ইসলামে মৌলিক মানবাধিকার -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় উপকরণ পাঁচটি মৌলিক অধিকার; যথা—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিত্সা। এসব চাহিদা পূরণের যথার্থ ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোনো হতদরিদ্র ও অভাবী নাগরিক অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়লে রাষ্ট্র তার দুঃখ-দুর্দশা মোচন করার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা করবে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কেউ ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, পীড়িত, ক্ষতিগ্রস্ত, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত বা শীতার্ত হয়ে পড়লে তাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় হওয়া, তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে যথাসাধ্য চেষ্টা করা ধর্মপ্রাণ মানুষের অবশ্যকর্তব্য ও ঈমানি দায়িত্ব। অসুস্থ ও রুগ্ণ লোকের চিকিত্সা এবং সেবা-যত্ন করা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করা, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করা, নিরাশ্রয়কে আশ্রয়দান করা, বিদ্যাহীনকে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া, বিপথগামীকে সত্পথ প্রদর্শন করা প্রভৃতি মানবসেবা ও জনকল্যাণমূলক কাজ ইসলামের পরিভাষায় খিদমতে খালকের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম ব্যক্তি যে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খায় আর তার প্রতিবেশী তার পাশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে, সে প্রকৃত ঈমানদার নয়।’ (বায়হাকি)
দেশের মৌলিক অধিকারবঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষের পরিবার চরম খাদ্যাভাবে নিপতিত। তাদের কারও দিনে একবেলাও খাদ্য-পানীয় জোটে না, কেউ কাজের সন্ধানে বাইরে ছড়িয়ে পড়লেও জীবিকার্জনের মতো তেমন কিছু পাওয়া যায় না। নিঃস্ব ও বিপন্ন এসব অসহায় ধর্মভীরু মানুষের জীবনধারণের মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য দরকার প্রচুর পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি, শীতবস্ত্র ও পরিধানের কাপড়চোপড়, আবাসস্থল, গৃহনির্মাণের উপকরণ ও আসবাবপত্র, শিক্ষার উপকরণ, চিকিত্সার সামগ্রী প্রভৃতি। অসহায় নারী ও শিশুদের চিকিত্সাসেবার জন্য অন্তত সব সময় জরুরি ঔষধপথ্য হাতের কাছে রাখা প্রয়োজন। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) জনগণকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দীকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’(বুখারি)
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় নিরন্ন মানবতার সাহায্য-সহযোগিতায় চেষ্টা করা দলমতনির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার ধর্মপ্রাণ মানুষের অবশ্যকরণীয়। তাই আর্তমানবতার বিপদের সময় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সেবায় ও মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিপদগ্রস্ত লোকেরা সাহায্যের অর্থ, ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ, খাবার স্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে খুবই উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের অভাব ও দুর্দিনে এগিয়ে আসবে না, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করবে না এবং আর্তমানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ হবে না, আল্লাহর কাছে অবশ্যই তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা করতে হবে। অসহায় নিঃস্ব হতদরিদ্র মানুষ ইসলাম প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকার হারিয়ে কতটা সীমাহীন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়ে তা সহজেই অনুমেয়। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, তাহলে আকাশের অধিবাসী (‘আল্লাহ তাআলা) তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন।’(তিরমিযি)
যাঁরা অসহায়, বিপদগ্রস্ত, অভাবী, গরিব-দুঃখী এবং অন্ন, বস্ত্র, চিকিত্সা, বাসস্থানহীন মৌলিক অধিকারবঞ্চিত মানুষকে ত্রাণসাহায্য করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁদের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। এ সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন (মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে) বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি।’ সে (মানুষ অবাক হয়ে) বলবে, ‘হে প্রভু, আপনি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক! কীভাবে আপনার সেবা করব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা পীড়িত অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছিল, তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না তার সেবা করলে তুমি আমাকে তার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছি, তুমি খাবার দাওনি।’ সে বলবে, ‘হে প্রভু, আপনি তো জগত্সমূহের প্রতিপালক! কীভাবে আপনাকে খাবার দিব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার কাছে গিয়েছিল, তুমি তাকে খাদ্য দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তাকে খাবার দিলে তুমি তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পান করতে চেয়েছি অথচ তুমি আমাকে পান করাওনি।’ সে বলবে, ‘হে প্রভু, আপনি তো জগত্সমূহের প্রতিপালক! কীভাবে আপনাকে পান করাব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তৃষ্ণার্ত হয়ে তোমার কাছে পান করতে চেয়েছে অথচ তুমি তাকে পান করাওনি। তুমি তাকে পান করালে তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে এবং আমি সন্তুষ্ট হতাম’।” (মুসলিম)
বাস্তুহারা, সম্পদহারা, স্বজনহারা, সহায়-সম্বলহীন আর্তপীড়িত মানুষ চরম ধৈর্য ও দুঃসাহসিকতার সঙ্গে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শক্তি ও সামর্থ্যের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা করে। এসব অসহায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিত্সাহীন বিপন্ন-বিষণ্ন নিঃস্ব মানুষ দেশবাসীর কাছ থেকে একটু মানবিক সাহায্য-সহানুভূতি, সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ব এবং দয়ার্দ্র হূদয়ের প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা আশা করে। চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করা জনগণের অনুপাত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধর্মীয় নেতা বা ইমামদের সমাজে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধকরণের কাজে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর্তমানবতার মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা সমাধানে জাকাতভিত্তিক ইসলামি অর্থব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য জাকাত বণ্টনের খাতসমূহ এ লক্ষ্যেই নিবেদিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিপতিত সমাজের নিরন্ন অসহায়, হতদরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থায় দেশ থেকে ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবান ও ধনাঢ্য সচ্ছল ব্যক্তিদের জাকাত, দানশীলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে ধীরে ধীরে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় সচ্ছলতার উপায় সহজ ও সুগম হতে পারে।
বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসামগ্রী বা উপকরণ যত শিগগির সম্ভব বিনামূল্যে বই-খাতা-কলম হাতে তুলে দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিশু-কিশোর-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রতিটি সদস্যকে শিক্ষিত করে তুলতে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। পবিত্র কোরআনের বাণী ‘ইক্রা’র চেতনায় ও সুন্নাহর শিক্ষার আলোকে উন্নত করতে হবে জাতিকে। নবী করিম (সা.) জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘বিদ্যা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজা) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করো।’ (তিরমিযি)
তাই সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের বিভিন্ন এলাকার ছেলেমেয়েরা যাতে প্রাইমারি স্কুলে পূর্ণ শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করতে পারে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় অশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে উত্সাহিত করতে হবে। ইসলামই সর্বপ্রথম মানুষের সর্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করেছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামে মানবজাতির গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক জীবনবিধান ও আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যখন সমাজে ইসলামি বিধি-বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপূর্ণরূপে অনুশীলন করা হবে এবং সামগ্রিকভাবে তা বাস্তবায়িত হবে তখন অসহায় মানুষ আর মৌলিক মানবাধিকারবঞ্চিত থাকবে না।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.