খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাড়ছে গমের চাহিদা
সকালে পান্তা ভাত খেয়ে রিকশা নিয়ে ভাড়া খুঁজতে বের হতেন মো. ফারুক। তবে চালের দাম বাড়ায় দুপুর-রাতের খাওয়া ঠিক থাকলেও সকালের ভাত বাদ দিয়েছেন। খরচ সমন্বয় করতে এখন সকালে রুটি খেয়ে বের হন তিনি। ফারুকের কথায়, চালের বদলে আটা কেনায় এখন পাঁচ সদস্যের পরিবারে মাসে কিছু টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। ফারুকের মতো নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এখন ভাতের ওপর চাপ কমিয়ে রুটি খাচ্ছেন। আবার মধ্য ও উচ্চবিত্তদের অনেকে দুই বেলার পরিবর্তে এক বেলা ভাত খাচ্ছেন। তাঁরা খরচ সাশ্রয়ের জন্য নয়, স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য রুটি খাচ্ছেন। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসায় গমের ব্যবহার বাড়ছে বেশ কিছুদিন ধরে। উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানি করেই মেটাতে হচ্ছে গমের এ চাহিদা। চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাস বাকি থাকতেই গম আমদানিতেও রেকর্ড হয়েছে। অর্থবছর শেষে গম আমদানি এবার অর্ধকোটি টনে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। খাদ্য বিভাগ ও বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, গত সোমবার পর্যন্ত এ অর্থবছরে (৮ মাস ২০ দিন) গম আমদানি হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। আমদানি ছাড়াও এবার গত মৌসুমের চেয়ে ১ লাখ টন বেশি বা ১৪ লাখ ৩০ হাজার টন গম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। এ হিসাবে এ অর্থবছরে গমের সরবরাহ দাঁড়াতে পারে ৬৫ লাখ টনে। খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, এর আগে সবচেয়ে বেশি গম আমদানি হয়েছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। ওই বছর সরকারি-বেসরকারি ও বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসা গমের পরিমাণ ছিল ৪৩ লাখ ৬৬ হাজার টন। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ বা ৩৭ লাখ ৮৪ হাজার টন এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে চতুর্থ সর্বোচ্চ বা ৩৭ লাখ ৫২ হাজার টন আমদানি হয়। গমের চাহিদা বাড়ার কারণ সম্পর্কে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মূলত আটার চেয়ে চালের দাম বেশি বাড়ায় গমের চাহিদা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরাও এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে গম আমদানি করছেন। স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ায় মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে, যা গমের চাহিদা বাড়াচ্ছে। বাজারে এখন গম থেকে তৈরি প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ২৬ টাকা দরে। সরকারি হিসাবে, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়। আটা ও চালের দামের ব্যবধান প্রায় ১২ থেকে ১৪ টাকা, যা এক-দুই বছর আগেও ছিল দুই-তিন টাকা। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ আটার তৈরি খাদ্যে বেশি ঝুঁকছে। আমদানি তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায়, বাজারে আমদানি হওয়া গমের বেশির ভাগই সাধারণ আমিষযুক্ত, যা আমদানি হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। এ ধরনের গম ব্যবহার হয় আটা তৈরিতে, যার ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ। এই গমে আমিষের মাত্রা সাড়ে ১০ থেকে ১১ শতাংশ।
এ অর্থবছরে আমদানি হওয়া গমের অর্ধেকেরও বেশি এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। পরিমাণে কম হলেও মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে গম থেকে তৈরি খাদ্যপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। রেস্তোরাঁয় নতুন নতুন খাবার ও বেকারি পণ্য তৈরিতে উচ্চ আমিষযুক্ত গমের ব্যবহার বেশি হয়। এ ধরনের গম আমদানি হয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনা থেকে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এসব দেশ থেকে উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি হয়েছিল মোট আমদানির ১০ শতাংশ। তবে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। এর বাইরে দেশে তালিকাবদ্ধ ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে এখন ডায়াবেটিক রোগী আছেন ৭১ লাখ, যাঁরা এক বেলা ভাতের পরিবর্তে রুটি খান। চাহিদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছেন তাঁরাও। চাহিদা থাকায় ব্যবসায়ীরাও গম আমদানিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। গম আমদানির ৯৫ শতাংশ আসছে ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। বেসরকারি খাতে সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও বিএসএম গ্রুপ গম আমদানিতে এক দশকের বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। গমের চাহিদা বাড়ায় এখন এসব বড় শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান গম আমদানি ও আটা-ময়দা তৈরির কারখানায় যুক্ত হয়েছে। খাদ্য বিভাগের তথ্যেও দেখা যায়, প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গমের মধ্যে এখনো চালের প্রাপ্যতা ৮৫ শতাংশ। তবে গমের প্রাপ্যতা দিন দিন বাড়ছে। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে গমের প্রাপ্যতা ৭ শতাংশ বেড়ে ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। খাদ্য বিভাগের হিসাবে, গত অর্থবছরে জনপ্রতি গমের প্রাপ্যতা ছিল দিনে ৯৩ গ্রাম। আমদানি বাড়ায় এ বছর তা ১০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
No comments