যশোর টাউন হল ময়দানে নির্মিত হোক স্বাধীনতার স্মারকস্তম্ভ -কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে by আমিরুল আলম খান

ছাব্বিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এই নয় মাসে বাঙালি তার অভূতপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করে, অসম এক যুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে। এ জন্য তাদের স্বীকার করতে হয় অপরিমেয় ত্যাগ। মানুষের রক্ত আর সম্পদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, লুণ্ঠিত হয়েছে নারীর সম্ভ্রম। অবাক পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে বীর বাঙালির গৌরবময় প্রতিরোধ সংগ্রাম, একটি নতুন জাতির অভ্যুদয়। বিশ্বের তাবত্ ছোট-বড়, এমনকি দুই পরাশক্তি কোনো না কোনোভাবে, পক্ষে অথবা বিপক্ষে, অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের। কেউ মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, কেউ তাকে ব্যর্থ করে দিতে অপতত্পরতা চালিয়েছে। এভাবেই ষোলোই ডিসেম্বর এক অনিবার্য বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে যশোর ছিল ৮ নম্বর সেক্টরে। সেক্টর কামান্ডার ছিলেন মেজর মঞ্জুর। তাঁর অধীনে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা। এই সেক্টরের লক্ষ্য ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টসহ পুরো যশোর-কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করা। কলকাতার নিকটবর্তী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকিস্তানের অন্যতম দুর্ভেদ্য দুর্গ। যশোর ক্যান্টনমেন্টের গুরুত্ব বোঝা যায় এই সেনা স্থাপনার পতনের পর ৭ ডিসেম্বরই—গভর্নর আবদুল মালেক পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে যে দুর্গতবার্তা প্রেরণ করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে তা থেকে। সে বার্তায় গভর্নর মালেক জানান, ‘যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় আসন্ন... ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়া গেলে জীবন রক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।’ মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনায় সে বার্তা রাওয়ালপিন্ডি হয়ে চলে যায় হোয়াইট হাউস পর্যন্ত। এই প্রথম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে একমাত্র সমাধানের পথ বলে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৭১-এর প্রতিটি দিন ছিল বাঙালির লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামের দিন। কোনো কোনো দিন পরম গৌরবের, কোনোটি বা হয়তো ছিল কালো তমসাবৃত। জয়-পরাজয়ের পরম্পরায় রচিত সে এক বিচিত্র শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্বেই যশোরে গড়ে তোলা প্রতিরোধ ছিল রীতিমতো অবিশ্বাস্য। ২৯ মার্চ পর্যন্ত যশোরে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে তার বিস্তারিত বয়ান পাওয়া যায় বিবিসি, ভোয়া, অস্ট্রেলীয় বেতারসহ দুনিয়ার নামকরা সব সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। ৩০ মার্চ পর্যন্ত যশোর ছিল মুক্তিপাগল প্রায়-নিরস্ত্র বাঙালিদের দখলে, ক্যান্টনমেন্ট ছিল কার্যত অবরুদ্ধ। সেনাছাউনি থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বেরিয়ে আসার সব রাস্তায় ছিল ব্যারিকেড, প্রতিরোধ। ৩০ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা অস্ত্র সমর্পণের হুকুম অমান্য করে বিদ্রোহ করে। ৩০-৩১ মার্চের সেই অসম কিন্তু বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেনারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন উত্সর্গ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের রাজপথ আপন রক্তে রঞ্জিত করে দেয়। সেই রক্তাক্ত পথ ধরেই অর্জিত হয় বাংলাদেশের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ কিছু দিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ছাড়াও ১৭ এপ্রিল যেমন স্মরণীয়, তেমনি স্মরণীয় ৬ ডিসেম্বর, ১১ ডিসেম্বরও। ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি জানায় স্বাধীন বাংলাদেশকে; আর এদিনই সন্ধ্যায় পতন ঘটে স্ট্যালিনগ্রাড বলে কথিত যশোর ক্যান্টনমেন্টের। ৭ ডিসেম্বর বিজয়-উল্লাসে নৃত্যরত হাজার হাজার মুক্তিসেনা আর মুক্তিপাগল মানুষ প্রবেশ করে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর শহরে। সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর বেদনা। আনন্দ-বেদনার সঘন মুহূর্তকে ভাষা দেবে সাধ্য কার! উপশহর, মুরগি ফার্মে গণকবরে অসংখ্য নরকঙ্কাল আবিষ্কারের মতো শোকবিধুর দৃশ্য আজও যশোরবাসীকে কান্নার সাগরে ভাসায়।
যশোর দুর্গের পতন হানাদার বাহিনীর মনোবল গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু ৯ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সপ্তম নৌবহরকে পাকিস্তানিদের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি সভা চলছে, নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সোভিয়েত ভেটোয় নাকচ হয়েছে বটে, কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কূটকৌশল তখনো অব্যাহত।
মেজর জলিলের নেতৃত্বে নবম সেক্টরের বাহিনী সাতক্ষীরা শত্রুমুক্ত করে খুলনার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু তখনো শত্রুসেনা যশোর শহরের উপকণ্ঠ রামনগরে অবস্থান নিয়ে আছে। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান সিঙ্গিয়া, নোয়াপাড়া, ফুলতলায় ও শিরোমনিতে। শক্ত অবস্থান নিয়ে তারা মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। যশোর শহর তখনো পাকিস্তানি সেনাদের কামানের গোলার আওতায়। সুতরাং যশোর শহর তখনো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম শত্রুসেনামুক্ত জেলা শহর যশোরের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল ময়দানে এক বিজয় সভা করে বাংলাদেশ সরকার। সে সভায় যোগদান করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ফণীভূষণ মজুমদারসহ অন্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা। মাত্র মাইল কয়েক দূরে তখনো শত্রুর অবস্থান, কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের অকুতোভয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রীরা সব শঙ্কা-ভয় উপেক্ষা করে শামিল হন বিজয়ী দেশবাসীর সঙ্গে তাদের বীরত্বকে অভিবাদন জানাতে, স্বাধীনতার সমুজ্জ্বল মুহূর্তকে দেশবাসীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে।
টাউন হল ময়দানে উত্ফুল্ল জনতার মিছিল। মুক্তিসেনাদের এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ-সোনালি স্বাধীন দেশের পতাকা। এক চক্ষু বেয়ে বিজয়ের আনন্দাশ্রু, অন্য চক্ষু বেয়ে নেমে আসছে স্বজন হারানোর বেদনায় বুকভাঙা কান্নার অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা। হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক গোটা টাউন হলজুড়ে এই অবিস্মরণীয় মুহূর্তকে ধারণ করেন। রাতেই বিশ্বব্যাপী সেই সংবাদ প্রচারিত হয় দুনিয়ার সেরা সব সংবাদমাধ্যমে।
এই সভায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। জেলা প্রশাসন চালু ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন তিনি। যশোরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জেলা প্রশাসন। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে ওয়ালিউল ইসলাম যশোর জেলার দায়িত্ব লাভ করেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। এই দুটি দল ও মুসলিম লীগসহ অন্য কিছু দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল শুধু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেনি, নয় মাস ধরে তারা বাঙালিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো অমার্জনীয় অপরাধ করে তারা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য সেই নরপশুদের শাস্তির দাবিতে প্রকম্পিত হয় টাউন হল ময়দান।
আজও যশোরবাসীর কাছে ৬ ও ১১ ডিসেম্বর বিশেষ তাত্পর্যমণ্ডিত, বিশেষ গৌরবের দিন। যশোরবাসী তাই এ দুটি দিবস উদ্যাপন করে হূদয়ের সব শ্রদ্ধার নির্যাস ঢেলে দিয়ে। শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের আত্মার প্রতি, প্রণত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি।
কিন্তু একটি আকাঙ্ক্ষা আজও পূরণ হয়নি যশোরবাসীর। যে টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ সরকার প্রথম জনসভা করেছিল, যেখানে বক্তৃতা করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ফণীভূষণ মজুমদার ও স্থানীয় নেতারা—টাউন হলের সেই স্থানটিতে আজও কোনো স্মারকস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ স্থানটি আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয়, সম্মানীয় করে তোলার জন্য এখনই সময় তেমন উদ্যোগ নেওয়ার।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
amirulkhan570@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.