দেশের অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির সুবিধাবঞ্চিত
দেশের
প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনও বিশুদ্ধ পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে। সরকারিভাবে
নানা ধরনের উদ্যোগের কথা বললেও কার্যকর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের চিত্র
বদলাচ্ছে না। ১৩ মন্ত্রণালয়ের ৩৫টি সংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করছে। কিন্তু এদের
মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করায় অবস্থা পাল্টাচ্ছে না। ফলে
জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ মানহীন পানি পান করে নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে
আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশেষ করে ভয়ানক ঝুঁকিতে রয়েছে যশোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা,
সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, দেশের
পার্বত্য ও হাওর এলাকার দুর্গম জনপদের মানুষ। এ অবস্থায় পৃথিবীর মতো
বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও
সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে
বলেন, সরকার টার্গেটকৃত ২০২১ সালের আগেই দেশের শতভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি
সুবিধার আওতায় আসবে। সেই লক্ষ্যে বহুবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রম
পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের এ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্ট
সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানান এলজিআরডিমন্ত্রী। সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা মারাত্মক আকার ধারণ
করেছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে দেশের ১৩টি
মন্ত্রণালয়ের ৩৫টি সংস্থা। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, গৃহায়ন ও
গণপূর্ত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অধীন
দফতর-অধিদফতর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিতের কাজ করছে। কিন্তু এদের কাজের
মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। যে যার মতো করে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি
তুলছে। অপরিকল্পিতভাবে পানি তোলায় এর স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির দূষণ
রোধেও কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেই। এক মন্ত্রণালয় দূষণ বন্ধের উদ্যোগ নিলে
অন্য মন্ত্রণালয় কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না।
অনেক সময় তারা জানেই না
পানির দূষণ রোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একইভাবে আর্সেনিকসহ দূষিত
পানির স্তর নির্ধারণে যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে না। পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাতেও
সমস্যা দূর হচ্ছে না। দীর্ঘদিনের পুরনো লাইনে পানি সরবরাহ হচ্ছে। এসব লাইনে
নানা ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটি সারানোর জোরালো
উদ্যোগ নেয়া হয় না। এক মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত কাজ করতে চাইলে অন্য
মন্ত্রণালয় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে থাকে। ফলে কাজ পিছিয়ে যায়।
অথচ সমন্বিতভাবে কাজগুলো সম্পন্ন হলে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে এ খাতে
সাফল্য অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ
ভারতের উদাহরণ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। ভারতে পানি ও স্যানিটেশন
ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাংলাদেশ চাইলে
টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সেই পথে এগোতে পারে। জনস্বাস্থ্য
প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি গভীর ও অগভীর
মিলিয়ে ১৫ লাখ ৩ হাজার ৩৭৯টি ওয়াটার পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৪৫
হাজার ওয়াটার পয়েন্ট কার্যকর রয়েছে। আর ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৭৯টি ওয়াটার পয়েন্ট
এখন বিশুদ্ধ পানির উৎস হিসেবে কাজ করছে না। এ হিসাব সংযুক্ত করলে বিশুদ্ধ
পানির সুবিধাবঞ্চিতের হার আরও বাড়বে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবু নাছের খান এ
প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, পানি ব্যবস্থাপনায় সাফল্য পেতে হলে সমন্বয়ের
মাধ্যমে কাজ করতে হবে। নইলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসবে না। এজন্য সরকারকে
সমন্বয় সাধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এর বাইরেও নতুন
কিছু করা যায় কিনা, সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ এখন পানি
প্রাপ্তির অধিকার প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার। সরকারকে অবশ্যই প্রত্যেক
নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের
এক জরিপে (২০১৫) বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫৯ ভাগ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা
থেকে বঞ্চিত।
১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ
কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এ জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক
সংস্থা দুটি। গত দু’বছর এ বিষয়ের ওপর তারা কাজ করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে,
অগ্রগতির হার বিবেচনায় দেখা গেছে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ ভাগ
মানুষ বিশুদ্ধ পানির আওতায় এসেছে। সেই হিসাবে এখনও ৫০ ভাগ মানুষ এ সুবিধার
বাইরে আছে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১২ ভাগ পাইপ লাইনের মাধ্যমে শোধনকৃত
পানির সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে সিংহভাগ মানুষই শহরের বাসিন্দা। তবে দেশের
কিছু গ্রামীণ জনপদেও পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর পরিমাণ
১ ভাগেরও কম। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৬ ভাগ মানুষ এখন শহরে বাস করে। আর ৭৪
ভাগ মানুষ বসবাস করে গ্রামে। অবশ্য সরকারি হিসাব বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশের ৯৯ ভাগ মানুষকে পানি সুবিধার
আওতায় আনতে পেয়েছে সরকার। শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকার ১ ভাগ মানুষ পানি
সুবিধার বাইরে রয়েছে। আর ৮৭ ভাগ মানুষ চলে এসেছে সুপেয় পানির আওতায়। বাকি
১৩ ভাগ জনগোষ্ঠীকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সুবিধার আওতায় আনা হবে।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের দূষিত
পানির অন্যতম কারণ ‘আর্সেনিক’। একসময় দাতা সংস্থাগুলো আর্সেনিক দূষণ
প্রতিরোধে অর্থায়ন করেছে, তখন বেশ কিছু প্রকল্প দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন
দাতারা সে ধরনের প্রকল্প দিচ্ছে না। এজন্য সরকারকে বসে থাকলে চলবে না।
আর্সেনিক প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। এ কার্যক্রম সব সময় চালু রাখতে হবে। তিনি
আরও বলেন, বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সব নাগরিককে বিশুদ্ধ পানির
আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে বোঝা যায়, এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক।
সরকারের উচিত এলাকাভিত্তিক চাহিদার আলোকে প্রকল্প গ্রহণ করে সেসব সমস্যা
সমাধান করে জনগণকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের
নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে ২০১১ সালের মধ্যে
শতভাগ মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সুবিধার আওতায় আনার অঙ্গীকার করলেও তা
বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে দলটি ২০২১ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্যে
পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
ফলে ২০২১ সালের মধ্যে সরকার লক্ষ্য অর্জন
করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে তাদের
যুক্তি হচ্ছে, বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী ওয়াসায় প্রায় ৩০
হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে কাজ চলছে।
পাশাপাশি দেশের অন্য সব এলাকার বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ব্যয়
করা হচ্ছে এর চার ভাগের এক ভাগ। বরাদ্দের ক্ষেত্রে শহর-গ্রামের বৈষম্য দূর
করতে না পারলে শতভাগ বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে
দাঁড়াতে পারে বলে তারা মনে করেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সাবেক
প্রধান প্রকৌশলী পানি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন,
বর্তমান সরকার ১৬ কোটি মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার লক্ষ্যে বহুবিধ
কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছে। ২০২১ সালের মধ্যে সেই উদ্যোগগুলো
বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পরিকল্পনাগুলো সুষ্ঠুভাবে
বাস্তবায়ন করা গেলে সেটা সম্ভব হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর মনিটরিং
নিশ্চিত করা দরকার। এ প্রসঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক
যুগান্তরকে বলেন, দেশের সব নাগরিককে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে হলে
পানিদূষণ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে শক্তভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। তিনি
বলেন, পানিদূষণজনিত অপরাধের কারণে মামলা করার ক্ষমতা শুধু পরিবেশ অধিদফতরের
মহাপরিচালকের। এটা স্থানীয় সরকারের পাঁচ স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের
হস্তান্তর করতে হবে। তাহলে সরকারের সামগ্রিক উদ্যোগের সফলতা আসবে। নইলে
সবকিছু ব্যর্থ চেষ্টায় পর্যবসিত হবে।
No comments