অসুস্থ ও ভ্রমণরত ব্যক্তির রোজার বিধান by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজানে রোজার বাধ্যবাধকতা, সুযোগ-সুবিধা বা ছাড় সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে না জানার কারণে অনেকে মারাত্মক অসুস্থতা নিয়েও প্রতিদিন রোজা পালন করে থাকেন। ইসলামের বিধি-বিধান অবগত হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি অসুস্থ অবস্থায় রোজা পালন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে, তাহলে তা সুস্পষ্টভাবে দেহ ও মনের ওপর জুলুম বা অত্যাচার করা হবে—এটা আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন। কোনো কোনো রুগ্ণ ব্যক্তির জন্য রোজা বা উপবাস খুবই স্বাস্থ্যহানিকর। সে ক্ষেত্রে উপবাসী হলে তার রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমতাবস্থায় অবস্থায় রোজা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট নীতি মোতাবেক তার বিকল্প পদ্ধতির বিধান দেওয়া হয়েছে। এ জন্য রমজান মাসে অসুস্থতার কারণে কিংবা ভ্রমণরত অবস্থায় রোজা পালন করা কষ্টদায়ক হলে অন্য সময়ে অনুরূপসংখ্যক অর্থাত্ যে কটি রোজা পালন করা সম্ভব হয়নি তা অবশ্যই পালন করার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য সে রোজা পালনও সম্ভব না হলে ফিদ্ইয়া হিসেবে গরিব-মিসকিনকে খাদ্যদানের মাধ্যমে তা পূরণের সুযোগ রয়েছে। সম্ভব হলে অর্থাত্ কষ্টদায়ক না হলে রোজা পালন করাই বিশেষ কল্যাণকর।
ইবাদতের বিষয়ে শারীরিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে রুগ্ণ ও প্রবাসীর জন্য রোজার বিধান যথেষ্ট শিথিল করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোজাদাররা যথাযথ খাবার গ্রহণ না করার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তা ছাড়া অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ ও অপর্যাপ্ত ঘুম দেহকে বিপাকে ফেলে দেয়। তাই অসুস্থ এবং ভ্রমণরত ব্যক্তিদের রোজা পালন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কেউ যদি অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি সফরে থাকে, সে ব্যক্তি সমপরিমাণ দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে গেলে অথবা সফর থেকে ফিরে এলে) পরে আদায় করে নেবে। এরপর যাদের জন্য রোজা রাখা একান্ত কষ্টকর ব্যাপার বলে মনে হবে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সত্কর্ম করে, তার জন্য তা কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৪)
রমজান মাসে গর্ভবতী মহিলা এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর মায়েদের জন্য রোজা পালন বাধ্যতামূলক নয়। আল্লাহ তাআলা গর্ভজাত ও নবজাত শিশুসহ মায়েদের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য মাহে রমজানে রোজা পালনের কড়াকড়ি শিথিল করেছেন। সুস্থ হলে বা সক্ষমতা অর্জন করলে পরবর্তী সময়ে অবশ্যই এ রোজা পূর্ণ করতে হবে। যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান, তাঁরা রোজা রাখলে দুধের পরিমাণ কমে যায় বলে শিশু পর্যাপ্ত দুধ পায় না। অন্যদিকে গর্ভবতী মহিলা রোজা রাখলে কষ্ট হওয়া ছাড়াও গর্ভজাত সন্তানের প্রয়োজনীয় পুষ্টিপ্রাপ্তি, শারীরিক গঠন ও বয়োবৃদ্ধিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাই যে নবজাতকের মা শিশুকে দুধ পান করান তাঁর জন্য রোজা পালন করার বাধ্যবাধকতা পর্যন্ত শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে মসজিদের ইমাম, খতিব, আলেম সমাজ ও বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা গর্ভবতী মহিলা এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর মায়েদের রোজা না রাখার পরামর্শ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ মুসাফিরের ওপর থেকে চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের অর্ধেক রহিত করে দিয়েছেন এবং মুসাফির, স্তন্যদানকারিণী ও গর্ভবতী মহিলা থেকে মাহে রমজানের রোজা পালন করার বাধ্যবাধকতাও শিথিল করে দিয়েছেন।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ ও নাসাঈ)
অসুস্থ ব্যক্তি বলতে রোজা রাখতে যার কঠিন কষ্ট হয় অথবা রোগ মারাত্মক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো বিশেষ রোগ-ব্যাধির উল্লেখ করে অসুস্থ ব্যক্তির রোজা কাজা করার নির্দেশের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি। যেকোনো ধরনের রোগ, যাতে রোজা রাখা তার জন্য দুরূহ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রের জন্য এই অনুমতি। প্রকৃতপক্ষে অসুস্থ ব্যক্তি যদি রোজা রাখার কারণে কোনো শারীরিক ক্ষতি বা মৃত্যুর আশঙ্কাবোধ করে, তাহলে এ অবস্থায় রোজা রাখবে না। সুস্থ হওয়ার পর কাজা আদায় করবে। শুধু মনের ধারণায় অসুস্থতার অজুহাতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকা দুরস্ত নয়। চিকিত্সকের পরামর্শ বা নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা কোনো লক্ষণ দ্বারা প্রবল ধারণা জন্মে যে রোজা রাখলে ক্ষতি হবে তখন রোজা ত্যাগ করা যাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের একদিনের রোজা কোনো (শরিয়ত অনুমোদিত) ওজর বা অসুস্থতা ব্যতীত ভঙ্গ করবে, সারা জীবনের রোজাও এর ক্ষতিপূরণ হবে না, যদি সে সারা জীবনও রোজা রাখে।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদ)
ভ্রমণরত ব্যক্তি বলতে পবিত্র কোরআনের তাফসিরকারক এবং শরীয়তের পরিভাষাবিদেরা ব্যাখ্যা করেছেন যে ওই মুসাফির ব্যক্তি যিনি সফরে আছেন। প্রবাসে থাকলে বা শুধু বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গেলেই কেউ মুসাফির হন না। তাঁর নির্দিষ্ট নিয়ত, নির্দিষ্ট দূরত্বে গমন এবং অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। এতে কিছু শর্তও আরোপ করা হয়েছে। প্রথম শর্ত হলো, সফর দীর্ঘ হতে হবে। নবী করিম (সা.)-এর হাদিস এবং সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণের ওপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানিফা (র.) এবং অন্যান্য ফিকহবিদগণ সফরের দূরত্বকে তিন মনজিল বলে অভিমত প্রকাশ করেন। অর্থাত্ একজন ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে পায়ে হেঁটে তিন দিনে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ততটুকু দূরত্বকে বোঝায়। পরবর্তীকালের ফিকহবিদগণ এ দূরত্বকে ৪৮ মাইল সাব্যস্ত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী সফরের সময়সীমা বলতে সফরকালীন সময় এবং মধ্যবর্তী যাত্রাবিরতির মেয়াদ ঊর্ধ্বপক্ষে ১৫ দিনের কম সময়কে বোঝায়। কেউ যদি ভ্রমণের মধ্যেই কোথাও ১৫ দিন অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন সেটা আর সফরের মধ্যে বিবেচিত হবে না। সফরের দূরত্ব ও অবস্থানের মেয়াদ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায় বিজ্ঞানের বদৌলতে এখন স্বল্প সময়ে প্রায় বিনাক্লেশে অনেক দূরের পথ অতিক্রম করা সম্ভব এবং অবস্থানস্থল অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতীতের মুসাফিরের ন্যায় নয়। রোজা পালনের ক্ষেত্রে অতীতে যেসব প্রেক্ষাপটে বিশেষ বিবেচনায় প্রযোজ্য ছিল আধুনিককালে তা অবস্থা অনুযায়ীই প্রযোজ্য হবে। যে সফর কঠিন বিপজ্জনক, সমস্যাসঙ্কুল এবং রোজা পালনের জন্য অনুকূল নয় সে সফরের দূরত্ব ও সময়সীমা ওই আলোকেই বিবেচিত হবে।
রোজার সময় সুবহে সাদিক বা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার না করার ফলে শরীরের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য এ সময় শরীরকে ভিন্ন নিয়মে চালাতে হয়। যেনতেন অসুস্থতা বা সফরের দোহাই দিয়ে রোজা পালনে বিরত থাকার সহজ ব্যাখ্যা বা অজুহাত দাঁড় করার কোনো অবকাশ নেই। রমজান মাসে রোজা না রাখার জন্য অনেকেই বিভিন্ন অজুহাত খোঁজেন। বিশেষ করে কারও যদি সামান্য অসুস্থতা থাকে তাহলে তিনি রোজা না রাখার পেছনে সে বিষয়কেই তুলে ধরেন। অথচ সামান্য অসুস্থতা তো দূরে থাক, অনেক দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগেও রোজা রাখার ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। রোজা পালনে বিরত থাকার কোনো উপায় ও উপলক্ষ খোঁজা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল।
কতগুলো কঠিন রোগ-ব্যাধি নিয়ে রোজা পালন করলে স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এসব জটিল অসুস্থতা নিয়ে রোজা পালন না করাই শ্রেয়। বস্তুত অসুস্থতা কিংবা ভ্রমণের কারণে শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, শ্রান্তি ও অবসাদে রোজাদার যাতে সকল প্রকার হুকুম-আহকাম পালন করে যথার্থভাবে ইবাদত করতে অসুবিধার সম্মুখীন না হয় সে জন্য অসুস্থতা ও সফরকালে রোজা পালন থেকে সাময়িক অব্যাহতির বিধান দেওয়া হয়েছে। রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার যাতে সজীবতা, হূদয়ের পবিত্রতা এবং চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা অর্জনসহ রুহানি তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও অনুপ্রেরণা লাভ করে সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.