অধ্যাপক নোমান: একটি বাসন্তী সন্ধ্যায় নায়ক -এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
যত দূর মনে পড়ে, সেটা ১৯৮০ সালের একটি বসন্তের বিকেল। ঢাকা কলেজের ১৪০ বছর (খুব সম্ভব) পূর্তি উত্সবে আমি আমন্ত্রিত অতিথি। আমি পঞ্চাশের দশকের ছাত্র হিসেবে আমন্ত্রিত।
অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক, মাঝারি সাইজের ঘনশ্যাম বর্ণের একটি মানুষ ভদ্রলোকের তীক্ষ অনুসন্ধিত্সু এক জোড়া চোখ প্রথমে আকৃষ্ট করেন অসাধারণ বলেই। হাত মিলিয়ে বললেন, ‘Welcome to the college, আপনার আলমা মাটার, আমি প্রিন্সিপাল। আমার নাম নোমান।’
আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা কলেজে পড়ুয়া অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের আপন ছোট ভাই মোয়াত্তের। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। মোয়াত্তেরকে দেখে একনজরে বোঝা যেত ও নোমান সাহেবের ছোট ভাই। চেহারা-ছবি, চোখের ভাবভঙ্গি, নোমান সাহেবের বিলকুল কার্বন কপি (বয়সটা অনেক কম, এই যা)।
মূল অনুষ্ঠান শুরুর একই সঙ্গে অধ্যাপক নোমান বক্তব্য দিলেন। বহু পুরোনো বিদগ্ধ ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কাছে একটি কিউট ইংরেজি বক্তব্যের আশায় বসে ছিলাম। ডায়াসে প্রায় ১০ জন সমাজের ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র এবং ওই দিনের মোটামুটি ডাকসাইটে গণ্যমান্য মানুষ। সুশীল সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিত্বও উজ্জ্বল করেছেন উপস্থিতি। আর সামনে কিচিরমিচির করছিল হাজার দুই বা তারও বেশি সে সময়কার কিশোর তারুণ্যের মাঝামাঝি ছাত্র। তাদের আলাপসালাপ যেন শেষ হচ্ছিল না।
অনুষ্ঠানে এসে দারুণ ভালো লাগছিল। স্মৃতি রোমন্থনে মন ভোরে যাচ্ছিল। তখনকার দিনের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের অপেক্ষমাণ ঘোড়ার গাড়ি, অশ্বমুত্রে পূত গন্ধে এলাকার পাশে সরু গলিগুলোর পাশে কয়েকটি বাড়ি নিয়ে ঢাকা কলেজ। বাঘাসব অধ্যাপক, প্রভাষক ওই সব ঘুপচি ঘরে পড়াতেন। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম, শিখতাম।
সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের শ্রীহীন ঢাকা কলেজ আজকে তার বিশাল অঙ্গন নিয়ে শ্রীযুক্তি হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা আরও বেড়েছে। পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক। এবং এসেছেন একজন অধ্যাপক নোমান। বলেছি মাঝারি সাইজের ঘনশ্যাম মানুষটি।
অধ্যাপক নোমান দাঁড়াতেই হাজার হাজার কিশোর ছাত্রের কিচিরমিচির আকস্মিকভাবে থেমে গেল।
অধ্যাপক নোমান অনেক কথা বলেছিলেন, সুন্দর-সুন্দর, ভালো কথা। আজ আমার তেমন কিছুই মনে নেই। মনে আছে দুটি জিনিস। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক হয়েও বাংলায় বক্তব্য দিলেন। আশা করেছিলাম তিনি সুন্দর ইংরেজিতে একটা বক্তব্য দেবেন।
বাংলায় বক্তব্যের একটা বিশেষ লাইন আমার স্মরণে এখনো গুনগুনিয়ে জাগে।
আমন্ত্রিত মহান অতিথিবৃন্দ, আমার প্রিয় ছাত্র ভায়েরা, আজকের এই বাসন্তী বিকেলে... ইত্যাদি।
ব্যস, ওই ‘বাসন্তী বিকেল’ শব্দটির কী জাদু ছিল, জানি না। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের মেমোরি সেলগুলোতে আটকে গেল। আমার কাছে এখনো স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল শব্দ দুটি।
স্যারের ছোট ভাই মোয়াত্তেরকে বললাম, নোমান স্যার ইংরেজিতে তুখোড় জানি, এত চমত্কার বাংলা বলেন, সত্যি জানতাম না।
পরে এই বরেণ্য শিক্ষাবিদের সঙ্গে আরও সাক্ষাত্ হয়েছে। আর জেনেছি তাঁর কথা। তদানীন্তন পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মানে ভূষিত, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবধানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্তিসহ অনেক পদকে ভূষিত। অধ্যাপক, অধ্যক্ষ থেকে সবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য—অনেক কিছু জেনেছি।
অধ্যাপনা করা যার ধ্যান, ছাত্রদের নিয়েই জগত্ যে মানুষটির...এতসব জেনেও আমার কাছে ‘বাসন্তী বিকেলের’ এ মানুষটি এখনো খুব কাছাকাছি হয়ে যান। সব মানুষের মতো এসব মানুষও চলে যান দুনিয়ার অমোঘ নিয়মে। কিন্তু তাঁরা যেন হারিয়ে না যান, এটাই হোক আমাদের ব্রত।
ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী: সাবেক রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক, মাঝারি সাইজের ঘনশ্যাম বর্ণের একটি মানুষ ভদ্রলোকের তীক্ষ অনুসন্ধিত্সু এক জোড়া চোখ প্রথমে আকৃষ্ট করেন অসাধারণ বলেই। হাত মিলিয়ে বললেন, ‘Welcome to the college, আপনার আলমা মাটার, আমি প্রিন্সিপাল। আমার নাম নোমান।’
আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা কলেজে পড়ুয়া অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের আপন ছোট ভাই মোয়াত্তের। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। মোয়াত্তেরকে দেখে একনজরে বোঝা যেত ও নোমান সাহেবের ছোট ভাই। চেহারা-ছবি, চোখের ভাবভঙ্গি, নোমান সাহেবের বিলকুল কার্বন কপি (বয়সটা অনেক কম, এই যা)।
মূল অনুষ্ঠান শুরুর একই সঙ্গে অধ্যাপক নোমান বক্তব্য দিলেন। বহু পুরোনো বিদগ্ধ ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কাছে একটি কিউট ইংরেজি বক্তব্যের আশায় বসে ছিলাম। ডায়াসে প্রায় ১০ জন সমাজের ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র এবং ওই দিনের মোটামুটি ডাকসাইটে গণ্যমান্য মানুষ। সুশীল সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিত্বও উজ্জ্বল করেছেন উপস্থিতি। আর সামনে কিচিরমিচির করছিল হাজার দুই বা তারও বেশি সে সময়কার কিশোর তারুণ্যের মাঝামাঝি ছাত্র। তাদের আলাপসালাপ যেন শেষ হচ্ছিল না।
অনুষ্ঠানে এসে দারুণ ভালো লাগছিল। স্মৃতি রোমন্থনে মন ভোরে যাচ্ছিল। তখনকার দিনের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের অপেক্ষমাণ ঘোড়ার গাড়ি, অশ্বমুত্রে পূত গন্ধে এলাকার পাশে সরু গলিগুলোর পাশে কয়েকটি বাড়ি নিয়ে ঢাকা কলেজ। বাঘাসব অধ্যাপক, প্রভাষক ওই সব ঘুপচি ঘরে পড়াতেন। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম, শিখতাম।
সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের শ্রীহীন ঢাকা কলেজ আজকে তার বিশাল অঙ্গন নিয়ে শ্রীযুক্তি হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা আরও বেড়েছে। পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক। এবং এসেছেন একজন অধ্যাপক নোমান। বলেছি মাঝারি সাইজের ঘনশ্যাম মানুষটি।
অধ্যাপক নোমান দাঁড়াতেই হাজার হাজার কিশোর ছাত্রের কিচিরমিচির আকস্মিকভাবে থেমে গেল।
অধ্যাপক নোমান অনেক কথা বলেছিলেন, সুন্দর-সুন্দর, ভালো কথা। আজ আমার তেমন কিছুই মনে নেই। মনে আছে দুটি জিনিস। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক হয়েও বাংলায় বক্তব্য দিলেন। আশা করেছিলাম তিনি সুন্দর ইংরেজিতে একটা বক্তব্য দেবেন।
বাংলায় বক্তব্যের একটা বিশেষ লাইন আমার স্মরণে এখনো গুনগুনিয়ে জাগে।
আমন্ত্রিত মহান অতিথিবৃন্দ, আমার প্রিয় ছাত্র ভায়েরা, আজকের এই বাসন্তী বিকেলে... ইত্যাদি।
ব্যস, ওই ‘বাসন্তী বিকেল’ শব্দটির কী জাদু ছিল, জানি না। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের মেমোরি সেলগুলোতে আটকে গেল। আমার কাছে এখনো স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল শব্দ দুটি।
স্যারের ছোট ভাই মোয়াত্তেরকে বললাম, নোমান স্যার ইংরেজিতে তুখোড় জানি, এত চমত্কার বাংলা বলেন, সত্যি জানতাম না।
পরে এই বরেণ্য শিক্ষাবিদের সঙ্গে আরও সাক্ষাত্ হয়েছে। আর জেনেছি তাঁর কথা। তদানীন্তন পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মানে ভূষিত, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবধানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্তিসহ অনেক পদকে ভূষিত। অধ্যাপক, অধ্যক্ষ থেকে সবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য—অনেক কিছু জেনেছি।
অধ্যাপনা করা যার ধ্যান, ছাত্রদের নিয়েই জগত্ যে মানুষটির...এতসব জেনেও আমার কাছে ‘বাসন্তী বিকেলের’ এ মানুষটি এখনো খুব কাছাকাছি হয়ে যান। সব মানুষের মতো এসব মানুষও চলে যান দুনিয়ার অমোঘ নিয়মে। কিন্তু তাঁরা যেন হারিয়ে না যান, এটাই হোক আমাদের ব্রত।
ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী: সাবেক রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
No comments