শক ও দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেননি। তবে এখনো হয়তো বেশি দেরি হয়নি। যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও শ্রমমূল্যের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় এনে খরচ কমানো যায়। আমরা স্থানীয় প্রকৌশলী ও দক্ষ বা আদা-দক্ষ শ্রমিকদের ব্যবহার করে নির্মাণের খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। আমরা যদি খরচ পুনর্নির্ধারণ করে কিলোওয়াটপ্রতি চার হাজার ডলারের নিচে নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে ৩৬০ কোটি ডলার বেঁচে যাবে। এটা আরও একটি পদ্মা বা যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য যথেষ্ট। আবার আমরা ভারতের মতো ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টর বাদ দিয়ে ভিভিইআর-১০০০ রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করতে পারি। আমার যদি কিলোওয়াটপ্রতি চার হাজার ডলার ব্যয় করি তাহলেও তিনটি ১০০০ মেগাওয়াটের রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা যায়, ১২০০ কোটি ডলার খরচ করে যেখান থেকে মোট ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অর্থাৎ ১২০ কোটি ডলার কম খরচ করে ৬০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। চুক্তি নিয়ে পুনরালোচনা সহজ নয়। কিন্তু আমাদের ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় সে চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমত, আমাদের একজন স্বাধীন ও অভিজ্ঞ পরামর্শকের সঙ্গে কথা বলা খুবই দরকার। দ্বিতীয়ত, সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৃতীয়ত, বিষয়টি রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
No comments