প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ -ভারত ও বাংলাদেশের শাশ্বত ও চিরস্থায়ী জাতীয় স্বার্থের অন্বেষণ by আকবর আলি খান
বিধাতাকে উদ্দেশ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে সে তব সাধ’। সত্যি সত্যি বিধাতার কোনো সাধই অপূর্ণ নেই। নিজের ইচ্ছামতো তিনি নানা বর্ণের, আকারের ও মতের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাঁর কার্পণ্য দেখা যায় বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে। তিনি মাত্র দুই ধরনের বাংলাদেশি বানিয়েছেন। এক ধরনের বাংলাদেশিরা হচ্ছেন ভারতবান্ধব। দোসরা কিসিমের বাংলাদেশিরা ভারতবিদ্বেষী। যাঁরা ভারতবান্ধব, তাঁরা বিশ্বাস করেন যে মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ও আমাদের আত্মার আত্মীয় ভারত বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
দ্বিতীয় ধরনের বাংলাদেশিরা ভারতবিদ্বেষী। এঁরা বিশ্বাস করেন, চাঁদের বুড়ি যেমন চব্বিশ ঘণ্টা চরকার সুতা কাটছে, তেমনি নয়াদিল্লিতে ভারত ভাগ্যবিধাতারা অষ্টপ্রহর বাংলাদেশের অনিষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ দুই কিসিমের বাংলাদেশি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের বাংলাদেশির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। খবরের কাগজে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক এ পুরোনো অনুমানকে নতুন করে সমর্থন করছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে বিতর্ক যত আলো জ্বেলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। খবরের কাগজে প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, এ উত্তাপ শুধু বাংলাদেশিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতীয় কূটনীতিবিদদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা নাকি বলেছেন যে টিপাইমুখ প্রকল্পের যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁরা ভারতের শত্রু আর যাঁরা সর্মথন করেন, তাঁরা ভারতের মিত্র।
এ বিতর্কে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্পর্ক কখনো ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের মতো হয় না। দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্ক আবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ সম্পর্ক গড়ে ওঠে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮৪৮ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে মৌলনীতি ঘোষণা করেছিলেন, তা আজও সমভাবে প্রযোজ¨: “We have no eternal allies and we have no perpetual enemies. Our interests are eternal and perpetual and those interests it is our duty to follow.” (আমাদের কোনো শাশ্বত মিত্র নেই, আমাদের কোনো চিরস্থায়ী শত্রুও নেই। আমাদের স্বার্থই হচ্ছে শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এসব স্বার্থ সংরক্ষণ করা)
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে একটি অর্থবহ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার সূত্রপাত করা। বাংলাদেশে এ ধরনের আলোচনার তিনটি অন্তরায় রয়েছে। প্রথমত, আবেগের উত্তাপে এ ধরনের আলোচনা মূল প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকে না, ভারত-বাংলাদেশ সামগ্রিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ প্রবন্ধে আলোচনা শুধু টিপাইমুখ বাঁধের বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ থাকবে। দ্বিতীয় অন্তরায় হলো উপাত্ত ও তথ্যের অপ্রতুলতা। এ প্রবন্ধ মূলত টিপাইমুখ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্তৃক দাখিলকৃত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment) প্রতিবেদন ও ভারতের পরিবেশ দপ্তর কর্তৃক জারীকৃত ছাড়পত্রের উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত। ইন্টারনেটে এসব প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমূহ ব্যবহূত হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ কর্তৃক সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছাড়া অনেক ব্যাপারেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, নদীর উজান (upper riparian) ও ভাটির (lower riparian) দেশগুলোর আইনগত অধিকার নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। হেলসিংকি চুক্তিতে পানির কল্যাণকর ব্যবহারের জন্য উজান ও ভাটির দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়সংগত অংশীদারির নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের নৌপথ ব্যতীত অন্য কাজে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ব্যবহার-সংক্রান্ত কনভেনশনে ন্যায়সংগত ও যুক্তিসংগতভাবে পানির সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য নয়। এসব আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে সব দেশই তাদের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে। এ প্রবন্ধে তাই আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে আলোচনা করা হবে না। এ বিষয়ে ভারতের প্রাক্তন সেচসচিব রামস্বামী আর আয়ার তাঁর ঞড়ধিত্ফং ডধঃবত্ ডরংফড়স গ্রন্থে একটি চমত্কার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “The upper riparian in exercising its power of control over water must avoid causing harm to or infringing the rights of the lower riparian and the lower riparian in asserting its rights over the waters must not be oblivious of the needs and interests of the upper riparian or seek to impose unreasonable restriction on legitimate activities.” “পানির ওপর তার নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে উজানের দেশ অবশ্যই ভাটির দেশের ক্ষতি করা অথবা তার অধিকার ক্ষুণ্ন করা পরিহার করবে। অন্যদিকে ভাটির দেশকে উজানের দেশের প্রয়োজন ও স্বার্থ বিস্মৃত হলে চলবে না এবং অবশ্যই উজান দেশের বৈধ কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করবে না” (পৃষ্ঠা-১১০)। এ প্রবন্ধে টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করা হবে। উভয়ের স্বার্থের আলোকে সমস্যাসমূহ বিশ্লেষণ করা হবে।
এ নিবন্ধ চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে টিপাইমুখ বাঁধের রূপরেখা বিশেষ করে ইতিহাস, লক্ষ্য ও ভৌত বিশেষত্বসমূহ আলোচনা করা হবে। দ্বিতীয় অংশে টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারতের সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের স্বার্থ আলোচিত হবে। তৃতীয় অংশে এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিশ্লেষণ করা হবে। সবশেষে এ সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার কৌশল ও আলোচনার মূল বিষয় চিহ্নিত করা হবে।
টিপাইমুখ বাঁধ: প্রকল্পের রূপরেখা
টিপাইমুখ ভারতের মণিপুর রাজ্যের মিজোরাম সীমান্তের কাছে একটি অখ্যাত জনপদ। এটি চূড়াচন্দর জেলার একটি উপজাতীয় ব্লক। এ অঞ্চলে প্রায় ২৪ হাজার উপজাতি বাস করে। দুর্গম এ পাহাড়ি অঞ্চলে সরকার প্রায় অনুপস্থিত, নেই কোনো বিদ্যালয় বা চিকিত্সাকেন্দ্র। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অবহেলিত হলেও বরাক নদীর জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে টিপাইমুখের গুরুত্ব অপরিসীম।
বরাক নদী মেঘনার আদি পর্যায়। শারদ কে জৈন, পুষ্পানন্দ কে আগরওয়াল ও বিজয় পি সিংহ রচিত Hydrology and Water Resources of India গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে এর উত্পত্তি হলো মণিপুরের জাপভো পর্বতশৃঙ্গে। তবে বরাক বরফপুষ্ট নদী নয়। বরাক হচ্ছে বৃষ্টিপুষ্ট (rain-fed) নদী। এর উেস রয়েছে অনেক পাহাড়ি ছড়া, যাদের মধ্যে গোমতী, হাওড়া, কাগনি, সেনাই বুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকরাই, কুরুলিয়া, বালিঝুড়ি, সোনাইছড়ি এবং দরদরিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উত্পত্তিস্থল থেকে টিপাইমুখ পর্যন্ত বরাক নদী পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। টিপাইমুখের পর নদীটি সমতল ভূমিতে নেমে আসে। টিপাইমুখে বরাকের সঙ্গে মিলিত হয় টুইভাই (Tuivai) নদী। টিপাই শব্দটি টিইভাইয়ের অপভ্রংশ। টুইভাই নদীর মুখ হলো টিপাইমুখ। টিপাইমুখে বরাক নদীর ডান তীরে মণিপুর রাজ্য, বাম তীরে মিজোরাম রাজ্য। এখান থেকে নদীটি আসামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উত্স থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত বরাক নদীর দৈর্ঘ্য ৫৬৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্তে নদীটি সুরমা ও কুশিয়ারা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে সুরমা ও কুশিয়ারা পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয় মেঘনা নদী। মেঘনা শব্দের উত্পত্তি মেঘ ও নাদ শব্দ দুটি থেকে। নাদ শব্দের অর্থ গর্জন। মেঘের গর্জনে যে নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সে নদীই হলো মেঘনা। এ নদীর আকার তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষণের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯২৯ সালে, যখন কাছাড় উপত্যকায় প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয়। প্রস্তাব করা হয়, টিপাইমুখে জলাধার নির্মাণ করে বন্যার সময় পানির প্রবাহ কমানো হবে। ১৯৫৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন টিপাইমুখে একটি বহুমুখী প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে টিপাইমুখকে একটি বাঁধের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮২ সালে ভারত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেয়, তাতে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল (দেখুন B M Abbas প্রণীত The Ganges Waters Dispute)
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মপুত্র বোর্ড এ সম্পর্কে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে টিপাইমুখে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় North Eastern Electric Power Company (NEEPCO) বা নিপকোকে। নিপকো ২০০৬ সালে পরিবেশ সম্পর্কে অনাপত্তি সার্টিফিকেটের (Environmental Clearance Certificate) জন্য ভারতের পরিবেশ দপ্তরের কাছে আবেদন করে। এ আবেদনে প্রকল্পটির নিম্নরূপ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে:
“The Project envisages construction of a 162.8m high rockfill dam, which will intersect a catchments area of 12,756 Sq. Km.” (প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো ১৬২.৮ মিটার উঁচু পাথর দিয়ে ভর্তি বাঁধ, যা ১২৭৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের অববাহিকার বৃষ্টির পানি আটকাবে)। এর সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এ বাঁধের ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ৪৫.৭০ কোটি রুপির সাশ্রয় হবে। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে ২৩১ কোটি রুপির ফসল উত্পাদন বাড়বে ও বাঁধ এলাকায় মাছ চাষ করে বছরে ১৪ কোটি রুপির মুনাফা হবে। অবশ্য বাঁধের জন্য ক্ষতিও হবে। ২৯৬.৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এ ছাড়া নৌচলাচলের সুবিধা হবে এবং বাঁধ এলাকায় পর্যটনের সুবিধা সম্প্রসারিত হবে।
এখন বাঁধটির মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, এটি একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুত্ প্রকল্প। সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার এ প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ বাংলাদেশে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহারের সম্ভাবনা সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। যখনই টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্ন উঠেছে, তখনই ভারত দাবি করছে যে এটি সেচ প্রকল্প নয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে যৌথ সমীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীকালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৫তম ও ৩৬তম সভায় টিপাইমুখ প্রশ্ন বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত হলে ভারত জানায় যে টিপাইমুখ থেকে পানি প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই এবং বাংলাদেশের এ সম্পর্কে তথ্যের কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন যে পানি প্রত্যাহার না করার ভারতীয় প্রতিশ্রুতি একটি ধাপ্পা। বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, একসময় টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ বাঁধের নিচে ফুলেরতল জলাধার নির্মাণের কথা ভারত বলেছিল। ফুলেরতল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভারত এখন কিছু বলছে না। এ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে কি না এবং বাদ দিলে কেন দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। তাই অনেকে ভয় করেছেন, টিপাইমুখ বাঁধের পর ফুলেরতল বাঁধ শুরু হবে। দ্বিতীয়ত, ভারত গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রস্তাবে টিপাইমুখ থেকে পানি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। তবে দুটি কারণে এসব সন্দেহ অমূলক মনে হয়। প্রথমত, এ ধরনের কোনো প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত পরিবেশগত ছাড়পত্রের আবেদন করা হয়নি। আপাতত, এ ধরনের সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পরবর্তীকালেও এখানে নতুন বৃহত্ সেচ প্রকল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যে কাছাড় অঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ১১ আগস্ট ২০০৯ তারিখে আসামের সেচমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে টিপাইমুখ বাঁধের নিম্নাঞ্চলে ভারত ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উপরন্তু আসামে ইতিমধ্যে অগভীর নলকূপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ও অগভীর নলকূপের মতো সস্তা সেচের পরিবর্তে ব্যয়বহুল ফুলেরতল বাঁধ নির্মাণ অর্থনৈতিক দিক থেকে আকর্ষণীয় মনে হয় না। উপরন্তু টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর এ অঞ্চলে অতি সস্তায় নলকূপের জন্য বিদ্যুত্ সরবরাহ সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির দ্বিতীয় বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিক মানে একটি মুখ্য বা major বাঁধ। ১৫ থেকে ২০ মিটারের উঁচু বাঁধকে বৃহত্ (large) বাঁধ বলা হয় আর ১৫০ থেকে ২৫০ মিটার উচ্চতার বাঁধকে মুখ্য বা major বাঁধ বলা হয়ে থাকে। বাঁধের উচ্চতার দিক থেকে ভারতে টিপাইমুখের স্থান সপ্তম। কিছু উদাহরণ দিলে জলবিদ্যুত্ প্রকল্পটির প্রকৃতি বোঝা যাবে। টিপাইমুখ বাঁধের সর্বোচ্চ জলবিদ্যুত্ ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশে কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। অর্থাত্ টিপাইমুখের সর্বোচ্চ জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা কাপ্তাইয়ের সাড়ে ছয় গুণ। কাপ্তাই বাঁধের উচ্চতা ৪৫.৭ মিটার আর টিপাইমুখের উচ্চতা ১৬২.৮ মিটার, যা কাপ্তাইয়ের সাড়ে ছয় গুণ। কাপ্তাই হ্রদ ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত করেছে, অথচ টিপাইমুখে প্লাবিত হবে ২৯৬.৫ বর্গকিলোমিটার। অর্থাত্ টিপাইমুখে কাপ্তাইয়ের হ্রদের ৩৮ শতাংশ আয়তনের জলাধার থেকে সাড়ে তিন গুণ বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে। টিপাইমুখ জলাধার হবে অত্যন্ত গভীর। টিপাইমুখ বাঁধের বিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা যেমন বেশি প্রলয়ঙ্করী ঝুঁকিও কাপ্তাইয়ের তুলনায় অনেক বেশি। পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধের মতো উঁচু বিপজ্জনক বাঁধ নির্মিত হয়নি। পাকিস্তানে তারবেলা বাঁধের উচ্চতা হলো ১৩৮ মিটার, মংলা বাঁধের উচ্চতা হলো ১৪৩.২৬ মিটার আর টিপাইমুখের উচ্চতা হলো ১৬২.৮ মিটার। টিপাইমুখ বাঁধের দৈর্ঘ্য হলো ৩৯০ মিটার। উচ্চতা আর দৈর্ঘ্যের অনুপাত হলো ১:২.৩৯। কাপ্তাইয়ের ক্ষেত্রে এ অনুপাত হলো ১:৪৪.৬৬, তারবেলার ক্ষেত্রে এ অনুপাত ১:১৯.৭, মংলার ক্ষেত্রে ১:২২.৭৩। টিপাইমুখে একটি বিশাল জলরাশি একটি সংকীর্ণ গিরিবর্তে ধরে রাখা হবে। কোনো কারণে এ বাঁধ ভাঙলে ক্ষতি হবে অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয়।
তৃতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের জল নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্য কোনো কাঠামোগত ব্যবস্থার প্রস্তাব পরিবেশ দপ্তরের দলিলে দেখা যাচ্ছে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা ২০৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পাওয়া যাবে। কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার মোট আয়তন ৭৯২২ বর্গকিলোমিটার অর্থাত্ টিপাইমুখ প্রকল্পের ফলে এ তিনটি জেলার প্রায় ২৫.৭ শতাংশ অংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা সৃষ্টি হবে। কাজেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের গুরুত্ব গৌণ। মূলত এটি জলবিদ্যুত্ প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় হচ্ছে ৬৯৭৯.৪৪ কোটি ভারতীয় রুপি। মার্কিন ডলারে এর পরিমাণ ১৪২০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৮৬৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি সমাপ্ত হতে সাত বছর লাগবে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। তবে দরপত্র এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
আগামী কাল: ভারতে সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের স্বার্থ
আকবর আলি খান: গবেষক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অর্থ, বন ও পরিবেশ এবং মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বিতীয় ধরনের বাংলাদেশিরা ভারতবিদ্বেষী। এঁরা বিশ্বাস করেন, চাঁদের বুড়ি যেমন চব্বিশ ঘণ্টা চরকার সুতা কাটছে, তেমনি নয়াদিল্লিতে ভারত ভাগ্যবিধাতারা অষ্টপ্রহর বাংলাদেশের অনিষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ দুই কিসিমের বাংলাদেশি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের বাংলাদেশির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। খবরের কাগজে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক এ পুরোনো অনুমানকে নতুন করে সমর্থন করছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে বিতর্ক যত আলো জ্বেলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। খবরের কাগজে প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, এ উত্তাপ শুধু বাংলাদেশিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতীয় কূটনীতিবিদদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা নাকি বলেছেন যে টিপাইমুখ প্রকল্পের যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁরা ভারতের শত্রু আর যাঁরা সর্মথন করেন, তাঁরা ভারতের মিত্র।
এ বিতর্কে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্পর্ক কখনো ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের মতো হয় না। দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্ক আবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ সম্পর্ক গড়ে ওঠে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮৪৮ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে মৌলনীতি ঘোষণা করেছিলেন, তা আজও সমভাবে প্রযোজ¨: “We have no eternal allies and we have no perpetual enemies. Our interests are eternal and perpetual and those interests it is our duty to follow.” (আমাদের কোনো শাশ্বত মিত্র নেই, আমাদের কোনো চিরস্থায়ী শত্রুও নেই। আমাদের স্বার্থই হচ্ছে শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এসব স্বার্থ সংরক্ষণ করা)
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে একটি অর্থবহ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার সূত্রপাত করা। বাংলাদেশে এ ধরনের আলোচনার তিনটি অন্তরায় রয়েছে। প্রথমত, আবেগের উত্তাপে এ ধরনের আলোচনা মূল প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকে না, ভারত-বাংলাদেশ সামগ্রিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ প্রবন্ধে আলোচনা শুধু টিপাইমুখ বাঁধের বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ থাকবে। দ্বিতীয় অন্তরায় হলো উপাত্ত ও তথ্যের অপ্রতুলতা। এ প্রবন্ধ মূলত টিপাইমুখ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্তৃক দাখিলকৃত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment) প্রতিবেদন ও ভারতের পরিবেশ দপ্তর কর্তৃক জারীকৃত ছাড়পত্রের উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত। ইন্টারনেটে এসব প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমূহ ব্যবহূত হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ কর্তৃক সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছাড়া অনেক ব্যাপারেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, নদীর উজান (upper riparian) ও ভাটির (lower riparian) দেশগুলোর আইনগত অধিকার নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। হেলসিংকি চুক্তিতে পানির কল্যাণকর ব্যবহারের জন্য উজান ও ভাটির দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়সংগত অংশীদারির নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের নৌপথ ব্যতীত অন্য কাজে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ব্যবহার-সংক্রান্ত কনভেনশনে ন্যায়সংগত ও যুক্তিসংগতভাবে পানির সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য নয়। এসব আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে সব দেশই তাদের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে। এ প্রবন্ধে তাই আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে আলোচনা করা হবে না। এ বিষয়ে ভারতের প্রাক্তন সেচসচিব রামস্বামী আর আয়ার তাঁর ঞড়ধিত্ফং ডধঃবত্ ডরংফড়স গ্রন্থে একটি চমত্কার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “The upper riparian in exercising its power of control over water must avoid causing harm to or infringing the rights of the lower riparian and the lower riparian in asserting its rights over the waters must not be oblivious of the needs and interests of the upper riparian or seek to impose unreasonable restriction on legitimate activities.” “পানির ওপর তার নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে উজানের দেশ অবশ্যই ভাটির দেশের ক্ষতি করা অথবা তার অধিকার ক্ষুণ্ন করা পরিহার করবে। অন্যদিকে ভাটির দেশকে উজানের দেশের প্রয়োজন ও স্বার্থ বিস্মৃত হলে চলবে না এবং অবশ্যই উজান দেশের বৈধ কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করবে না” (পৃষ্ঠা-১১০)। এ প্রবন্ধে টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করা হবে। উভয়ের স্বার্থের আলোকে সমস্যাসমূহ বিশ্লেষণ করা হবে।
এ নিবন্ধ চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে টিপাইমুখ বাঁধের রূপরেখা বিশেষ করে ইতিহাস, লক্ষ্য ও ভৌত বিশেষত্বসমূহ আলোচনা করা হবে। দ্বিতীয় অংশে টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারতের সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের স্বার্থ আলোচিত হবে। তৃতীয় অংশে এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিশ্লেষণ করা হবে। সবশেষে এ সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার কৌশল ও আলোচনার মূল বিষয় চিহ্নিত করা হবে।
টিপাইমুখ বাঁধ: প্রকল্পের রূপরেখা
টিপাইমুখ ভারতের মণিপুর রাজ্যের মিজোরাম সীমান্তের কাছে একটি অখ্যাত জনপদ। এটি চূড়াচন্দর জেলার একটি উপজাতীয় ব্লক। এ অঞ্চলে প্রায় ২৪ হাজার উপজাতি বাস করে। দুর্গম এ পাহাড়ি অঞ্চলে সরকার প্রায় অনুপস্থিত, নেই কোনো বিদ্যালয় বা চিকিত্সাকেন্দ্র। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অবহেলিত হলেও বরাক নদীর জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে টিপাইমুখের গুরুত্ব অপরিসীম।
বরাক নদী মেঘনার আদি পর্যায়। শারদ কে জৈন, পুষ্পানন্দ কে আগরওয়াল ও বিজয় পি সিংহ রচিত Hydrology and Water Resources of India গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে এর উত্পত্তি হলো মণিপুরের জাপভো পর্বতশৃঙ্গে। তবে বরাক বরফপুষ্ট নদী নয়। বরাক হচ্ছে বৃষ্টিপুষ্ট (rain-fed) নদী। এর উেস রয়েছে অনেক পাহাড়ি ছড়া, যাদের মধ্যে গোমতী, হাওড়া, কাগনি, সেনাই বুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকরাই, কুরুলিয়া, বালিঝুড়ি, সোনাইছড়ি এবং দরদরিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উত্পত্তিস্থল থেকে টিপাইমুখ পর্যন্ত বরাক নদী পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। টিপাইমুখের পর নদীটি সমতল ভূমিতে নেমে আসে। টিপাইমুখে বরাকের সঙ্গে মিলিত হয় টুইভাই (Tuivai) নদী। টিপাই শব্দটি টিইভাইয়ের অপভ্রংশ। টুইভাই নদীর মুখ হলো টিপাইমুখ। টিপাইমুখে বরাক নদীর ডান তীরে মণিপুর রাজ্য, বাম তীরে মিজোরাম রাজ্য। এখান থেকে নদীটি আসামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উত্স থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত বরাক নদীর দৈর্ঘ্য ৫৬৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্তে নদীটি সুরমা ও কুশিয়ারা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে সুরমা ও কুশিয়ারা পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয় মেঘনা নদী। মেঘনা শব্দের উত্পত্তি মেঘ ও নাদ শব্দ দুটি থেকে। নাদ শব্দের অর্থ গর্জন। মেঘের গর্জনে যে নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সে নদীই হলো মেঘনা। এ নদীর আকার তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষণের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯২৯ সালে, যখন কাছাড় উপত্যকায় প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয়। প্রস্তাব করা হয়, টিপাইমুখে জলাধার নির্মাণ করে বন্যার সময় পানির প্রবাহ কমানো হবে। ১৯৫৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন টিপাইমুখে একটি বহুমুখী প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে টিপাইমুখকে একটি বাঁধের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮২ সালে ভারত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেয়, তাতে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল (দেখুন B M Abbas প্রণীত The Ganges Waters Dispute)
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মপুত্র বোর্ড এ সম্পর্কে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে টিপাইমুখে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় North Eastern Electric Power Company (NEEPCO) বা নিপকোকে। নিপকো ২০০৬ সালে পরিবেশ সম্পর্কে অনাপত্তি সার্টিফিকেটের (Environmental Clearance Certificate) জন্য ভারতের পরিবেশ দপ্তরের কাছে আবেদন করে। এ আবেদনে প্রকল্পটির নিম্নরূপ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে:
“The Project envisages construction of a 162.8m high rockfill dam, which will intersect a catchments area of 12,756 Sq. Km.” (প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো ১৬২.৮ মিটার উঁচু পাথর দিয়ে ভর্তি বাঁধ, যা ১২৭৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের অববাহিকার বৃষ্টির পানি আটকাবে)। এর সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এ বাঁধের ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ৪৫.৭০ কোটি রুপির সাশ্রয় হবে। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে ২৩১ কোটি রুপির ফসল উত্পাদন বাড়বে ও বাঁধ এলাকায় মাছ চাষ করে বছরে ১৪ কোটি রুপির মুনাফা হবে। অবশ্য বাঁধের জন্য ক্ষতিও হবে। ২৯৬.৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এ ছাড়া নৌচলাচলের সুবিধা হবে এবং বাঁধ এলাকায় পর্যটনের সুবিধা সম্প্রসারিত হবে।
এখন বাঁধটির মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, এটি একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুত্ প্রকল্প। সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার এ প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ বাংলাদেশে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহারের সম্ভাবনা সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। যখনই টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্ন উঠেছে, তখনই ভারত দাবি করছে যে এটি সেচ প্রকল্প নয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে যৌথ সমীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীকালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৫তম ও ৩৬তম সভায় টিপাইমুখ প্রশ্ন বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত হলে ভারত জানায় যে টিপাইমুখ থেকে পানি প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই এবং বাংলাদেশের এ সম্পর্কে তথ্যের কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন যে পানি প্রত্যাহার না করার ভারতীয় প্রতিশ্রুতি একটি ধাপ্পা। বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, একসময় টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ বাঁধের নিচে ফুলেরতল জলাধার নির্মাণের কথা ভারত বলেছিল। ফুলেরতল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভারত এখন কিছু বলছে না। এ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে কি না এবং বাদ দিলে কেন দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। তাই অনেকে ভয় করেছেন, টিপাইমুখ বাঁধের পর ফুলেরতল বাঁধ শুরু হবে। দ্বিতীয়ত, ভারত গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রস্তাবে টিপাইমুখ থেকে পানি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। তবে দুটি কারণে এসব সন্দেহ অমূলক মনে হয়। প্রথমত, এ ধরনের কোনো প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত পরিবেশগত ছাড়পত্রের আবেদন করা হয়নি। আপাতত, এ ধরনের সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পরবর্তীকালেও এখানে নতুন বৃহত্ সেচ প্রকল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যে কাছাড় অঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ১১ আগস্ট ২০০৯ তারিখে আসামের সেচমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে টিপাইমুখ বাঁধের নিম্নাঞ্চলে ভারত ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উপরন্তু আসামে ইতিমধ্যে অগভীর নলকূপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ও অগভীর নলকূপের মতো সস্তা সেচের পরিবর্তে ব্যয়বহুল ফুলেরতল বাঁধ নির্মাণ অর্থনৈতিক দিক থেকে আকর্ষণীয় মনে হয় না। উপরন্তু টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর এ অঞ্চলে অতি সস্তায় নলকূপের জন্য বিদ্যুত্ সরবরাহ সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির দ্বিতীয় বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিক মানে একটি মুখ্য বা major বাঁধ। ১৫ থেকে ২০ মিটারের উঁচু বাঁধকে বৃহত্ (large) বাঁধ বলা হয় আর ১৫০ থেকে ২৫০ মিটার উচ্চতার বাঁধকে মুখ্য বা major বাঁধ বলা হয়ে থাকে। বাঁধের উচ্চতার দিক থেকে ভারতে টিপাইমুখের স্থান সপ্তম। কিছু উদাহরণ দিলে জলবিদ্যুত্ প্রকল্পটির প্রকৃতি বোঝা যাবে। টিপাইমুখ বাঁধের সর্বোচ্চ জলবিদ্যুত্ ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশে কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। অর্থাত্ টিপাইমুখের সর্বোচ্চ জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা কাপ্তাইয়ের সাড়ে ছয় গুণ। কাপ্তাই বাঁধের উচ্চতা ৪৫.৭ মিটার আর টিপাইমুখের উচ্চতা ১৬২.৮ মিটার, যা কাপ্তাইয়ের সাড়ে ছয় গুণ। কাপ্তাই হ্রদ ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত করেছে, অথচ টিপাইমুখে প্লাবিত হবে ২৯৬.৫ বর্গকিলোমিটার। অর্থাত্ টিপাইমুখে কাপ্তাইয়ের হ্রদের ৩৮ শতাংশ আয়তনের জলাধার থেকে সাড়ে তিন গুণ বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে। টিপাইমুখ জলাধার হবে অত্যন্ত গভীর। টিপাইমুখ বাঁধের বিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা যেমন বেশি প্রলয়ঙ্করী ঝুঁকিও কাপ্তাইয়ের তুলনায় অনেক বেশি। পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধের মতো উঁচু বিপজ্জনক বাঁধ নির্মিত হয়নি। পাকিস্তানে তারবেলা বাঁধের উচ্চতা হলো ১৩৮ মিটার, মংলা বাঁধের উচ্চতা হলো ১৪৩.২৬ মিটার আর টিপাইমুখের উচ্চতা হলো ১৬২.৮ মিটার। টিপাইমুখ বাঁধের দৈর্ঘ্য হলো ৩৯০ মিটার। উচ্চতা আর দৈর্ঘ্যের অনুপাত হলো ১:২.৩৯। কাপ্তাইয়ের ক্ষেত্রে এ অনুপাত হলো ১:৪৪.৬৬, তারবেলার ক্ষেত্রে এ অনুপাত ১:১৯.৭, মংলার ক্ষেত্রে ১:২২.৭৩। টিপাইমুখে একটি বিশাল জলরাশি একটি সংকীর্ণ গিরিবর্তে ধরে রাখা হবে। কোনো কারণে এ বাঁধ ভাঙলে ক্ষতি হবে অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয়।
তৃতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের জল নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্য কোনো কাঠামোগত ব্যবস্থার প্রস্তাব পরিবেশ দপ্তরের দলিলে দেখা যাচ্ছে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা ২০৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পাওয়া যাবে। কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার মোট আয়তন ৭৯২২ বর্গকিলোমিটার অর্থাত্ টিপাইমুখ প্রকল্পের ফলে এ তিনটি জেলার প্রায় ২৫.৭ শতাংশ অংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা সৃষ্টি হবে। কাজেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের গুরুত্ব গৌণ। মূলত এটি জলবিদ্যুত্ প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় হচ্ছে ৬৯৭৯.৪৪ কোটি ভারতীয় রুপি। মার্কিন ডলারে এর পরিমাণ ১৪২০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৮৬৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি সমাপ্ত হতে সাত বছর লাগবে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। তবে দরপত্র এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
আগামী কাল: ভারতে সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের স্বার্থ
আকবর আলি খান: গবেষক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অর্থ, বন ও পরিবেশ এবং মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
No comments