পানি আর ইলিশ ভাসল বাঙালির বেগুন নেই by ফরিদা আখতার
পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন। তার ৪০ জনের বেশি
সফরসঙ্গীর মধ্যে ছিলেন কবি সুবোধ সরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ ও
ব্রাত্য বসু, অভিনেত্রী মুনমুন সেন, অভিনেতা প্রসেনজিত্, দীপক অধিকারী
(দেব) ও অরিন্দম শীল, কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা ঘোষ ও ইন্দ্রনীল সেন, কবি কাজী
নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। এছাড়া ছিলেন শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া ও
সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এবং একদল সাংবাদিক। ভারতীয় সাংবাদিকরা এ সফর নিয়ে কী
লিখছেন, আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় যা উঠেছে এবং
টিভি চ্যানেল যেভাবে কভার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে মনে হয়েছে,
এবার সরকারের একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিটাই মমতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সারা
দিন মমতা নিয়ে লাইভ শো কিংবা সংবাদ শিরোনাম। মমতা সন্তুষ্ট মনেই রাতে ফিরে
গেছেন। বিএনপির সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না করে বার্তা দিয়ে গেলেন, তিনি শেখ
হাসিনার পছন্দের মানুষ। তার হাসিনাদি। কাজেই হাসিনাদি পছন্দ করেন না, এমন
কারো সঙ্গে দেখা করে কাজ নেই।
বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি বিগত কংগ্রেস সরকারের পক্ষে মনমোহন সিংয়ের যে সরকারি সফর ছিল, তাতে তিস্তা চুক্তি প্রায় হয় হয় অবস্থায় গিয়েও হতে পারেনি মমতার আপত্তিতে। এবার তাই তিনি যখন এলেন এবং ‘আশ্বাস’ দিলেন, তখন সবাই খুব উল্লসিত হয়ে উঠল। অথচ উল্লসিত হওয়ার মোটেও কোনো কারণ নেই। কারণ আশ্বাস মানেই ‘অঙ্গীকার’ নয় এবং ‘অঙ্গীকার’ মানেই বাস্তবায়ন নয়। এটা ছোট বাচ্চাদের খেলা নয় যে, পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি শুধু কলকাতার দিদির আশ্বাসে ঘটে যাবে। মমতা সোজাসাপ্টা কথা বলেন। পরিষ্কারভাবে বলেছেন, আমাদের কিছু সমস্যা আছে, আপনাদেরও কিছু সমস্যা আছে। দুই দিকের স্বার্থ বিবেচনা করেই পানি দিতে হবে। তাহলে তিনি কীভাবে বললেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’? কিসের আস্থা? তিস্তা নদী এখন শুকিয়ে আছে। তিস্তাপাড়ের উত্তরাঞ্চলের মানুষ এ শুকনো মৌসুমে পানি পাবে কিনা, সেটা পরিষ্কার ভাষায় শুনতে চায়। ‘আশ্বাস’ বা আস্থার কথায় তাদের চিড়া ভিজবে না।
মমতা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। আমরা জানি বাংলাদেশের যে কয়েকটি জিনিসের ওপর তাদের বিশেষ নজর আছে, তার মধ্যে ইলিশ ও জামদানি শাড়ি রয়েছে। ইদানীং দাবি করা হচ্ছে, জামদানি কলকাতায় বোনা হচ্ছে। অথচ জামদানির যে ভৌগোলিক লক্ষণচিহ্ন (geographical indicator) তার ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির দাবিদার একান্তই ঢাকার। জামদানি ডেমরা ছাড়া বাংলাদেশেরও আর কোথাও হয় না। ডেমরার তাঁতিরা ছাড়া এ বিশেষ ধরনের শাড়ি আর কেউই বুনতে পারেন না। বুনলেও সেটা ভালো শাড়ি হতে পারে, কিন্তু তাকে জামদানি বলা যাবে না। জামদানি মানেই ‘ঢাকাই জামদানি’। জামদানিকে অন্য কেউ নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বলে দাবি করলে সেটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর যেমন আঘাত হয়, একইভাবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকেও অন্যায় করা হয়। ঢাকাই জামদানি একেবারে এলাকার নির্দিষ্ট দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর আগে ফুলিয়া ও সমুদ্রগড়ে টাঙ্গাইলের বসাক পরিবারদের নিয়ে গিয়ে টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের ক্ষতি করেছে। এখন খোদ টাঙ্গাইলেই কলকাতা থেকে টাঙ্গাইল তাঁতিদের বোনা কাপড় আসে অনেক চড়া দামে। জামদানিও একপর্যায়ে তাই হবে হয়তো। আমরা জামদানি পরব ভারত থেকে এনে! ঢাকা থেকে জামদানি বুনা উঠে যাবে। এ দুর্ভাগ্যও হতে পারে। এ আশঙ্কার মধ্যে আমরা আছি। মমতা ব্যানার্জির ব্যবসার দিকনির্দেশনাকে এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে। তিনি বাংলাদেশের বন্ধু নাকি প্রতিপক্ষ, তার প্রমাণ পেতে আমাদের পর্যবেক্ষণ আরো তীক্ষ ও সুদূরপ্রসারী হতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ভারত থেকে যারা রাজনৈতিক সফরে আসেন, তারা নির্দিষ্টভাবে অনেক কিছুই নিয়ে যান, বিনিময়ে কিছু কথাসর্বস্ব আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে যান, যা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। মমতার আশ্বাস তাই জনমনে খুব আশার আলো জাগাতে পারেনি। দুঃখিত।
মমতা ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এটা খুব ভালো কথা। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা মৃত্যুর আগের অবস্থায় ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে, অথচ বাংলাদেশে এ দিবসটি কত ঘটা করে এবং সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলে কত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। তবু বলব, একুশ পালন আমাদের বাহ্যিক দিক, ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি এবং আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গোড়ায় রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির সরব উপস্থিতি। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি এবং রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের মধ্যে একাকার হয়ে আছে। একই কথা পশ্চিম বাংলা সম্পর্কে খাটে না। পশ্চিম বাংলার মানুষ বাংলা ভাষাকে কম ভালোবাসে সেটা দাবি করি না, কিন্তু সেটা তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার বাইরের চর্চার বিষয়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে মমতা ব্যানার্জি ভোর থেকেই ব্যস্ত ছিলেন। সেদিনই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠক হয়, এবং পরে তারা একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বিডিনিউজ২৪. কমের সৌজন্যে খাবার মেনু সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে পারি। খাবারের আয়োজনে ছিল ইলিশের প্রাধান্য। ভাপা ইলিশ, সর্ষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ আর ইলিশের ডিম ভাজা। এছাড়া ছিল চিতল মাছের কোপ্তা, রুই মাছের তরকারি, খাসির রেজালা ও হাড়ছাড়া মুরগির মাংসের তরকারি। খাবার শেষে রসমালাই ও মিষ্টি দইও পরিবেশন করা হয়। অর্থাত্ বাংলাদেশের সব ধরনের জনপ্রিয় খাবার দেয়া হয়েছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস। ইলিশ খাওয়ার জন্য এটা খুব ভালো সময় নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাছ ডিম পাড়ে অল্প সময়ের জন্য, আর বেশির ভাগ ডিম পাড়ে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে। এ সময় ইলিশ মাছ অনেকেই খান না।
ইলিশের আইটেম বেশি হলেও ইলিশের সঙ্গে একটি সবজি খুব ভালো লাগে, সেটা বেগুন। সেটা মেনুতে ছিল কিনা, বোঝা যায়নি। কৃষকরা একটি বিশেষ বেগুনের চাষ করেন শুধু ইলিশের সঙ্গে রান্নার জন্য। টাঙ্গাইলের কৃষক আক্কাস আলী বেগুন নিয়ে গান রচনা করেছেন। মমতা ব্যানার্জি মাটি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার হয়তো বেগুনের এ গান ভালো লাগতে পারে। এখানে ইলিশের জন্য কাঁটা চিকন ডিম বেগুনের উল্লেখ আছে। নিশ্চয় পশ্চিম বাংলায়ও ইলিশের সঙ্গে স্থানীয় জাতের বেগুনের রান্না হয়। গানের মাঝের কলি এ রকম:
কামরাঙ্গা, ভোলানাথ, আর কাঞ্চন বারমাসে
ও ভাই বোন কাঞ্চন বারমাসে
কাঁটা চিকন ডিম বেগুনি তরকারী ইলিশ মাছে রে।।
শুটকী মাছে লম্বা বেগুন, শৈল বোয়াল রুপিয়াজী
ও ভাই বোন শৈল বোয়াল রুপিয়াজী
আমার দেশী জাতের বেগুনে নাই কোন টেকনলজি।।
আমার সোনার ভাই বোন রে।।
কৃষক আক্কাস আলী গানটি লিখেছিলেন বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সচেতন করতে। মমতা বেগুন নিয়ে জেনেটিক কারিগরির কাহিনী কতটা জানেন, জানি না, কিন্তু বাংলাদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এ সবজির ওপর কোম্পানির দখলদারি বন্ধের আন্দোলনে সংহতি জানাতে পারতেন।
বাংলাদেশ থেকে মমতার কাছে চাওয়া পাওয়ার দিক ছিল তিস্তার পানি, কিন্তু তিনি গঙ্গা-যমুনার কথাই বেশি বলছিলেন। অন্যদিকে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তার রাজ্যে ইলিশ না পাওয়ার অনুযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ইলিশ খুব কম পাচ্ছি।’ কম পাওয়ার প্রধান কারণ, দেশের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন সময় তা রফতানি বন্ধ রাখে বাংলাদেশ সরকার। এটা নিঃসন্দেহে সঠিক সিদ্ধান্ত। এমনকি দেশেও বছরে কয়েকটি সময় ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইলিশ কোনো শিল্প পণ্য নয় যে চাহিদা বেশি থাকলেই যে কোনো সময় উত্পাদন বাড়িয়ে দেয়া যাবে। উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘পানি এলে ইলিশও যাবে।’ ২২ তারিখের পত্রিকায় এটাই প্রধান শিরোনাম হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানির অভাবের কথা শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মমতাও কম যান না। তিনি বলেন, তিস্তায় ইলিশ হয় না, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনায় হয়। অর্থাত্ তিনি ইলিশ নেবেন, কিন্তু পানির ব্যাপারে শুধু ‘আশ্বাস’ দেবেন, সরবে তার ওপর আস্থা রাখার আবদার জানাবেন। এটা হয় না। এককথায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন তিস্তার পানির সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক নেই। তিস্তার পানি দিতে হলে তারা নিজেদের সিদ্ধান্তেই দেবেন।
দুই
ইলিশ প্রসঙ্গে বলতে হলে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের জন্য এখন হুমকি হয়ে উঠেছে। সেটা হলো, কৃষিতে বায়োটেকনোলজির ব্যবহার কিংবা জেনেটিকালি মডিফাইড ফসলের প্রবর্তন। ভারতে কংগ্রেস সরকার জেনেটিকালি মডিফাইড বিটি তুলার চাষ শুরু করার পর ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এখনো করছেন। কিন্তু ভারতে এখনো কোনো খাদ্য ফসলে এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়নি। বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর সঙ্গে পার্টনারশিপে ভারতের মাহিকো কোম্পানি বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু করে। এ গবেষণা একই সঙ্গে ভারত, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে শুরু করা হয়েছিল ইউএসএআইডির বিশেষ কর্মসূচি Agriculture Biotechnology Support Project (ABSP II)-এর অধীনে। কিন্তু এ দুটি দেশে চাষের ছাড়পত্র পায়নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর স্থানীয় সহায়ক মাহিকো উদ্ভাবিত বিটি বেগুন ছাড়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা মরাটোরিয়াম জারি করেছে ২০১০ সালে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্যানেল অনির্দিষ্টকালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছেন। অন্যদিকে ফিলিপাইনের কোর্টে গ্রিনপিস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে (Philippines Court of Appeals issues writ against trials for Bt Brinjal, May 25, 2013 FnB news.com)। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়। ভারতে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে তারা ফিলিপাইনে চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের শেষ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ। তাই গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়েই তারা কৃষক পর্যায়ে উন্মুক্ত চাষের অনুমতির জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক। বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমোদনের মধ্যে সেটাই হয়েছে। পরিবেশ সংগঠন, কৃষক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞানীদের সব উদ্বেগ, উত্কণ্ঠার কোনো তোয়াক্কা না করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে শর্তযুক্ত সীমিত পর্যায়ে চাষের অনুমতি দেয়। এখন তারা সম্প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে যত ঝামেলাই থাকুক না কেন, খুব সহজেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) বিটি বেগুনের বীজ ভারতের মাহিকো কোম্পানি থেকে আনতে পেরেছে। বলা যায়, বারিকে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বারির কাজ কৃষকদের দিয়ে এর পরীক্ষা করানো। এখানে বিজ্ঞানের দিক থেকে কোনো অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয় নেই। কারণ প্রযুক্তি ও তার তত্ত্বাবধান সবকিছুই আসছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বারি গাজীপুর কার্যালয়ে নিজ জমিতে ২০০৫ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেছে। আশ্চর্য যে, ভারতে যা হতে দেয়া হয়নি, সেই কাজ ভারতের কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশে বিটি বেগুন বাজারজাতের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ বেগুনের আদি উত্পত্তিস্থল হলেও ভারত তাদের নিজেদের আদি জাতের বেগুন বহুজাতিক কোম্পানিকে দেয়নি। অথচ বিটি বেগুনের গবেষণা ফলাফলের অপেক্ষা না করেই চুক্তির মাধ্যমে বেগুনের মেধাস্বত্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে কোম্পানির ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে ফেলেছে। চুক্তিটি ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বারি মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো ও সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সাব-লাইসেন্স চুক্তি অনুসারে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উত্পাদিত বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব মনসান্টো ও মাহিকো কোম্পানির হাতে চলে গেছে। চুক্তিটির আর্টিকেল ১ দশমিক ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনবীজের মেধাস্বত্ব মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। আর্টিকেল ১.৬ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনের বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এ চুক্তির আর্টিকেল ৯.২(গ) অনুসারে, বিটি বেগুনবীজের বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। বিটি বেগুনবীজ ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। চুক্তির ১.১৯ ও ১.৬ ধারা অনুসারে, বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের নয়টি বেগুন, যেগুলোয় বিটি জিন সংযুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে। আর্টিকেল ৯.২(গ)-এ বলা হয়েছে, বিটি বেগুনবীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিটি জিন প্রয়োগ করা নয়টি জাত হলো— উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা, সিংনাথ, চেগা, ইসলামপুরী, দোহাজারি ও আইএসডি ০০৬।
বাংলাদেশের মতো ভারতেও বেগুনের শত শত জাত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেগুনের জাতগুলো কৃষকের হাতছাড়া করতে বাংলাদেশ সরকার এবং কোম্পানি একসঙ্গে মিলেছে। ভারত সেদিক থেকে সতর্ক রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্যভাবে ‘নির্বাচিত’ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মেধাস্বত্ব দিয়ে দেয়া, প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হওয়া এবং এ খাদ্য ফসল ভোগের পর মানবদেহে ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করা হলেও তার প্রতি তোয়াক্কা না করেই এবং প্রথম পর্যায়ে চাষের অভিজ্ঞতায় সফল না হয়েও কৃষি মন্ত্রণালয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামীতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এলে তার সবজির তালিকায় কি এ বিটি বেগুন থাকবে? ইলিশের সঙ্গে বেগুনের স্বাদ অসাধারণ! কিন্তু বিটি বেগুনের যে ক্ষতি, তা কি মমতা নিতে পারবেন? আমাদের সরকার কি তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের এ বিটি বেগুনের তরকারি খাওয়াবে?
মমতা ব্যানার্জির জন্য আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের নানা ইস্যু সামনে আসতে পারে। তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস রফতানি হচ্ছে বলে তারা খুব উত্কণ্ঠিত। বিটি বেগুন নিয়ে এ সন্ত্রাসের তুলনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার বরাতে বলা হয়েছে, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বিটি বেগুনের বীজ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী বেগুনবীজের চোরাচালানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর, ২০১৪)। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার শিরোনামে বলা হয়েছে After terror, Bangladesh sends Bt seeds into India (নভেম্বর ১০, ২০১৪) “Terror is not the only commodity that is entering Bengal through the Bangladesh border. At a time when controversies and debates over the introduction of genetically modified (‰M) crops are raging in the country and the scientific community is yet to give its opinion, Bt Brinjal seeds are being smuggled into West Bengal and farmers in the state are believed to have sown the crop in several districts. অর্থাত্ ভারত বিটি বেগুনের বীজের এ চোরাচালানকে সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করছে, যার প্রভাব রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য খুব বিপজ্জনক হতে পারে।
মমতা আসেন হাসি মুখে, যাওয়ার সময় তার হাসি আরো বেড়ে গেছে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসেছেন, নাকি শুধু একটি দল ও তার সরকারের কাছেই এসেছিলেন, তা বোঝা গেল না। তিনি শেখ হাসিনার জন্য নিজের আঁকা একটি ছবি নিয়ে এসেছিলেন। শেখ হাসিনা একটি ছবি এবং ঢাকাই জামদানি দিয়েছেন মমতাকে।
মমতা ব্যানার্জি আমাদের কিছু দিতে পারবেন না। তার কাছ থেকে কিছু চাইবার আছে কি আমাদের? নেই। তবু আমরা চাই বাংলাভাষীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক। প্রত্যাশা যে, সেটা যেন খণ্ডিত না হয়। তাকে আমরা ভালোবাসতে পারি, কোনো অসুবিধা নেই। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার ক্ষমতাও সীমিত।
তার পরও বলব, আবারো আসুন বেড়াতে মুখ্যমন্ত্রী কিংবা একজন সম্মানিত বাঙালি হিসেবে। কিন্তু আপনার আশ্বাস কিংবা আপনার ওপর আস্থা রাখার কথা বলে খামাখা বিব্রত করবেন না আমাদের। নিশ্চিতভাবেই ইলিশ চলে যাবে আর বেগুনের আদি জাত ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর তত্পরতা আপনি রোধ করার দায় বোধ করবেন না। আপনি আমাদের স্বার্থ দেখবেন, সে ভরসা করি না। তিস্তার পানির বণ্টনে ভারতীয় অধিকারকেই আপনি অগ্রগণ্য মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবুও আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা চাই। শুধু সীমান্তের ওপারের মানুষদের জন্য নয়, পানি এপারের সব মানুষেরই প্রয়োজন।
তাই আগে তিস্তার পানি আসুক। একই সঙ্গে শুধু ইলিশ ওপারে যাবে আর আমাদের বেগুনের ওপর কোম্পানির দখলদারিত্ব থাকবে, এটা মেনে নেয়া যাবে না।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক
উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)
বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি বিগত কংগ্রেস সরকারের পক্ষে মনমোহন সিংয়ের যে সরকারি সফর ছিল, তাতে তিস্তা চুক্তি প্রায় হয় হয় অবস্থায় গিয়েও হতে পারেনি মমতার আপত্তিতে। এবার তাই তিনি যখন এলেন এবং ‘আশ্বাস’ দিলেন, তখন সবাই খুব উল্লসিত হয়ে উঠল। অথচ উল্লসিত হওয়ার মোটেও কোনো কারণ নেই। কারণ আশ্বাস মানেই ‘অঙ্গীকার’ নয় এবং ‘অঙ্গীকার’ মানেই বাস্তবায়ন নয়। এটা ছোট বাচ্চাদের খেলা নয় যে, পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি শুধু কলকাতার দিদির আশ্বাসে ঘটে যাবে। মমতা সোজাসাপ্টা কথা বলেন। পরিষ্কারভাবে বলেছেন, আমাদের কিছু সমস্যা আছে, আপনাদেরও কিছু সমস্যা আছে। দুই দিকের স্বার্থ বিবেচনা করেই পানি দিতে হবে। তাহলে তিনি কীভাবে বললেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’? কিসের আস্থা? তিস্তা নদী এখন শুকিয়ে আছে। তিস্তাপাড়ের উত্তরাঞ্চলের মানুষ এ শুকনো মৌসুমে পানি পাবে কিনা, সেটা পরিষ্কার ভাষায় শুনতে চায়। ‘আশ্বাস’ বা আস্থার কথায় তাদের চিড়া ভিজবে না।
মমতা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। আমরা জানি বাংলাদেশের যে কয়েকটি জিনিসের ওপর তাদের বিশেষ নজর আছে, তার মধ্যে ইলিশ ও জামদানি শাড়ি রয়েছে। ইদানীং দাবি করা হচ্ছে, জামদানি কলকাতায় বোনা হচ্ছে। অথচ জামদানির যে ভৌগোলিক লক্ষণচিহ্ন (geographical indicator) তার ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির দাবিদার একান্তই ঢাকার। জামদানি ডেমরা ছাড়া বাংলাদেশেরও আর কোথাও হয় না। ডেমরার তাঁতিরা ছাড়া এ বিশেষ ধরনের শাড়ি আর কেউই বুনতে পারেন না। বুনলেও সেটা ভালো শাড়ি হতে পারে, কিন্তু তাকে জামদানি বলা যাবে না। জামদানি মানেই ‘ঢাকাই জামদানি’। জামদানিকে অন্য কেউ নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বলে দাবি করলে সেটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর যেমন আঘাত হয়, একইভাবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকেও অন্যায় করা হয়। ঢাকাই জামদানি একেবারে এলাকার নির্দিষ্ট দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর আগে ফুলিয়া ও সমুদ্রগড়ে টাঙ্গাইলের বসাক পরিবারদের নিয়ে গিয়ে টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের ক্ষতি করেছে। এখন খোদ টাঙ্গাইলেই কলকাতা থেকে টাঙ্গাইল তাঁতিদের বোনা কাপড় আসে অনেক চড়া দামে। জামদানিও একপর্যায়ে তাই হবে হয়তো। আমরা জামদানি পরব ভারত থেকে এনে! ঢাকা থেকে জামদানি বুনা উঠে যাবে। এ দুর্ভাগ্যও হতে পারে। এ আশঙ্কার মধ্যে আমরা আছি। মমতা ব্যানার্জির ব্যবসার দিকনির্দেশনাকে এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে। তিনি বাংলাদেশের বন্ধু নাকি প্রতিপক্ষ, তার প্রমাণ পেতে আমাদের পর্যবেক্ষণ আরো তীক্ষ ও সুদূরপ্রসারী হতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ভারত থেকে যারা রাজনৈতিক সফরে আসেন, তারা নির্দিষ্টভাবে অনেক কিছুই নিয়ে যান, বিনিময়ে কিছু কথাসর্বস্ব আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে যান, যা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। মমতার আশ্বাস তাই জনমনে খুব আশার আলো জাগাতে পারেনি। দুঃখিত।
মমতা ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এটা খুব ভালো কথা। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা মৃত্যুর আগের অবস্থায় ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে, অথচ বাংলাদেশে এ দিবসটি কত ঘটা করে এবং সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলে কত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। তবু বলব, একুশ পালন আমাদের বাহ্যিক দিক, ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি এবং আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গোড়ায় রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির সরব উপস্থিতি। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি এবং রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের মধ্যে একাকার হয়ে আছে। একই কথা পশ্চিম বাংলা সম্পর্কে খাটে না। পশ্চিম বাংলার মানুষ বাংলা ভাষাকে কম ভালোবাসে সেটা দাবি করি না, কিন্তু সেটা তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার বাইরের চর্চার বিষয়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে মমতা ব্যানার্জি ভোর থেকেই ব্যস্ত ছিলেন। সেদিনই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠক হয়, এবং পরে তারা একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বিডিনিউজ২৪. কমের সৌজন্যে খাবার মেনু সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে পারি। খাবারের আয়োজনে ছিল ইলিশের প্রাধান্য। ভাপা ইলিশ, সর্ষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ আর ইলিশের ডিম ভাজা। এছাড়া ছিল চিতল মাছের কোপ্তা, রুই মাছের তরকারি, খাসির রেজালা ও হাড়ছাড়া মুরগির মাংসের তরকারি। খাবার শেষে রসমালাই ও মিষ্টি দইও পরিবেশন করা হয়। অর্থাত্ বাংলাদেশের সব ধরনের জনপ্রিয় খাবার দেয়া হয়েছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস। ইলিশ খাওয়ার জন্য এটা খুব ভালো সময় নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাছ ডিম পাড়ে অল্প সময়ের জন্য, আর বেশির ভাগ ডিম পাড়ে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে। এ সময় ইলিশ মাছ অনেকেই খান না।
ইলিশের আইটেম বেশি হলেও ইলিশের সঙ্গে একটি সবজি খুব ভালো লাগে, সেটা বেগুন। সেটা মেনুতে ছিল কিনা, বোঝা যায়নি। কৃষকরা একটি বিশেষ বেগুনের চাষ করেন শুধু ইলিশের সঙ্গে রান্নার জন্য। টাঙ্গাইলের কৃষক আক্কাস আলী বেগুন নিয়ে গান রচনা করেছেন। মমতা ব্যানার্জি মাটি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার হয়তো বেগুনের এ গান ভালো লাগতে পারে। এখানে ইলিশের জন্য কাঁটা চিকন ডিম বেগুনের উল্লেখ আছে। নিশ্চয় পশ্চিম বাংলায়ও ইলিশের সঙ্গে স্থানীয় জাতের বেগুনের রান্না হয়। গানের মাঝের কলি এ রকম:
কামরাঙ্গা, ভোলানাথ, আর কাঞ্চন বারমাসে
ও ভাই বোন কাঞ্চন বারমাসে
কাঁটা চিকন ডিম বেগুনি তরকারী ইলিশ মাছে রে।।
শুটকী মাছে লম্বা বেগুন, শৈল বোয়াল রুপিয়াজী
ও ভাই বোন শৈল বোয়াল রুপিয়াজী
আমার দেশী জাতের বেগুনে নাই কোন টেকনলজি।।
আমার সোনার ভাই বোন রে।।
কৃষক আক্কাস আলী গানটি লিখেছিলেন বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সচেতন করতে। মমতা বেগুন নিয়ে জেনেটিক কারিগরির কাহিনী কতটা জানেন, জানি না, কিন্তু বাংলাদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এ সবজির ওপর কোম্পানির দখলদারি বন্ধের আন্দোলনে সংহতি জানাতে পারতেন।
বাংলাদেশ থেকে মমতার কাছে চাওয়া পাওয়ার দিক ছিল তিস্তার পানি, কিন্তু তিনি গঙ্গা-যমুনার কথাই বেশি বলছিলেন। অন্যদিকে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তার রাজ্যে ইলিশ না পাওয়ার অনুযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ইলিশ খুব কম পাচ্ছি।’ কম পাওয়ার প্রধান কারণ, দেশের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন সময় তা রফতানি বন্ধ রাখে বাংলাদেশ সরকার। এটা নিঃসন্দেহে সঠিক সিদ্ধান্ত। এমনকি দেশেও বছরে কয়েকটি সময় ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইলিশ কোনো শিল্প পণ্য নয় যে চাহিদা বেশি থাকলেই যে কোনো সময় উত্পাদন বাড়িয়ে দেয়া যাবে। উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘পানি এলে ইলিশও যাবে।’ ২২ তারিখের পত্রিকায় এটাই প্রধান শিরোনাম হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানির অভাবের কথা শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মমতাও কম যান না। তিনি বলেন, তিস্তায় ইলিশ হয় না, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনায় হয়। অর্থাত্ তিনি ইলিশ নেবেন, কিন্তু পানির ব্যাপারে শুধু ‘আশ্বাস’ দেবেন, সরবে তার ওপর আস্থা রাখার আবদার জানাবেন। এটা হয় না। এককথায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন তিস্তার পানির সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক নেই। তিস্তার পানি দিতে হলে তারা নিজেদের সিদ্ধান্তেই দেবেন।
দুই
ইলিশ প্রসঙ্গে বলতে হলে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের জন্য এখন হুমকি হয়ে উঠেছে। সেটা হলো, কৃষিতে বায়োটেকনোলজির ব্যবহার কিংবা জেনেটিকালি মডিফাইড ফসলের প্রবর্তন। ভারতে কংগ্রেস সরকার জেনেটিকালি মডিফাইড বিটি তুলার চাষ শুরু করার পর ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এখনো করছেন। কিন্তু ভারতে এখনো কোনো খাদ্য ফসলে এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়নি। বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর সঙ্গে পার্টনারশিপে ভারতের মাহিকো কোম্পানি বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু করে। এ গবেষণা একই সঙ্গে ভারত, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে শুরু করা হয়েছিল ইউএসএআইডির বিশেষ কর্মসূচি Agriculture Biotechnology Support Project (ABSP II)-এর অধীনে। কিন্তু এ দুটি দেশে চাষের ছাড়পত্র পায়নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর স্থানীয় সহায়ক মাহিকো উদ্ভাবিত বিটি বেগুন ছাড়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা মরাটোরিয়াম জারি করেছে ২০১০ সালে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্যানেল অনির্দিষ্টকালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছেন। অন্যদিকে ফিলিপাইনের কোর্টে গ্রিনপিস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে (Philippines Court of Appeals issues writ against trials for Bt Brinjal, May 25, 2013 FnB news.com)। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়। ভারতে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে তারা ফিলিপাইনে চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের শেষ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ। তাই গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়েই তারা কৃষক পর্যায়ে উন্মুক্ত চাষের অনুমতির জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক। বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমোদনের মধ্যে সেটাই হয়েছে। পরিবেশ সংগঠন, কৃষক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞানীদের সব উদ্বেগ, উত্কণ্ঠার কোনো তোয়াক্কা না করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে শর্তযুক্ত সীমিত পর্যায়ে চাষের অনুমতি দেয়। এখন তারা সম্প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে যত ঝামেলাই থাকুক না কেন, খুব সহজেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) বিটি বেগুনের বীজ ভারতের মাহিকো কোম্পানি থেকে আনতে পেরেছে। বলা যায়, বারিকে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বারির কাজ কৃষকদের দিয়ে এর পরীক্ষা করানো। এখানে বিজ্ঞানের দিক থেকে কোনো অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয় নেই। কারণ প্রযুক্তি ও তার তত্ত্বাবধান সবকিছুই আসছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বারি গাজীপুর কার্যালয়ে নিজ জমিতে ২০০৫ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেছে। আশ্চর্য যে, ভারতে যা হতে দেয়া হয়নি, সেই কাজ ভারতের কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশে বিটি বেগুন বাজারজাতের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ বেগুনের আদি উত্পত্তিস্থল হলেও ভারত তাদের নিজেদের আদি জাতের বেগুন বহুজাতিক কোম্পানিকে দেয়নি। অথচ বিটি বেগুনের গবেষণা ফলাফলের অপেক্ষা না করেই চুক্তির মাধ্যমে বেগুনের মেধাস্বত্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে কোম্পানির ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে ফেলেছে। চুক্তিটি ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বারি মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো ও সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সাব-লাইসেন্স চুক্তি অনুসারে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উত্পাদিত বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব মনসান্টো ও মাহিকো কোম্পানির হাতে চলে গেছে। চুক্তিটির আর্টিকেল ১ দশমিক ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনবীজের মেধাস্বত্ব মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। আর্টিকেল ১.৬ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনের বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এ চুক্তির আর্টিকেল ৯.২(গ) অনুসারে, বিটি বেগুনবীজের বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। বিটি বেগুনবীজ ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। চুক্তির ১.১৯ ও ১.৬ ধারা অনুসারে, বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের নয়টি বেগুন, যেগুলোয় বিটি জিন সংযুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে। আর্টিকেল ৯.২(গ)-এ বলা হয়েছে, বিটি বেগুনবীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিটি জিন প্রয়োগ করা নয়টি জাত হলো— উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা, সিংনাথ, চেগা, ইসলামপুরী, দোহাজারি ও আইএসডি ০০৬।
বাংলাদেশের মতো ভারতেও বেগুনের শত শত জাত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেগুনের জাতগুলো কৃষকের হাতছাড়া করতে বাংলাদেশ সরকার এবং কোম্পানি একসঙ্গে মিলেছে। ভারত সেদিক থেকে সতর্ক রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্যভাবে ‘নির্বাচিত’ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মেধাস্বত্ব দিয়ে দেয়া, প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হওয়া এবং এ খাদ্য ফসল ভোগের পর মানবদেহে ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করা হলেও তার প্রতি তোয়াক্কা না করেই এবং প্রথম পর্যায়ে চাষের অভিজ্ঞতায় সফল না হয়েও কৃষি মন্ত্রণালয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামীতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এলে তার সবজির তালিকায় কি এ বিটি বেগুন থাকবে? ইলিশের সঙ্গে বেগুনের স্বাদ অসাধারণ! কিন্তু বিটি বেগুনের যে ক্ষতি, তা কি মমতা নিতে পারবেন? আমাদের সরকার কি তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের এ বিটি বেগুনের তরকারি খাওয়াবে?
মমতা ব্যানার্জির জন্য আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের নানা ইস্যু সামনে আসতে পারে। তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস রফতানি হচ্ছে বলে তারা খুব উত্কণ্ঠিত। বিটি বেগুন নিয়ে এ সন্ত্রাসের তুলনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার বরাতে বলা হয়েছে, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বিটি বেগুনের বীজ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী বেগুনবীজের চোরাচালানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর, ২০১৪)। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার শিরোনামে বলা হয়েছে After terror, Bangladesh sends Bt seeds into India (নভেম্বর ১০, ২০১৪) “Terror is not the only commodity that is entering Bengal through the Bangladesh border. At a time when controversies and debates over the introduction of genetically modified (‰M) crops are raging in the country and the scientific community is yet to give its opinion, Bt Brinjal seeds are being smuggled into West Bengal and farmers in the state are believed to have sown the crop in several districts. অর্থাত্ ভারত বিটি বেগুনের বীজের এ চোরাচালানকে সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করছে, যার প্রভাব রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য খুব বিপজ্জনক হতে পারে।
মমতা আসেন হাসি মুখে, যাওয়ার সময় তার হাসি আরো বেড়ে গেছে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসেছেন, নাকি শুধু একটি দল ও তার সরকারের কাছেই এসেছিলেন, তা বোঝা গেল না। তিনি শেখ হাসিনার জন্য নিজের আঁকা একটি ছবি নিয়ে এসেছিলেন। শেখ হাসিনা একটি ছবি এবং ঢাকাই জামদানি দিয়েছেন মমতাকে।
মমতা ব্যানার্জি আমাদের কিছু দিতে পারবেন না। তার কাছ থেকে কিছু চাইবার আছে কি আমাদের? নেই। তবু আমরা চাই বাংলাভাষীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক। প্রত্যাশা যে, সেটা যেন খণ্ডিত না হয়। তাকে আমরা ভালোবাসতে পারি, কোনো অসুবিধা নেই। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার ক্ষমতাও সীমিত।
তার পরও বলব, আবারো আসুন বেড়াতে মুখ্যমন্ত্রী কিংবা একজন সম্মানিত বাঙালি হিসেবে। কিন্তু আপনার আশ্বাস কিংবা আপনার ওপর আস্থা রাখার কথা বলে খামাখা বিব্রত করবেন না আমাদের। নিশ্চিতভাবেই ইলিশ চলে যাবে আর বেগুনের আদি জাত ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর তত্পরতা আপনি রোধ করার দায় বোধ করবেন না। আপনি আমাদের স্বার্থ দেখবেন, সে ভরসা করি না। তিস্তার পানির বণ্টনে ভারতীয় অধিকারকেই আপনি অগ্রগণ্য মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবুও আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা চাই। শুধু সীমান্তের ওপারের মানুষদের জন্য নয়, পানি এপারের সব মানুষেরই প্রয়োজন।
তাই আগে তিস্তার পানি আসুক। একই সঙ্গে শুধু ইলিশ ওপারে যাবে আর আমাদের বেগুনের ওপর কোম্পানির দখলদারিত্ব থাকবে, এটা মেনে নেয়া যাবে না।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক
উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)
No comments