জঙ্গি হামলার শংকায় থানায় থানায় কড়া নিরাপত্তা
থানার
মূল গেট বন্ধ। মিনি গেট দিয়ে চলছিল যাতায়াত। যারাই ভেতরে যেতে চাচ্ছিলেন
তাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছিল। সন্দেহ হলেই হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর
দিয়ে দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি করা হচ্ছিল। গেটের কাছে থানার ভেতরে স্থাপন করা
হয়েছে সুরক্ষিত বাঙ্কার। সেখানে অস্ত্র তাক করে দায়িত্ব পালন করছিল একজন
পুলিশ সদস্য। চোখ তার গেটের দিকে। দেখে তাকে সদা প্রস্তুতই মনে হল। কেবল
গেটেই যে নিরাপত্তার তোড়জোড় তা নয়, ভেতরে গিয়েও তা টের পাওয়া গেল। মঙ্গলবার
রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে এ দৃশ্যাবলী চোখে পড়ল। কেবল মিরপুর মডেল
থানায়ই নয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, রূপনগর, দারুস সালাম, যাত্রাবাড়ী,
কদমতলী, শ্যামপুর, ওয়ারী, মুগদা, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারা এবং
খিলক্ষেতসহ মহানগরীর সব থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি ঘুরে মঙ্গলবার নজিরবিহীন এ
নিরাপত্তা চিত্র চোখে পড়েছে। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা থানা-ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে
অস্ত্রাগার লুট, বন্দিদের ছিনিয়ে নেয়া সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের চিঠির পর এমন নিরাপত্তা
ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সোমবার ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সব থানা ও
ইউনিটে এ চিঠি পাঠান। সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ওই চিঠির পরই ঢেলে
সাজানো হয় থানা ও ফাঁড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দুপুর ১২টায় রাজধানীর
মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার মূল গেট বন্ধ। গেটের ভেতরে একাধিক
পুলিশ সদস্য বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিচয় নিশ্চিত
হওয়ার পর এক দফা তল্লাশির পর ভেতরে ঢুকতে দেয়া হল। তবে মোটরসাইকেলটি বাইরেই
রেখে যেতে হল। আলাপ হয় থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানে আলম মুন্সীর সঙ্গে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশের পর থানা এলাকায় তিন
স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন আমরা যতটা সতর্ক, অতীতে কখনও এত
সতর্ক ছিলাম না।
কেবল থানার নিরাপত্তাই জোরদার করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ
স্থাপনাগুলোতেও নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাত ১২টার পর
থানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে
তিনি বলেন, ‘কমিশনারের নির্দেশ পেয়ে আমরা যেমন তদারকি বাড়িয়েছি, তেমনি
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আমাদের ওপর তদারকি বাড়িয়েছেন। তারা থানা রাউন্ড
বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আগে কখনও গেটে বুলেটপ্র“ফ হেমলেট বা
জ্যাকেট পরে কেউ দায়িত্ব পালন করত না। কিন্তু এখন করতে হচ্ছে।’ মোহাম্মদপুর
থেকে রাজধানীর আদাবর থানায় গিয়েও একই চিত্র দেখা গেল। থানা ভবনের বাইরের
গেটে দু’জন পুলিশ সদস্য হ্যান্ডমেটাল ডিটেক্টর দিয়ে থানার ভেতরে যেতে
ইচ্ছুক লোকজনের শরীর তল্লাশি করছেন। আরেকজনকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে থাকতে
দেখা গেল। নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে থানার ভেতর গিয়ে কথা হয় ওসি শাহিনুর
রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কমিশনার মহোদয় যে ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন
সেগুলো যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে। এখন আর কোনো মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখা
হচ্ছে না। দেখা হচ্ছে আরোহীর সঙ্গে কোনো বিস্ফোরক আছে কিনা। পুলিশ সদস্যদের
জন্য বাইরে থেকে খাবার আনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা থানার বাইরে ডিউটি
করছেন তারাও পালাক্রমে থানায় এসে মেসের খাবার খেয়ে যাচ্ছেন।’ বেলা পৌনে
২টায় পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিসে
প্রবেশের সামনের রাস্তায়ও বসানো হয়েছে অতিরিক্ত চেকপোস্ট। মূল গেট বন্ধ করে
রাখা হয়েছে। কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে খাতায় নাম
লিখে ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে। কথা হয় মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক শাহজালাল আলমের
সঙ্গে। তিনি জানান, এর আগে ২০১৬ সালের ২ মার্চ ডিএমপি যে বিশেষ নির্দেশনা
দিয়েছিল তখনই একটি বাঙ্কার তৈরি করা হয়। তখন সেটি ছিল বাইরে। সোমবারের
নির্দেশনার পর সেই বাঙ্কারটি ভেতরে আনা হয়েছে। চেকপোস্ট এবং সেন্ট্রি
বাড়ানোর পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা ব্যাকআপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কর্মকর্তাদের ডিউটি তদারকির জন্য দু’জন অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগে
এলার্ম স্কিম ছিল না। এখন করা হয়েছে। থানা আক্রান্ত হলে কোনো পুলিশ সদস্য
কোনো দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন তা এলার্ম স্কিমের মাধ্যমে নির্ধারণ করে
দেয়া হয়েছে।
থানায় ১২টি সিসি ক্যামেরা আছে। আরও পাঁচটি নতুন বসানোর উদ্যোগ
নেয়া হয়েছে। থানার ভেতর, বাইরে, প্রবেশপথ, অস্ত্রাগার এবং হাজতখানা রাখা
হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। বেলা আড়াইটার দিকে রূপনগর থানায় গিয়ে একই চিত্র
পাওয়া গেল। পরে রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আক্তারুজ্জামান
যুগান্তরকে বলেন, আমি নিজে অসুস্থ। তারপরও ডিউটিতে এসেছি কেবল কমিশনার
মহোদয়ের নির্দেশে। দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান বলেন, সবার আগে
পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তিনি জানান, সেন্ট্রি দ্বিগুণ
করা হয়েছে। সেন্ট্রির সঙ্গে অতিরিক্ত ভারি অস্ত্র দেয়া হয়েছে। সঠিক সময়ে
যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় সে বিষয়ে সব পুলিশ সদস্যকে সতর্ক করা হয়েছে।
পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্টের সংখ্যা। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর
রহমান জানান, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আক্রমণাত্মক ও সতর্ক পুলিশিং
ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। থানায় সার্বক্ষণিক একজন পরিদর্শক উপস্থিত থাকছেন।
এলার্ম স্কিমের বিষয়টি সব কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। চেকপোস্টগুলোতে
কমপক্ষে পাঁচজন পুলিশ সদস্য রাখা হচ্ছে। তিনজন অনগার্ড পজিশনে এবং দু’জনকে
তল্লাশির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা যাতে মনোবল হারিয়ে না ফেলেন
সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। ওয়ারী থানার ওসি
জিহাদ হোসেন (বিপিএম) বলেন, সাদা পোশাকেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
বেতারচালককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের
সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। থানার ওপরও নজরদারি চলছে পদস্থদের।
No comments