বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা ইউরোপীয় সংসদের
বাংলাদেশের
মানবাধিকার পরিস্থিতি ও চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বৃহস্পতিবার শুনানি
অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সংসদ হিসেবে পরিচিতি ইউরোপিয়ান
পার্লামেন্টের মানবাধিকার সাব-কমিটিতে। শুনানিতে অংশ নিয়ে সম্প্রতি
বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ইইউ সংসদ সদস্য ইওসেফ ভাইডেনহলৎসার বলেছেন,
বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত,
পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে তা নেতিবাচক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সন্তোষজনক নয়।
উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি তা গৃহযুদ্ধে গড়াতে
পারে। বাংলাদেশ সফরে ইইউ প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণ সংক্ষেপে তুলে ধরেন
তিনি। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত এ শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন
মানবাধিকার সাব কমিটির চেয়ার এলেনা ভ্যালেন্সিয়ানো। এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে
আরো বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশে আসা ইইউ প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য ক্যারোল
কারস্কি ও ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস (ইইএএস)-এর পক্ষ থেকে
টমাস নিকলসন। ইওসেফ তার বক্তব্যে বলেন, ৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ জুড়ে
সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬০ জনের বেশি মারা গেছে। বিরোধী দলের ৭-১০ হাজার
কর্মী গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ। তারা নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু সরকারের দাবি তারা বৈধভাবে নির্বাচিত। কাজেই এ সংঘাত, এ দ্বন্দ্ব
সমাধান করাটা কঠিন। উভয় পক্ষ তাদের অবস্থানে অনড়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের
সাথে আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব যুক্তিতর্ক তাদের পক্ষ থেকে
প্রদর্শন করা হয়েছে তা হলো- বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা হিসেবে অতীত
ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন করা। সত্যি কথা বলতে আমরা সমঝোতার কোনো সুযোগ দেখিনি।
প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে অটল। ইওসেফ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আমরা
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে
কথা বলেছি। ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায় সহ অন্যদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সাধারণভাবে বলতে গেলে সবার
বক্তব্য হলো- সামনের সপ্তাহগুলোতে তেমন কিছু পরিবর্তন হবে না। আর সেকারণে
উত্তেজনা বাড়তে পারে। এমনকি তা গৃহযুদ্ধে গড়াতে পারে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত
হলো- যেটাই হোক না কেন, যে দিকেই যাক না কেন- পরিস্থিতি যদি এমন হয়ে যায়
যেখানে বিরোধী দলকে স্রেফ কোণঠাসা করে দেয়া হয়েছে, তাদের আর কোনো
সম্পৃক্ততা নেই- যদি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে আমি মনে করি যেটা হবে
তা হলো- অন্য শক্তিগুলো সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে
সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গ আসতে পারে। সেটা একটা বড় ধরনের ঝুঁকি। সামনের
মাসগুলোতে বড় শঙ্কা রয়েছে। চরমপন্থী দলগুলোর উত্থান হতে পারে। আর এ ধরনের
দলগুলো কারও সঙ্গে সহযোগিতা চায় না। এটা সত্যিই উদ্বেগের একটি বিষয়। আর এ
কারণে দেশটির সঙ্গে আরও বেশি কাজ করা প্রয়োজন। ইওসেফ আরো বলেন, গতকাল আমরা
জেনেছি যে, বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি
পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এটা পরিস্থিতি
উসকে দেবে। বিরোধী দলের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলে তা পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে
উসকে দেবে বলে আমার আশঙ্কা। দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।
তবে আমি মনে করি তাকে গ্রেপ্তার করা হলে, তা খুবই সমস্যা সৃষ্টি করবে। তিনি
বলেন, বাংলাদেশ সফরে আমরা মোট ২৩টি বৈঠক করেছি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের
সঙ্গে। তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে আমরা ঢাকার বাইরে যেতে পারিনি।
নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এগুলো
আমাদের এজেন্ডা ছিল। আমরা লক্ষ্য করেছি গণমাধ্যমের ব্যাপ্তি দারুণ
প্রাণবন্ত। অনেক স্টেকহোল্ডার, অনেক আগ্রহী পার্টি রয়েছে। তবে, এও ইঙ্গিত
মিলেছে যে, মুক্ত মতামত প্রকাশ করাটা ততটা সহজ নয়। খুব বেশি সহজ সরল নয়।
কাজেই গণমাধ্যম স্বাধীনতা পরিস্থিতির ওপর আমাদের নজর রাখা প্রয়োজন, কেননা
পরিস্থিতি সার্বিকভাবে সন্তোষজনক নয়। তিনি বলেন, বৈদেশিক অনুদান আইনের
বিষয়টার ওপরও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এনজিওতে এ ধরনের অনুদানের ক্ষেত্রে
সরকার আরও কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। আমাদের বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার অংশ হিসেবে এসব নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। এ ছাড়া,
মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে কথা হয়েছে যা নিয়ে আমরা বারবার কথা বলেছি। আমরা
বলেছি, ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ বিষয়ে আমরা
নিঃসন্দেহে নিবিড় নজর রাখবো। আমরা নিশ্চিতভাবে মৃত্যুদণ্ড বিধানের বিরুদ্ধে
কথা বলবো। তিনি বলেন, এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও তদন্তের ইস্যুগুলো
রয়েছে। নারী অধিকার, শিশু অধিকার, বাল্যবিবাহ ইস্যুগুলো নিয়ে কথা হয়েছে।
তবে নারী অধিকারের বিষয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সংখ্যালঘু এবং
সংখ্যালঘু আদিবাসী প্রসঙ্গ আমরা উত্থাপন করেছি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর
বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতটুকু উন্নতি হয়েছে তা
খতিয়ে দেখাটা বাংলাদেশ সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল। অ্যাকর্ডের
অধীনে শ্রমিকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে তিনি
শুনানিতে জানান। সংসদ সংসদ ক্যারল কারস্কি বলেন, ইওসেফের বিস্তারিত
রিপোর্টের পর তেমন কিছু যোগ করার নেই। শ্রমিক অধিকার প্রসঙ্গটি তাদের কাছে
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত
কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে কিছু উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, গতিধারা ইতিবাচক।
ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস (ইইএএস) এর টমাস নিকলসন বলেন,
বাংলাদেশে সফরকারী প্রতিনিধি দলের মতো আমরাও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক
ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন। নির্বিচার সহিংসতা, রাজনৈতিক নেতাদের
গণগ্রেপ্তার আর সংলাপের দিকে যেতে প্রধান দুই দলের মধ্যে আপাত অনাগ্রহ ও
জটিলতার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এগুলো সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। তিনি
বলেন, আমরা আজকের আলোচনায় এও শুনেছি, অনেকগুলো ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আমাদের
বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। আমাদের অনেকগুলো অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।
আমাদের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক ভালো। উন্নয়ন কতিপয় বিষয়ে বাংলাদেশকে
রোল-মডেল বলা হয়েছে। আমাদের অভিন্ন নিরাপত্তা এবং জলবায়ু উদ্বেগ রয়েছে। এসব
কারণে আমরা পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সফরকে স্বাগত জানাই। আমরা
মনে করি বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি
জানান, এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের একটি প্রতিনিধিদল এ সপ্তাহে
বাংলাদেশে রয়েছে। এ দলটি কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শাসন, মানবাধিকার ,
অভিবাসন, উন্নয়ন ও বাণিজ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করবে। অভিন্ন স্বার্থগুলোর
প্রতি নজর রাখার জন্য লেগে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে যথাযথ উদ্বেগের
পরিস্থিতিতে এটা উদ্বেগ জানানোর আহ্বান জানায়। শুনানিতে পূর্বনির্ধারিত অপর
প্রসঙ্গগুলোতে যাওয়ার আগে কমিটির চেয়ার এলেনা ভ্যালেন্সিয়ানো বাংলাদেশে
সফরকারী ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রত্যেক সদস্যকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আরো
বলেন, আমি মনে করি সামনের মাসগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ
অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
No comments