অভিজিৎ হত্যা- আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন by কাবেরী গায়েন
আজও
ফেব্রুয়ারি। আজও রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার বিস্তার। বইমেলার মাস এখনো
শেষ হয়নি। এবং স্থানটি এ দেশের অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই চত্বর। অল্প
শীতের রাতে যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায় প্রিয়তম সহযোদ্ধা ব্লগার বন্যাকে
সঙ্গে নিয়ে মাত্র কয়েক দিনে শেষতম বইয়ের কাটতি দেখে বড় খুশিমন নিয়ে
ফিরছিলেন ঘরে। বইমেলা উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন দেশে মাত্র সেই
দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি।
কী নির্মমভাবেই না খুন করা হয়েছে তাঁকে, আর তাঁর অসুস্থ স্ত্রী বন্যাকে কুপিয়ে করা হয়েছে মৃতপ্রায়। ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের কাছে। বন্যা হাসপাতালে। বাবা অধ্যাপক অজয় রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের। নিজেও মুক্তমানুষ। শিক্ষামঞ্চ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দেশকে অগাধ দিয়েছেন আজীবন, দিয়ে চলেছেন। আগামী শনিবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনে যিনি ‘উচ্চশিক্ষার দর্শন’ নিয়ে কথা বলবেন ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে, সেখানেই দেখা হওয়ার কথা তাঁর সঙ্গে আমারও। তাঁর ছেলে অভিজিৎ রায়। ইতিমধ্যে অভিজিৎ বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক তৈরির জন্য লিখেছেন নয়টি বই। নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগে যিনি যুক্তির বিস্তার করে যাচ্ছিলেন অবিরাম, সেই তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে লেখার অপরাধে।
এবার প্রথম নয়। ফেব্রুয়ারি এলেই ঘাতকদের গাত্রদাহ শুরু হয়। কারণ, ফেব্রুয়ারি হলো সেই মাস, যে মাসে ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে ইংরেজি আর উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলানা তমিজুদ্দিন খানসহ সবাই তীব্র বিরোধিতা করে তাঁকে দেখে নেবেন বলে শাসিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের সূত্রপাত হয়েছিল তখনই, আসলে পাকিস্তান নামের ধারণায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। সেই অপরাধে তাঁকে ছেলেসহ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-শফিকউদ্দিনকে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ভাষা আন্দোলনে।
আর স্বাধীন বাংলাদেশে, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী, সাহসী বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করা হয়েছিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, ২০০৪ সালে, পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান। তিনিও বইমেলা থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হত্যা করা হয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে। আর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আরেক মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলো বইমেলার মাত্র কয়েক গজ দূরে। এবারও কুপিয়ে, হুমায়ুন আজাদের মতো এবং ব্লগার রাজীবের মতো। একদিক থেকে এসব হত্যাকাণ্ড আসলে ভাষা আন্দোলনে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি নির্মম। অনেক বেশি লক্ষ্যাভিসারী, অনেক বেশি ভোঁতা অস্ত্রের ব্যবহারে। এসব অস্ত্র কি কিছু সাক্ষ্য দেয়? হত্যার ধরন কি কোনো প্রবণতাকে চিহ্নিত করে?
প্রশ্ন হলো, বারবার এমন ঘটতে পারছে কীভাবে? এই ফেব্রুয়ারিতেই? দেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধ করে, কিন্তু পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি একটা বড় অংশের মানুষ। আর সেই মনস্তত্ত্বের বিপরীতে যাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল বলেন, তাঁরাও ক্রমেই এই মৃত্যু-উপত্যকাকে মেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, এই দেশ কি কেবল কিছু উগ্র ধর্মান্ধের, নাকি মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদেরও? এই দেশে কবিতা লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে কবি দাউদ হায়দার আর সত্য লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে। কিছু ব্লগ লেখার জন্য বুকে-পিঠে ছুরির আঘাত নিয়ে দেশান্তরি হতে হয়েছে ব্লগার অ্যাকটিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দিনকে। ব্লগ লেখার জন্য ২০১৩ সালে জেলে যেতে হয়েছে সুব্রত শুভ, রাসেল পারভেজ আর মশিউর রহমানকে। ঘাতকের আক্রমণের শিকার হয়েছেন শামসুর রাহমান, সনৎ কুমার সাহা, আঘাত এসেছে এ দেশের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ওপর। ঘাতক হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস আর অধ্যাপক তাহেরকে। হত্যা করেছে সর্বশেষ বাউলসাধক অধ্যাপক শফিউল আলমকে। মাঝেমধ্যে ভাবি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতা কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল ওদুদ, কিংবা আহমদ শরীফ, বেগম রোকেয়া আজ বেঁচে থাকলে তাঁদেরও কি একই পরিণতি হতো? পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে কতটা এগোল দেশ তবে?
সমালোচনা করি রাষ্ট্রের একচোখা নীতির। আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় মুক্তবুদ্ধির লেখক-ব্লগারদের লেখার জন্য তাঁদের ধরে নেওয়া হয়, জেলবন্দী করা হয় অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ যখন ঘাতকদের ব্লগে লেখা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ তখন কিন্তু সেসব পোস্ট রাষ্ট্রের চোখে পড়ে না। দেশটি কি তবে কেবলই উগ্রবাদীদের?
দুই.
‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়’
জ্ঞান স্থির থাকে না। জ্ঞানের উৎকর্ষের জন্য, প্রবহমানতার জন্য বরং বহু মত, বহু তর্কের কথাই বলেছেন সব মনীষী, সব দেশের সংস্কৃতিও বিকশিত হয় বহুত্বের চর্চার মধ্যে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছিল ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র শপথ নিয়ে। সেখানে ক্রমাগত বেড়েছে বিরুদ্ধ মতের বিপরীতে প্রবল সহিংসতা। আর প্রগতির দাবিদার যে রাজনৈতিক শক্তি এই অন্ধকার শক্তির বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিতে পিছপা হয়, সেই শক্তি জানে না বা জানলেও মানতে রাজি নয় যে এই অন্ধকার শক্তি কোনো দিন তাদের সমর্থন করবে না।
হাসান আজিজুল হকের ওপর যখন ফতোয়া নেমে এসেছিল, তখন আমি এডিনবরায় পড়াশোনা করছি। অভিজিৎ রায় তখন প্রায়ই যোগাযোগ করতেন কী করা যায় স্যারের জন্য, সে বিষয়ে। যোগাযোগ শুরু করলেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে। আসিফ মহিউদ্দিনকে যখন দ্বিতীয়বার কোপানো হলো, তিনি লিখলেন। পাঠালেন যে দৈনিকে, সেখানে ছাপা হলো না। তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন যেন আমি অনুরোধ করি। অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে পত্রিকা লেখাটি ছাপানোর সাহস না করলে তিনি একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে লেখাটি দেন। আমি অন্যের বিপদে তাঁর দাঁড়ানো খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি, তিনি লেখায় আর কাজে একই রকম সৎ ছিলেন। তাঁর সব বক্তব্য কিংবা বলা ভালো, তাঁর সব প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সব সময় একমত না হলেও যুক্তির প্রতি তাঁর অটল অভিনিবেশ, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নিজের প্রতিশ্রুতির প্রতি সততা দেখে শ্রদ্ধা না করে পারিনি। তাঁর এই হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মানতে পারছি না। বরং তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের পরাভবকে দেখছি।
আর ক্রমাগত পরাভব দেখছি মনুষ্যত্বের। যখন তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো টিএসসিতে অনেক মানুষের ভিড়, আশপাশেই পুলিশি প্রহরা থাকার কথা। কারণ, বইমেলায় অনেক নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেছেন। এবং ছবিতে দেখেছি, যখন তাঁর স্ত্রী সারা শরীরে রক্ত নিয়ে সাহায্য চাইছেন, তখনো মানুষ জটলা করে দেখছে। জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আর জনগণের নির্বিকার তাকিয়ে থাকার দেশটাই যে আজ আমার দেশ, সে বিষয়ে কে আর সন্দেহ করবে? রাষ্ট্র যখন ক্রমাগত হত্যাকাণ্ডের ভেতর থেকে যেতে থাকে, তার নাগরিকেরাও যে তখন সেসব হত্যাকাণ্ডে গা-সওয়া হয়ে যায়, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন ‘বোধনষ্টি’ ঘটে। কিন্তু তখন কি আর দেশটা দেশই থাকে?
তিন.
বিচার চাইতে এসেছি
লেখার উত্তর লেখা দিয়েই দিতে হবে, চাপাতির কোপে নয়। রাষ্ট্রকেই এই নিরাপত্তা দিতে হবে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার কথা যখন ব্রেকিং নিউজে দেখছিলাম, তখন এতটাই হতভম্ব হয়ে যাই যে মনে হচ্ছিল, এই কোপ আমার প্রজন্মের সব মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর নেমে এসেছে। হত্যাকারী যেই-ই হোক, তার-তাদের-তাদের খুনি মতাদর্শের বিচার চাই।
মেনে নিতে নিতে মৃত্যু যে সবার কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সত্যকে জাতি হিসেবে আমরা মেনে নিয়ে নির্বিকার থাকছি, থেকেছি অনেক বছর। পাকিস্তান-মনস্তত্ত্বে নাড়া দিয়েছিল যে একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই একুশের প্রথম কবিতার কাছে আবার আশ্রয় নিয়ে সরকারের কাছে, সব বিবেকবান মানুষের কাছে বলছি, অভিজিতের মৃত্যু কেবল কাঁদানোর জন্য নয় এবং আমি কাঁদতেও আসিনি। কেবল বিচার চাইতে এসেছি, সুনির্দিষ্ট বিচার। অভিজিৎ এই লেখা দেখবেন না, আমি এখনো ভাবতে পারছি না।
যাঁরা এই ঘটনায় ব্যথিত হয়েছেন, তাঁরা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন। মাসটি আজও ফেব্রুয়ারি এবং বিচারটি করতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কী নির্মমভাবেই না খুন করা হয়েছে তাঁকে, আর তাঁর অসুস্থ স্ত্রী বন্যাকে কুপিয়ে করা হয়েছে মৃতপ্রায়। ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের কাছে। বন্যা হাসপাতালে। বাবা অধ্যাপক অজয় রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের। নিজেও মুক্তমানুষ। শিক্ষামঞ্চ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দেশকে অগাধ দিয়েছেন আজীবন, দিয়ে চলেছেন। আগামী শনিবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনে যিনি ‘উচ্চশিক্ষার দর্শন’ নিয়ে কথা বলবেন ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে, সেখানেই দেখা হওয়ার কথা তাঁর সঙ্গে আমারও। তাঁর ছেলে অভিজিৎ রায়। ইতিমধ্যে অভিজিৎ বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক তৈরির জন্য লিখেছেন নয়টি বই। নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগে যিনি যুক্তির বিস্তার করে যাচ্ছিলেন অবিরাম, সেই তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে লেখার অপরাধে।
এবার প্রথম নয়। ফেব্রুয়ারি এলেই ঘাতকদের গাত্রদাহ শুরু হয়। কারণ, ফেব্রুয়ারি হলো সেই মাস, যে মাসে ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে ইংরেজি আর উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলানা তমিজুদ্দিন খানসহ সবাই তীব্র বিরোধিতা করে তাঁকে দেখে নেবেন বলে শাসিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের সূত্রপাত হয়েছিল তখনই, আসলে পাকিস্তান নামের ধারণায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। সেই অপরাধে তাঁকে ছেলেসহ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-শফিকউদ্দিনকে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ভাষা আন্দোলনে।
আর স্বাধীন বাংলাদেশে, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী, সাহসী বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করা হয়েছিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, ২০০৪ সালে, পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান। তিনিও বইমেলা থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হত্যা করা হয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে। আর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আরেক মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলো বইমেলার মাত্র কয়েক গজ দূরে। এবারও কুপিয়ে, হুমায়ুন আজাদের মতো এবং ব্লগার রাজীবের মতো। একদিক থেকে এসব হত্যাকাণ্ড আসলে ভাষা আন্দোলনে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি নির্মম। অনেক বেশি লক্ষ্যাভিসারী, অনেক বেশি ভোঁতা অস্ত্রের ব্যবহারে। এসব অস্ত্র কি কিছু সাক্ষ্য দেয়? হত্যার ধরন কি কোনো প্রবণতাকে চিহ্নিত করে?
প্রশ্ন হলো, বারবার এমন ঘটতে পারছে কীভাবে? এই ফেব্রুয়ারিতেই? দেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধ করে, কিন্তু পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি একটা বড় অংশের মানুষ। আর সেই মনস্তত্ত্বের বিপরীতে যাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল বলেন, তাঁরাও ক্রমেই এই মৃত্যু-উপত্যকাকে মেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, এই দেশ কি কেবল কিছু উগ্র ধর্মান্ধের, নাকি মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদেরও? এই দেশে কবিতা লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে কবি দাউদ হায়দার আর সত্য লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে। কিছু ব্লগ লেখার জন্য বুকে-পিঠে ছুরির আঘাত নিয়ে দেশান্তরি হতে হয়েছে ব্লগার অ্যাকটিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দিনকে। ব্লগ লেখার জন্য ২০১৩ সালে জেলে যেতে হয়েছে সুব্রত শুভ, রাসেল পারভেজ আর মশিউর রহমানকে। ঘাতকের আক্রমণের শিকার হয়েছেন শামসুর রাহমান, সনৎ কুমার সাহা, আঘাত এসেছে এ দেশের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ওপর। ঘাতক হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস আর অধ্যাপক তাহেরকে। হত্যা করেছে সর্বশেষ বাউলসাধক অধ্যাপক শফিউল আলমকে। মাঝেমধ্যে ভাবি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতা কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল ওদুদ, কিংবা আহমদ শরীফ, বেগম রোকেয়া আজ বেঁচে থাকলে তাঁদেরও কি একই পরিণতি হতো? পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে কতটা এগোল দেশ তবে?
সমালোচনা করি রাষ্ট্রের একচোখা নীতির। আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় মুক্তবুদ্ধির লেখক-ব্লগারদের লেখার জন্য তাঁদের ধরে নেওয়া হয়, জেলবন্দী করা হয় অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ যখন ঘাতকদের ব্লগে লেখা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ তখন কিন্তু সেসব পোস্ট রাষ্ট্রের চোখে পড়ে না। দেশটি কি তবে কেবলই উগ্রবাদীদের?
দুই.
‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়’
জ্ঞান স্থির থাকে না। জ্ঞানের উৎকর্ষের জন্য, প্রবহমানতার জন্য বরং বহু মত, বহু তর্কের কথাই বলেছেন সব মনীষী, সব দেশের সংস্কৃতিও বিকশিত হয় বহুত্বের চর্চার মধ্যে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছিল ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র শপথ নিয়ে। সেখানে ক্রমাগত বেড়েছে বিরুদ্ধ মতের বিপরীতে প্রবল সহিংসতা। আর প্রগতির দাবিদার যে রাজনৈতিক শক্তি এই অন্ধকার শক্তির বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিতে পিছপা হয়, সেই শক্তি জানে না বা জানলেও মানতে রাজি নয় যে এই অন্ধকার শক্তি কোনো দিন তাদের সমর্থন করবে না।
হাসান আজিজুল হকের ওপর যখন ফতোয়া নেমে এসেছিল, তখন আমি এডিনবরায় পড়াশোনা করছি। অভিজিৎ রায় তখন প্রায়ই যোগাযোগ করতেন কী করা যায় স্যারের জন্য, সে বিষয়ে। যোগাযোগ শুরু করলেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে। আসিফ মহিউদ্দিনকে যখন দ্বিতীয়বার কোপানো হলো, তিনি লিখলেন। পাঠালেন যে দৈনিকে, সেখানে ছাপা হলো না। তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন যেন আমি অনুরোধ করি। অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে পত্রিকা লেখাটি ছাপানোর সাহস না করলে তিনি একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে লেখাটি দেন। আমি অন্যের বিপদে তাঁর দাঁড়ানো খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি, তিনি লেখায় আর কাজে একই রকম সৎ ছিলেন। তাঁর সব বক্তব্য কিংবা বলা ভালো, তাঁর সব প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সব সময় একমত না হলেও যুক্তির প্রতি তাঁর অটল অভিনিবেশ, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নিজের প্রতিশ্রুতির প্রতি সততা দেখে শ্রদ্ধা না করে পারিনি। তাঁর এই হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মানতে পারছি না। বরং তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের পরাভবকে দেখছি।
আর ক্রমাগত পরাভব দেখছি মনুষ্যত্বের। যখন তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো টিএসসিতে অনেক মানুষের ভিড়, আশপাশেই পুলিশি প্রহরা থাকার কথা। কারণ, বইমেলায় অনেক নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেছেন। এবং ছবিতে দেখেছি, যখন তাঁর স্ত্রী সারা শরীরে রক্ত নিয়ে সাহায্য চাইছেন, তখনো মানুষ জটলা করে দেখছে। জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আর জনগণের নির্বিকার তাকিয়ে থাকার দেশটাই যে আজ আমার দেশ, সে বিষয়ে কে আর সন্দেহ করবে? রাষ্ট্র যখন ক্রমাগত হত্যাকাণ্ডের ভেতর থেকে যেতে থাকে, তার নাগরিকেরাও যে তখন সেসব হত্যাকাণ্ডে গা-সওয়া হয়ে যায়, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন ‘বোধনষ্টি’ ঘটে। কিন্তু তখন কি আর দেশটা দেশই থাকে?
তিন.
বিচার চাইতে এসেছি
লেখার উত্তর লেখা দিয়েই দিতে হবে, চাপাতির কোপে নয়। রাষ্ট্রকেই এই নিরাপত্তা দিতে হবে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার কথা যখন ব্রেকিং নিউজে দেখছিলাম, তখন এতটাই হতভম্ব হয়ে যাই যে মনে হচ্ছিল, এই কোপ আমার প্রজন্মের সব মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর নেমে এসেছে। হত্যাকারী যেই-ই হোক, তার-তাদের-তাদের খুনি মতাদর্শের বিচার চাই।
মেনে নিতে নিতে মৃত্যু যে সবার কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সত্যকে জাতি হিসেবে আমরা মেনে নিয়ে নির্বিকার থাকছি, থেকেছি অনেক বছর। পাকিস্তান-মনস্তত্ত্বে নাড়া দিয়েছিল যে একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই একুশের প্রথম কবিতার কাছে আবার আশ্রয় নিয়ে সরকারের কাছে, সব বিবেকবান মানুষের কাছে বলছি, অভিজিতের মৃত্যু কেবল কাঁদানোর জন্য নয় এবং আমি কাঁদতেও আসিনি। কেবল বিচার চাইতে এসেছি, সুনির্দিষ্ট বিচার। অভিজিৎ এই লেখা দেখবেন না, আমি এখনো ভাবতে পারছি না।
যাঁরা এই ঘটনায় ব্যথিত হয়েছেন, তাঁরা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন। মাসটি আজও ফেব্রুয়ারি এবং বিচারটি করতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments