অভিজিৎ হত্যায় কেবল শোক নয়, আমাদের সম্মিলিত ক্রোধ জাগ্রত হোক by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
কী
লিখব? দিনসাতেকের জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। ১৮ ফেব্রুয়ারি জেদ্দায়
পেঁৗছেছি। মক্কা ও মদিনা হয়ে ২৬ তারিখে লন্ডনে ফিরেছি। সকালে ফিরে এসেছি।
সন্ধ্যাবেলাতেই খবর পেয়েছি, অধ্যাপক অজয় রায়ের তরুণ পুত্র অভিজিৎ রায় ও তার
স্ত্রীকে ঢাকায় টিএসসির মোড়ে জঙ্গিরা নির্মমভাবে কুপিয়েছে এবং তার ফলে
অভিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। তার স্ত্রী হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই
করছেন। একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা, অন্যদিকে
ধর্মের নামে এভাবে অসাম্প্রদায়িক, মেধাবী তরুণ বুদ্ধিজীবী ও সেক্যুলার
ব্লগার এবং লেখকদের কুপিয়ে হত্যা করা। দেশটা কি তাহলে ইরাকের কয়েকটি এলাকার
মতো আইএসএসের রাজত্ব হয়ে গেল?
ইচ্ছা ছিল লন্ডনে ফিরে এসে জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় সাত দিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখব। লেখার বিষয় ছিল বিস্তর। জেদ্দায় বাংলাদেশিদের পরিচালনাধীন দুটি আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি ও বাংলামাধ্যমের স্কুল ও কলেজ আছে। তাদের আমন্ত্রণে এবং জেদ্দায় নিযুক্ত আমাদের কনসাল জেনারেল শহিদুল করিম ও তার স্ত্রীর সৌজন্যে আমার এই সৌদি আরব ভ্রমণ। একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় একই দিনে জেদ্দায় একুশের তিনটি অনুষ্ঠানে আমাকে অংশ নিতে হয়েছে। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তাদের সুখ-দুঃখ সমস্যার কথা জেনেছি। ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই লিখব। কিন্তু জেদ্দা থেকে লন্ডনে ফিরে আসতেই অভিজিৎ রায়ের ওপর এ পৈশাচিক হামলা এবং তার মৃত্যুর খবর! ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৌদি ভ্রমণকথা আপাতত স্থগিত রইল। লেখার বিষয়বস্তু পাল্টাতে হলো।
অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নির্মম, কিন্তু নতুন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। কয়েক বছর আগে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একই ধরনের হত্যা প্রচেষ্টা (পরিণতিতে মৃত্যু) আমরা দেখেছি। তারপর এই সেদিন বর্তমান আওয়ামী লীগ শামনামলেই আমরা দেখেছি, রাজীবসহ একাধিক তরুণ এবং সেক্যুলার ব্লগারকে এই পৈশাচসিদ্ধ জঙ্গিদের হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ। হুমায়ুন আজাদের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উস্কানিদাতারা তখন চিহ্নিত হয়েও সাজা পায়নি। বর্তমান সময়ে সেক্যুলার ব্লগারদের হত্যার নায়করাও তেমন শাস্তি পায়নি; শাস্তি পেয়েছে একাধিক ব্লগার। ধর্মের অবমাননার দায়ে তাদের দু'একজনকে গুরুতর আহত (জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত) অবস্থাতেও জেলে পচতে হয়েছে। সেক্যুলার আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি এবং এখনও দিতে পারছে তা মনে হয় না।
ধর্মের অবমাননার সংজ্ঞাটা কী? আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে তা নির্ণীত হয়নি। সেক্যুলারিজমের পক্ষে কথা বলাই কি ধর্মের অবমাননা? সম্প্রতি প্যারিসে একটি কার্টুন পত্রিকা সরাসরি মহানবীকে (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করায় জঙ্গিরা কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে। তার সঙ্গে বাংলাদেশে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের চরিত্র ও লক্ষ্য কি এক? অভিজিৎ লেখক বা ব্লগার হিসেবে কোনো ধর্মীয় মহাপুরুষকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেননি; কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেননি। তিনি বর্তমানের ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ ছিলেন একজন সেক্যুলারিস্ট। একজন সেক্যুলারিস্ট হলেই কি তাকে হত্যা করার বিধান কোনো ধর্মের রয়েছে? তা যদি না থাকে, তাহলে ধর্মের নামে যারা এই বর্বরতা চালাচ্ছে তারা কে বা কারা? ধর্মের মুখোশের আড়ালে এরা তো আসলে ঘৃণ্য ঘাতক। এরা মানবতার শত্রু। এদের সম্পর্কে কোনো দেশের কোনো সরকারেরই নমনীয় নীতি গ্রহণ করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডে এক বিপজ্জনক মাত্রা যোগ হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডগুলোকে তারা ধর্মের আবরণে ঢাকছে। জামায়াত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তার নেতাদের সমালোচনা করাকেও ধর্মের অবমাননা বলে চালানো হয়। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে, তারা যে যুদ্ধাপরাধ করেছে সে কথা গোপন রেখে ইউরোপে প্রচার করা হচ্ছে। এরা সবাই ইসলামিক স্কলার এবং ইসলামিক স্কলার হওয়াতেই হাসিনা সরকার তাদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ধর্মের উচ্ছেদই এ সরকারের লক্ষ্য। সৌদি আরবে যে সাত দিন ছিলাম তখন দেখেছি, এই প্রচারণাটিই সেখানে প্রবল এবং চালাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত।
অভিজিৎ রায়কেও একজন ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে বহির্বিশ্বে তার হত্যাকাণ্ডকে একজন ধর্মদ্রোহীর শাস্তি বলে চালানোর চেষ্টা হলে বিস্মিত হবো না। বাংলাদেশের জঙ্গি সমর্থক জামায়াতিরা এই চেষ্টা হুমায়ুন আজাদের বেলায় করেছে (তার 'পাক সার জমিন' উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল জামায়াতিদের ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় ব্যভিচারকে ব্যঙ্গ করে, ধর্মকে অবমাননা করে নয়), ব্লগার রাজীবের বেলায় করেছে, এখন অভিজিৎ রায়ের বেলাতেও করা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের সন্ত্রাস একা সরকারের পক্ষে দমন করা সম্ভব নয়। তবে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত। এই বর্বরতা উচ্ছেদের জন্য সংঘবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি করা দরকার।
মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমি ধর্ম বা ধর্মীয় মহাপুরুষদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার অবাধ অধিকারের (যুক্তিসম্মত সমালোচনার নয়) সমর্থক নই। কিন্তু ধর্মের অবমাননার ধুয়া তুলে যারা বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায়, তাদের ধর্ম এবং মানবতা দুয়েরই চরম শত্রু মনে করি। এই শত্রুদেরও মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচানোর জন্য ইউরোপে মানবতার নামে যে ধুয়া তোলা হয়েছে, তা প্রহসন ও ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। মানবতার শত্রুদেরও মৃত্যুদণ্ডদান যদি সমর্থনযোগ্য না হয়, তাহলে সন্ত্রাসীদের দমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যে রোজ ড্রোন হামলা চালিয়ে শয়ে শয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে কেন? এই নিহতদের মধ্যে ক'জন সন্ত্রাসী মারা যাচ্ছে?
যেসব দেশ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের জন্ম দিয়েছে ও বহুদিন লালন-পালন করেছে তারাই আজ নিজেদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দমনে হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকা যে আইএসএসকে তৈরি করেছে, এখন তারই সঙ্গে যুদ্ধরত। সৌদি আরব এতকাল মধ্যপ্রাচ্যে, পাকিস্তানে, এমনকি বাংলাদেশেও মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের মদদ জুগিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই মৌলবাদী জঙ্গিদের ভয়ে এখন তারাই শঙ্কিত।
আমি সৌদি আরবে থাকাকালীন অবস্থাতেই মক্কা শরিফে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলন। সম্মেলনটির নাম ছিল 'ইসলাম অ্যান্ড কমব্যাটিং টেরর বা ইসলাম ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অনেক ইসলামিক স্কলার ও ওলামা এই সম্মেলনে হাজির হয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস যে ইসলামবিরোধী এবং এই জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোর বেকার ও অভাবী যুবকদের ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করে সন্ত্রাসী হিসেবে রিত্রুক্রট করা হচ্ছে। এই সন্ত্রাস দমনের উপায় সম্পর্কেও এই আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশেও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান একদিনে ঘটেনি, আবার একদিনে তার উচ্ছেদ ঘটানো যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছর না যেতেই দেশের সেক্যুলার সরকার ও সংবিধান উচ্ছেদ করে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার স্বাধীনতার শত্রু পলাতক মৌলবাদীদের এবং যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিল। পরবর্তীকালে তার দলের সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়ে সেই বিষবৃক্ষ এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। একে নির্মূল করা যে সহজ নয়, তার প্রমাণ হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা, আমাদের একটি সুশীল সমাজ বর্তমানে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষে এবং তার বিরোধিতায় এতই অন্ধ যে, ভয়াবহ জঙ্গিবাদ সম্পর্কে তারা ততটা সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় নয়। ফলে এই দানবের বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তি ও ঐক্য দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের সুশীল সমাজের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ কতটা দেশ এবং গণস্বার্থবিরোধী তার প্রমাণ ড. কামাল হোসেন গ্রুপের নতুন পাণ্ডা মাহমুদুর রহমান মান্নার ভূমিকা থেকেও ফাঁস হয়ে গেছে। আমি মাত্র ক'দিন আগেই ঢাকার একটি দৈনিকে 'বিএনপির সুশীল সহযোগী' শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছি। তা যে শিগগির এত সত্য হয়ে দাঁড়াবে তা নিজেও ভাবিনি।
অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরে যতটা শোকাহত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি হয়েছি ত্রুক্রদ্ধ। এই পশুদের নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা আর কতকাল দেশের মানুষকে সহ্য করতে হবে? কতকাল, আর কতকাল এই অব্যাহত নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং কেবল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে দায়িত্ব শেষ করতে হবে? বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ এবং সমাজ গরিব। এ দেশের সন্ত্রাসী রিত্রুক্রট করা এবং লালন করাও সহজ। দু'জন সন্ত্রাসীকে ধরে সাজা দিলেই সন্ত্রাস দমন হবে না; যতদিন তার নতুন রিত্রুক্রট বন্ধ না হয়, এই রিত্রুক্রটকারীদের চিহ্নিত করা ও ধরার ব্যাপারে সরকার কঠোর হোক এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। অভিজিৎ হত্যা কোনো শোক নয়, আমাদের সম্মিলিত সামাজিক ক্রোধকে জাগ্রত করুক। সেই ক্রোধের শক্তিতে যেন আমরা এই দানবচক্রকে নির্মূল করার জন্য সংঘবদ্ধ হই।
লন্ডন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
ইচ্ছা ছিল লন্ডনে ফিরে এসে জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় সাত দিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখব। লেখার বিষয় ছিল বিস্তর। জেদ্দায় বাংলাদেশিদের পরিচালনাধীন দুটি আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি ও বাংলামাধ্যমের স্কুল ও কলেজ আছে। তাদের আমন্ত্রণে এবং জেদ্দায় নিযুক্ত আমাদের কনসাল জেনারেল শহিদুল করিম ও তার স্ত্রীর সৌজন্যে আমার এই সৌদি আরব ভ্রমণ। একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় একই দিনে জেদ্দায় একুশের তিনটি অনুষ্ঠানে আমাকে অংশ নিতে হয়েছে। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তাদের সুখ-দুঃখ সমস্যার কথা জেনেছি। ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই লিখব। কিন্তু জেদ্দা থেকে লন্ডনে ফিরে আসতেই অভিজিৎ রায়ের ওপর এ পৈশাচিক হামলা এবং তার মৃত্যুর খবর! ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৌদি ভ্রমণকথা আপাতত স্থগিত রইল। লেখার বিষয়বস্তু পাল্টাতে হলো।
অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নির্মম, কিন্তু নতুন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। কয়েক বছর আগে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একই ধরনের হত্যা প্রচেষ্টা (পরিণতিতে মৃত্যু) আমরা দেখেছি। তারপর এই সেদিন বর্তমান আওয়ামী লীগ শামনামলেই আমরা দেখেছি, রাজীবসহ একাধিক তরুণ এবং সেক্যুলার ব্লগারকে এই পৈশাচসিদ্ধ জঙ্গিদের হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ। হুমায়ুন আজাদের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উস্কানিদাতারা তখন চিহ্নিত হয়েও সাজা পায়নি। বর্তমান সময়ে সেক্যুলার ব্লগারদের হত্যার নায়করাও তেমন শাস্তি পায়নি; শাস্তি পেয়েছে একাধিক ব্লগার। ধর্মের অবমাননার দায়ে তাদের দু'একজনকে গুরুতর আহত (জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত) অবস্থাতেও জেলে পচতে হয়েছে। সেক্যুলার আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি এবং এখনও দিতে পারছে তা মনে হয় না।
ধর্মের অবমাননার সংজ্ঞাটা কী? আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে তা নির্ণীত হয়নি। সেক্যুলারিজমের পক্ষে কথা বলাই কি ধর্মের অবমাননা? সম্প্রতি প্যারিসে একটি কার্টুন পত্রিকা সরাসরি মহানবীকে (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করায় জঙ্গিরা কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে। তার সঙ্গে বাংলাদেশে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের চরিত্র ও লক্ষ্য কি এক? অভিজিৎ লেখক বা ব্লগার হিসেবে কোনো ধর্মীয় মহাপুরুষকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেননি; কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেননি। তিনি বর্তমানের ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ ছিলেন একজন সেক্যুলারিস্ট। একজন সেক্যুলারিস্ট হলেই কি তাকে হত্যা করার বিধান কোনো ধর্মের রয়েছে? তা যদি না থাকে, তাহলে ধর্মের নামে যারা এই বর্বরতা চালাচ্ছে তারা কে বা কারা? ধর্মের মুখোশের আড়ালে এরা তো আসলে ঘৃণ্য ঘাতক। এরা মানবতার শত্রু। এদের সম্পর্কে কোনো দেশের কোনো সরকারেরই নমনীয় নীতি গ্রহণ করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডে এক বিপজ্জনক মাত্রা যোগ হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডগুলোকে তারা ধর্মের আবরণে ঢাকছে। জামায়াত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তার নেতাদের সমালোচনা করাকেও ধর্মের অবমাননা বলে চালানো হয়। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে, তারা যে যুদ্ধাপরাধ করেছে সে কথা গোপন রেখে ইউরোপে প্রচার করা হচ্ছে। এরা সবাই ইসলামিক স্কলার এবং ইসলামিক স্কলার হওয়াতেই হাসিনা সরকার তাদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ধর্মের উচ্ছেদই এ সরকারের লক্ষ্য। সৌদি আরবে যে সাত দিন ছিলাম তখন দেখেছি, এই প্রচারণাটিই সেখানে প্রবল এবং চালাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত।
অভিজিৎ রায়কেও একজন ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে বহির্বিশ্বে তার হত্যাকাণ্ডকে একজন ধর্মদ্রোহীর শাস্তি বলে চালানোর চেষ্টা হলে বিস্মিত হবো না। বাংলাদেশের জঙ্গি সমর্থক জামায়াতিরা এই চেষ্টা হুমায়ুন আজাদের বেলায় করেছে (তার 'পাক সার জমিন' উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল জামায়াতিদের ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় ব্যভিচারকে ব্যঙ্গ করে, ধর্মকে অবমাননা করে নয়), ব্লগার রাজীবের বেলায় করেছে, এখন অভিজিৎ রায়ের বেলাতেও করা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের সন্ত্রাস একা সরকারের পক্ষে দমন করা সম্ভব নয়। তবে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত। এই বর্বরতা উচ্ছেদের জন্য সংঘবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি করা দরকার।
মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমি ধর্ম বা ধর্মীয় মহাপুরুষদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার অবাধ অধিকারের (যুক্তিসম্মত সমালোচনার নয়) সমর্থক নই। কিন্তু ধর্মের অবমাননার ধুয়া তুলে যারা বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায়, তাদের ধর্ম এবং মানবতা দুয়েরই চরম শত্রু মনে করি। এই শত্রুদেরও মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচানোর জন্য ইউরোপে মানবতার নামে যে ধুয়া তোলা হয়েছে, তা প্রহসন ও ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। মানবতার শত্রুদেরও মৃত্যুদণ্ডদান যদি সমর্থনযোগ্য না হয়, তাহলে সন্ত্রাসীদের দমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যে রোজ ড্রোন হামলা চালিয়ে শয়ে শয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে কেন? এই নিহতদের মধ্যে ক'জন সন্ত্রাসী মারা যাচ্ছে?
যেসব দেশ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের জন্ম দিয়েছে ও বহুদিন লালন-পালন করেছে তারাই আজ নিজেদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দমনে হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকা যে আইএসএসকে তৈরি করেছে, এখন তারই সঙ্গে যুদ্ধরত। সৌদি আরব এতকাল মধ্যপ্রাচ্যে, পাকিস্তানে, এমনকি বাংলাদেশেও মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের মদদ জুগিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই মৌলবাদী জঙ্গিদের ভয়ে এখন তারাই শঙ্কিত।
আমি সৌদি আরবে থাকাকালীন অবস্থাতেই মক্কা শরিফে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলন। সম্মেলনটির নাম ছিল 'ইসলাম অ্যান্ড কমব্যাটিং টেরর বা ইসলাম ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অনেক ইসলামিক স্কলার ও ওলামা এই সম্মেলনে হাজির হয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস যে ইসলামবিরোধী এবং এই জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোর বেকার ও অভাবী যুবকদের ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করে সন্ত্রাসী হিসেবে রিত্রুক্রট করা হচ্ছে। এই সন্ত্রাস দমনের উপায় সম্পর্কেও এই আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশেও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান একদিনে ঘটেনি, আবার একদিনে তার উচ্ছেদ ঘটানো যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছর না যেতেই দেশের সেক্যুলার সরকার ও সংবিধান উচ্ছেদ করে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার স্বাধীনতার শত্রু পলাতক মৌলবাদীদের এবং যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিল। পরবর্তীকালে তার দলের সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়ে সেই বিষবৃক্ষ এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। একে নির্মূল করা যে সহজ নয়, তার প্রমাণ হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা, আমাদের একটি সুশীল সমাজ বর্তমানে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষে এবং তার বিরোধিতায় এতই অন্ধ যে, ভয়াবহ জঙ্গিবাদ সম্পর্কে তারা ততটা সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় নয়। ফলে এই দানবের বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তি ও ঐক্য দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের সুশীল সমাজের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ কতটা দেশ এবং গণস্বার্থবিরোধী তার প্রমাণ ড. কামাল হোসেন গ্রুপের নতুন পাণ্ডা মাহমুদুর রহমান মান্নার ভূমিকা থেকেও ফাঁস হয়ে গেছে। আমি মাত্র ক'দিন আগেই ঢাকার একটি দৈনিকে 'বিএনপির সুশীল সহযোগী' শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছি। তা যে শিগগির এত সত্য হয়ে দাঁড়াবে তা নিজেও ভাবিনি।
অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরে যতটা শোকাহত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি হয়েছি ত্রুক্রদ্ধ। এই পশুদের নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা আর কতকাল দেশের মানুষকে সহ্য করতে হবে? কতকাল, আর কতকাল এই অব্যাহত নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং কেবল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে দায়িত্ব শেষ করতে হবে? বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ এবং সমাজ গরিব। এ দেশের সন্ত্রাসী রিত্রুক্রট করা এবং লালন করাও সহজ। দু'জন সন্ত্রাসীকে ধরে সাজা দিলেই সন্ত্রাস দমন হবে না; যতদিন তার নতুন রিত্রুক্রট বন্ধ না হয়, এই রিত্রুক্রটকারীদের চিহ্নিত করা ও ধরার ব্যাপারে সরকার কঠোর হোক এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। অভিজিৎ হত্যা কোনো শোক নয়, আমাদের সম্মিলিত সামাজিক ক্রোধকে জাগ্রত করুক। সেই ক্রোধের শক্তিতে যেন আমরা এই দানবচক্রকে নির্মূল করার জন্য সংঘবদ্ধ হই।
লন্ডন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
No comments