শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ক্রমহ্রাসমান বিধি by মাহবুব কামাল
সত্যজিৎ
রায় তার প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র প্রেস শোতে অসাধারণ বাগবৈদগ্ধের
অধিকারী কমলকুমার মজুমদারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কমলদার মূল্যায়ন তার
দরকার খুব। শো শেষে সত্যজিৎ সোৎসাহে কমলদার মন্তব্য জানতে চাইলেন। যা
শুনলেন তিনি, তা কহতব্য নয়। কমলদা বললেন, এটা তুই কী বানিয়েছিস? পুরো
ছবিটাই তো ট্র্যাশ। তবে দু’একটি শট মোটামুটি হয়েছে; কিন্তু সেটাও তো তুই
রাশোমন (আকিরা কুরুসাওয়ার বিখ্যাত ছবি) থেকে মেরেছিস। সত্যজিৎ রায়ের
অভিমান হলো খুব। সিদ্ধান্ত নিলেন কমলদার মুখোমুখি হবেন না আর কখনও। কিন্তু
ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগলো না। সত্যজিৎ লিখছেন, ছয় মাস পর আমি ছুটে গেলাম
দাদার কাছে। কারণ, ততোদিনে আমি বুঝে ফেলেছি গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে ছবি বানিয়ে
কমলদাকে খুশি করানোর যোগ্যতা তখনও হয়নি আমার।
এবার আমার ভুল কীভাবে ভাঙে একটু দেখুন। ১৯৭৫ সালে হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসটি পড়ার পর ছুটে গিয়েছিলাম আহমদ শরীফ স্যারের কাছে। বলেছিলাম, স্যার একটা বুড়ো সারাদিন সমুদ্রে মাছ ধরে- কী এমন তাৎপর্য রয়েছে এই উপন্যাসে যে, নোবেল পেল! শরীফ স্যার জীবনে অনেক আস্তিক-নাস্তিক দেখেছেন, আমার মতো এমন অর্বাচীন হয়তো দেখেননি। তাই শুধু বলেছিলেন, তুমি দশ বছর পর বইটি আবার পড়বে, তাতে যদি তোমার আক্কেল হয়। তখন আবার এসো।
এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ধৈর্য হয়নি আমার। ’৮০ সালে উপন্যাসটি আবারও পড়লাম। বলাবাহুল্য, শরীফ স্যারের কাছে যেতে হয়নি আর। নিজের ভুল নিজেই ভেঙেছিলাম।
মানুষের ভুল ভাঙে দু’ভাবে। হয় চিন্তা পরিশীলিত করে সে নিজের ভুল নিজেই ভাঙে অথবা অন্যের উপলব্ধি নিজের করে নিয়ে পুরনো ধারণা থেকে সরে আসে। মানুষ আসলে ভুল ভেঙে ভেঙেই সামনের দিকে এগোয়। ভুল ভাঙার কতোরকম যে কাহিনী আছে। প্রথম আলাপে মনে হয়েছিল, এমন ভালো মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই; পরে একদিন বোঝা হলো দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলতে নেই। আবার এমনও হয়, প্রথম আলাপে মনে হয়েছে এক্কেবারে নাদান, ক্রমেই ভুল ভেঙেছে, এত বুদ্ধি আর জ্ঞান থাকে নাকি মানুষের? পৃথিবীর অন্তত ৫০ শতাংশ পুরুষ অথবা নারী দাম্পত্য জীবনের এক পর্যায়ে এসে অন্য পক্ষকে বলে থাকে, তোমাকে বিয়ে করে ভুল করেছি আমি। আবার অবিশ্বাসজনিত ভুল ভাঙার ঘটনাও অগুনতি। বাংলা গানের প্রিয়তম শিল্পী পিন্টু ভট্টাচার্যের ওই গানটি শুনুন না একবার- ভুল ভেঙে গেলে কাছে আসবে, আমি জানতাম।
গৌরচন্দ্রিকা বড় হয়ে গেল। আমাদের আজকের জিজ্ঞাসা- আমার বিএনপিমনা বন্ধুটির ভুল ভাঙতে আর কতোদিন লাগবে? এই বন্ধুটি আমার ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচির শুরু থেকে অন্তত তিনবার বলেছে, আর সাত দিনের মধ্যে সরকারের পতন ঘটবে। শেষবারের সাত দিনও অতিক্রান্ত হয়েছে চার-পাঁচদিন আগে; সরকারের পতন হয়নি, হচ্ছে না। তাকে আমি প্রথম দফায়ই বলেছিলাম, সোশ্যাল ডিনামিক্স বোঝা এত সহজ নয়। সাত দিন কেন, সাত মাসেও এ সরকারের পতন হবে না। বন্ধু আমার, ভুল তোমার ভাঙতেই হবে।
২.
সংসার-জগতের কঠিনতম কাজগুলোর একটি বুঝি মানবচরিত্র ব্যাখ্যা করা। কবি বায়রন তো বলেই ফেলেছিলেন- যন্ত্র হিসেবে মানুষের মনকে আমি চার ডলারের বেশি দিয়ে কিনতে রাজি নই, কারণ এটা যে কোনো সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। অদ্ভুত ব্যাপার না! যে মানুষ অন্যের স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নেয়, কখনও কখনও আত্মাহুতিও দেয়; সেই একই মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থে অন্যকে খুন করে। তবে মান্না ভাইয়ের মাথা কিংবা মন এতটা বিকল হবে ভাবতে পারিনি।
মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর জাসদের আর্মস ব্যান্ডের ছয় সদস্য তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনারকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। হাইকমিশনের রক্ষীদের গুলিতে তাদের চারজন নিহত ও দু’জন আহত হয়েছিল সেই ব্যর্থ অভিযানে। দুপুর আড়াইটার রেডিও-সংবাদে ঘটনা শোনার পর আমি ছুটে গিয়েছিলাম গোপীবাগের যে বাসায় থাকতেন মান্না ভাই সেখানে। তিনি সব শুনে শুধু বলেছিলেন- কে সাজিয়েছে এই অপারেশন? না, না এটা হতে পারে না, এটা ইনফ্যান্টাইল ডিজঅর্ডার, শিশুসুলভ হঠকারিতা। ইউনিভার্সিটিতে দু’চারটা লাশ পড়লে সেই মান্না ভাইয়ের কিছু যায়-আসে না! তাজ্জব হয়ে যাই।
মান্না ভাই তো এমন ছিলেন না। ডাকসুতে প্রথমবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর জিয়া তাকে তার দলে টানার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন জিয়ার প্রস্তাব। অথচ তখন বিএনপিতে যোগ দিলে পরবর্তী সব নির্বাচনেই তিনি এমপি হতে পারতেন, কোনো এক বা দুই টার্মে মন্ত্রী হওয়াও বিচিত্র ছিল না। তার কন্সটিটুয়েন্সি যেহেতু বগুড়ায়, ক্ষমতার প্রতি মোহ থাকলে তিনি বিএনপিই করতেন। অথচ সেই মান্না ভাই ৬৫ বছর বয়সে, বিএনপি যখন নিরীহ মানুষ হত্যার রাজনীতি ঢ়বৎংঁধফব করছে, তখন সেই রাজনীতির সমর্থক বনে গেলেন। তবে কি বয়সটা বেড়ে যাওয়ায় আর তর সইছিল না মান্না ভাইয়ের? চিরকালই বিরোধী অবস্থানে ছিলেন তিনি, ক্ষমতার স্বাদ পাননি কখনও। হয়তো হাতে আর সময় নেই ভেবেই প্রতিশ্র“তিশীল বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, খোকা ভাইকে শিক্ষিত করতে চেয়েছেন এই শিক্ষায় যে, লাশ ছাড়া আন্দোলন জমে না।
সত্য কথা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল মান্না ভাইয়ের। সংস্কারপন্থী হিসেবে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মান্না ভাই হয়তো পড়তে পারবেন না এ লেখা, তবু বলি, ঝামেলা কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর কারও হয়নি? সাধারণভাবে বললে ’৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত আমরা তো সবাই আওয়ামী লীগই ছিলাম। স্বাধীনতার পর সেই বনেদি একান্নবর্তী পরিবারের অনেকেই আলাদা হাঁড়িতে রান্না চড়িয়েছি। তো আলাদা হয়েছি বলে আওয়ামী লীগের ধ্বংস কামনা করতে হবে? জানপ্রাণ ছেড়ে দিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে হলেও তার পতন ঘটাতে হবে? কন্দমূলকে (মূলা) মাটি থেকে তুলে আনলেও তার গায়ে লেগে থাকে অন্তঃস্থলের মাটি, স্থানীয় গন্ধ। মান্না ভাইকে প্রশ্ন করি, আপনি, আমি এবং আমাদের মতো অসংখ্য মানুষ, যারা আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছি, তাদের গায়ে কি লেগে নেই দলটির স্থানীয় গন্ধ? তাহলে কেন এই উৎকট বৈরিতা?
সবশেষে বলি, এই যে এত ভালোবাসা পাচ্ছিলেন, এক সময়কার ছাত্রসমাজ ‘মান্না ভাই’ বলতে পাগল ছিল, সাধারণের মাঝে ছিল ভদ্র, নম্র, বিবেচকের ভাবমূর্তি আপনার- ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব কি এসবের চেয়ে বড় কিছু? মহান কিছু মান্না ভাই?
৩.
আমার একটা কৈশোর, একটা যৌবন ছিল, যখন মুগ্ধ হতাম অনবরত। কোনো কিছুর কার্যকারণ খুঁজতে যেতাম না তখন, তাই বুঝি ছিল এতো মুগ্ধতা। পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে দেখেই শেষ হয়ে যেতো সময়, জানতে চাইনি উড়ে যাওয়ার মেকানিজম। বিকেলে পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে এসে রাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত- কী অসাধারণ লাগতো এই দুই পূজনীয় ব্যক্তিকে। এখন কার্যকারণ খুঁজতে চাই বলে কিনা জানি না, আর তেমন মুগ্ধ হই না। মুগ্ধতার ক্রমহ্রাসমান ধারাটির শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। একেকটা সময় আসে- একেকটা হিট গান যেমন মাতায় আমাদের, স্বাধীনতার পরপর মার্কসবাদও তেমন হিট মতবাদ হয়ে শ্রেণীসংগ্রামের মন্ত্রে নাচাতে থাকে যুবক। আমাকেও নাচায় সেই সঙ্গীত আর তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার রঙ ফিকে হয়ে আসতে থাকে, হৃদয়পটে গেঁথে যায় মার্কস-লেনিনের ছবি এবং একদিন লক্ষ করি, শেখ মুজিব অনেক দূরে আমার শ্রদ্ধা থেকে। সেই প্রথম ভালোবাসার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, সেই প্রথম নষ্ট হয়ে যাওয়া, সেই প্রথম বেশ্যাবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথকেও আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওরা। বলেছিল, তার কবিতা নাকি বায়বীয়, কোনো পদার্থ নেই তাতে, মানুষকে তা কেবলই অবশ করে, ছত্রভঙ্গ করে দেয় প্রতিবাদের মিছিল। আমার নিম্ন মধ্যবিত্তের অক্ষমতার অভিমান ও ক্রোধ কাজে লাগিয়ে আমাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তারা জমিদার রবীন্দ্রনাথের। ছলনায় ভুলি আমি, কপট বাগ্মিতার কাছে হেরে গিয়ে শত্রু বানাই একদার ভালোবাসার মানুষকে।
রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে এনেছি বটে, যদিও ভুল ভাঙতে সময় লেগেছে ৮-৯ বছর। কিন্তু এই দুজন মাত্র দিয়েই চলে কি জীবন? প্রশ্নটা এজন্য যে, আর কাউকেই যে শ্রদ্ধা করতে অথবা ভালোবাসতে পারি না। হতে পারে, বিচারবুদ্ধির উৎকর্ষ বেড়েছে অথবা রয়েছে অভিজ্ঞতার কড়া শাসন- তাই নিরঙ্কুশ ভালোবাসা অথবা শ্রদ্ধা জন্মাতে পারে না। অথবা এমনও হতে পারে, শ্রদ্ধার মানুষরা দূর থেকে যতো চমৎকার, ভালোবাসার টানে কাছে গেলে সেই চমৎকারিত্ব থাকে না আর। কিংবা হয়তো পৃথিবীর সব মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে কিছু নেতিবাচক দিক, গভীর পর্যবেক্ষণে তা বেরিয়ে আসে একদিন। নিরঙ্কুশ ভালোবাসা কি মার খায় এখানেই?
শ্রদ্ধার প্রশ্নে আমার সবেধন নীলমণি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আর ভালোবাসায় ছিলেন মান্না ভাই। ভালোবাসারও একটা বস্তুগত ভিত্তি থাকে। মান্না ভাইকে আর কখনও ভালোবাসতে পারবো কিনা জানি না। রবীন্দ্রনাথ একাকিত্বকে বর্ণনা করেছেন- যবে ভরা মন নিয়ে বসে আছি, দিতে চাই নিতে কেহ নাই। আমি, হয়তো আমার মতো আরও অনেকে বড্ড একাকী হয়ে পড়েছি এই দেশে।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08Ñ@yahoo.com
এবার আমার ভুল কীভাবে ভাঙে একটু দেখুন। ১৯৭৫ সালে হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসটি পড়ার পর ছুটে গিয়েছিলাম আহমদ শরীফ স্যারের কাছে। বলেছিলাম, স্যার একটা বুড়ো সারাদিন সমুদ্রে মাছ ধরে- কী এমন তাৎপর্য রয়েছে এই উপন্যাসে যে, নোবেল পেল! শরীফ স্যার জীবনে অনেক আস্তিক-নাস্তিক দেখেছেন, আমার মতো এমন অর্বাচীন হয়তো দেখেননি। তাই শুধু বলেছিলেন, তুমি দশ বছর পর বইটি আবার পড়বে, তাতে যদি তোমার আক্কেল হয়। তখন আবার এসো।
এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ধৈর্য হয়নি আমার। ’৮০ সালে উপন্যাসটি আবারও পড়লাম। বলাবাহুল্য, শরীফ স্যারের কাছে যেতে হয়নি আর। নিজের ভুল নিজেই ভেঙেছিলাম।
মানুষের ভুল ভাঙে দু’ভাবে। হয় চিন্তা পরিশীলিত করে সে নিজের ভুল নিজেই ভাঙে অথবা অন্যের উপলব্ধি নিজের করে নিয়ে পুরনো ধারণা থেকে সরে আসে। মানুষ আসলে ভুল ভেঙে ভেঙেই সামনের দিকে এগোয়। ভুল ভাঙার কতোরকম যে কাহিনী আছে। প্রথম আলাপে মনে হয়েছিল, এমন ভালো মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই; পরে একদিন বোঝা হলো দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলতে নেই। আবার এমনও হয়, প্রথম আলাপে মনে হয়েছে এক্কেবারে নাদান, ক্রমেই ভুল ভেঙেছে, এত বুদ্ধি আর জ্ঞান থাকে নাকি মানুষের? পৃথিবীর অন্তত ৫০ শতাংশ পুরুষ অথবা নারী দাম্পত্য জীবনের এক পর্যায়ে এসে অন্য পক্ষকে বলে থাকে, তোমাকে বিয়ে করে ভুল করেছি আমি। আবার অবিশ্বাসজনিত ভুল ভাঙার ঘটনাও অগুনতি। বাংলা গানের প্রিয়তম শিল্পী পিন্টু ভট্টাচার্যের ওই গানটি শুনুন না একবার- ভুল ভেঙে গেলে কাছে আসবে, আমি জানতাম।
গৌরচন্দ্রিকা বড় হয়ে গেল। আমাদের আজকের জিজ্ঞাসা- আমার বিএনপিমনা বন্ধুটির ভুল ভাঙতে আর কতোদিন লাগবে? এই বন্ধুটি আমার ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচির শুরু থেকে অন্তত তিনবার বলেছে, আর সাত দিনের মধ্যে সরকারের পতন ঘটবে। শেষবারের সাত দিনও অতিক্রান্ত হয়েছে চার-পাঁচদিন আগে; সরকারের পতন হয়নি, হচ্ছে না। তাকে আমি প্রথম দফায়ই বলেছিলাম, সোশ্যাল ডিনামিক্স বোঝা এত সহজ নয়। সাত দিন কেন, সাত মাসেও এ সরকারের পতন হবে না। বন্ধু আমার, ভুল তোমার ভাঙতেই হবে।
২.
সংসার-জগতের কঠিনতম কাজগুলোর একটি বুঝি মানবচরিত্র ব্যাখ্যা করা। কবি বায়রন তো বলেই ফেলেছিলেন- যন্ত্র হিসেবে মানুষের মনকে আমি চার ডলারের বেশি দিয়ে কিনতে রাজি নই, কারণ এটা যে কোনো সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। অদ্ভুত ব্যাপার না! যে মানুষ অন্যের স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নেয়, কখনও কখনও আত্মাহুতিও দেয়; সেই একই মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থে অন্যকে খুন করে। তবে মান্না ভাইয়ের মাথা কিংবা মন এতটা বিকল হবে ভাবতে পারিনি।
মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর জাসদের আর্মস ব্যান্ডের ছয় সদস্য তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনারকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। হাইকমিশনের রক্ষীদের গুলিতে তাদের চারজন নিহত ও দু’জন আহত হয়েছিল সেই ব্যর্থ অভিযানে। দুপুর আড়াইটার রেডিও-সংবাদে ঘটনা শোনার পর আমি ছুটে গিয়েছিলাম গোপীবাগের যে বাসায় থাকতেন মান্না ভাই সেখানে। তিনি সব শুনে শুধু বলেছিলেন- কে সাজিয়েছে এই অপারেশন? না, না এটা হতে পারে না, এটা ইনফ্যান্টাইল ডিজঅর্ডার, শিশুসুলভ হঠকারিতা। ইউনিভার্সিটিতে দু’চারটা লাশ পড়লে সেই মান্না ভাইয়ের কিছু যায়-আসে না! তাজ্জব হয়ে যাই।
মান্না ভাই তো এমন ছিলেন না। ডাকসুতে প্রথমবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর জিয়া তাকে তার দলে টানার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন জিয়ার প্রস্তাব। অথচ তখন বিএনপিতে যোগ দিলে পরবর্তী সব নির্বাচনেই তিনি এমপি হতে পারতেন, কোনো এক বা দুই টার্মে মন্ত্রী হওয়াও বিচিত্র ছিল না। তার কন্সটিটুয়েন্সি যেহেতু বগুড়ায়, ক্ষমতার প্রতি মোহ থাকলে তিনি বিএনপিই করতেন। অথচ সেই মান্না ভাই ৬৫ বছর বয়সে, বিএনপি যখন নিরীহ মানুষ হত্যার রাজনীতি ঢ়বৎংঁধফব করছে, তখন সেই রাজনীতির সমর্থক বনে গেলেন। তবে কি বয়সটা বেড়ে যাওয়ায় আর তর সইছিল না মান্না ভাইয়ের? চিরকালই বিরোধী অবস্থানে ছিলেন তিনি, ক্ষমতার স্বাদ পাননি কখনও। হয়তো হাতে আর সময় নেই ভেবেই প্রতিশ্র“তিশীল বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, খোকা ভাইকে শিক্ষিত করতে চেয়েছেন এই শিক্ষায় যে, লাশ ছাড়া আন্দোলন জমে না।
সত্য কথা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল মান্না ভাইয়ের। সংস্কারপন্থী হিসেবে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মান্না ভাই হয়তো পড়তে পারবেন না এ লেখা, তবু বলি, ঝামেলা কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর কারও হয়নি? সাধারণভাবে বললে ’৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত আমরা তো সবাই আওয়ামী লীগই ছিলাম। স্বাধীনতার পর সেই বনেদি একান্নবর্তী পরিবারের অনেকেই আলাদা হাঁড়িতে রান্না চড়িয়েছি। তো আলাদা হয়েছি বলে আওয়ামী লীগের ধ্বংস কামনা করতে হবে? জানপ্রাণ ছেড়ে দিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে হলেও তার পতন ঘটাতে হবে? কন্দমূলকে (মূলা) মাটি থেকে তুলে আনলেও তার গায়ে লেগে থাকে অন্তঃস্থলের মাটি, স্থানীয় গন্ধ। মান্না ভাইকে প্রশ্ন করি, আপনি, আমি এবং আমাদের মতো অসংখ্য মানুষ, যারা আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছি, তাদের গায়ে কি লেগে নেই দলটির স্থানীয় গন্ধ? তাহলে কেন এই উৎকট বৈরিতা?
সবশেষে বলি, এই যে এত ভালোবাসা পাচ্ছিলেন, এক সময়কার ছাত্রসমাজ ‘মান্না ভাই’ বলতে পাগল ছিল, সাধারণের মাঝে ছিল ভদ্র, নম্র, বিবেচকের ভাবমূর্তি আপনার- ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব কি এসবের চেয়ে বড় কিছু? মহান কিছু মান্না ভাই?
৩.
আমার একটা কৈশোর, একটা যৌবন ছিল, যখন মুগ্ধ হতাম অনবরত। কোনো কিছুর কার্যকারণ খুঁজতে যেতাম না তখন, তাই বুঝি ছিল এতো মুগ্ধতা। পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে দেখেই শেষ হয়ে যেতো সময়, জানতে চাইনি উড়ে যাওয়ার মেকানিজম। বিকেলে পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে এসে রাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত- কী অসাধারণ লাগতো এই দুই পূজনীয় ব্যক্তিকে। এখন কার্যকারণ খুঁজতে চাই বলে কিনা জানি না, আর তেমন মুগ্ধ হই না। মুগ্ধতার ক্রমহ্রাসমান ধারাটির শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। একেকটা সময় আসে- একেকটা হিট গান যেমন মাতায় আমাদের, স্বাধীনতার পরপর মার্কসবাদও তেমন হিট মতবাদ হয়ে শ্রেণীসংগ্রামের মন্ত্রে নাচাতে থাকে যুবক। আমাকেও নাচায় সেই সঙ্গীত আর তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার রঙ ফিকে হয়ে আসতে থাকে, হৃদয়পটে গেঁথে যায় মার্কস-লেনিনের ছবি এবং একদিন লক্ষ করি, শেখ মুজিব অনেক দূরে আমার শ্রদ্ধা থেকে। সেই প্রথম ভালোবাসার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, সেই প্রথম নষ্ট হয়ে যাওয়া, সেই প্রথম বেশ্যাবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথকেও আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওরা। বলেছিল, তার কবিতা নাকি বায়বীয়, কোনো পদার্থ নেই তাতে, মানুষকে তা কেবলই অবশ করে, ছত্রভঙ্গ করে দেয় প্রতিবাদের মিছিল। আমার নিম্ন মধ্যবিত্তের অক্ষমতার অভিমান ও ক্রোধ কাজে লাগিয়ে আমাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তারা জমিদার রবীন্দ্রনাথের। ছলনায় ভুলি আমি, কপট বাগ্মিতার কাছে হেরে গিয়ে শত্রু বানাই একদার ভালোবাসার মানুষকে।
রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে এনেছি বটে, যদিও ভুল ভাঙতে সময় লেগেছে ৮-৯ বছর। কিন্তু এই দুজন মাত্র দিয়েই চলে কি জীবন? প্রশ্নটা এজন্য যে, আর কাউকেই যে শ্রদ্ধা করতে অথবা ভালোবাসতে পারি না। হতে পারে, বিচারবুদ্ধির উৎকর্ষ বেড়েছে অথবা রয়েছে অভিজ্ঞতার কড়া শাসন- তাই নিরঙ্কুশ ভালোবাসা অথবা শ্রদ্ধা জন্মাতে পারে না। অথবা এমনও হতে পারে, শ্রদ্ধার মানুষরা দূর থেকে যতো চমৎকার, ভালোবাসার টানে কাছে গেলে সেই চমৎকারিত্ব থাকে না আর। কিংবা হয়তো পৃথিবীর সব মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে কিছু নেতিবাচক দিক, গভীর পর্যবেক্ষণে তা বেরিয়ে আসে একদিন। নিরঙ্কুশ ভালোবাসা কি মার খায় এখানেই?
শ্রদ্ধার প্রশ্নে আমার সবেধন নীলমণি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আর ভালোবাসায় ছিলেন মান্না ভাই। ভালোবাসারও একটা বস্তুগত ভিত্তি থাকে। মান্না ভাইকে আর কখনও ভালোবাসতে পারবো কিনা জানি না। রবীন্দ্রনাথ একাকিত্বকে বর্ণনা করেছেন- যবে ভরা মন নিয়ে বসে আছি, দিতে চাই নিতে কেহ নাই। আমি, হয়তো আমার মতো আরও অনেকে বড্ড একাকী হয়ে পড়েছি এই দেশে।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08Ñ@yahoo.com
No comments