ধর্মীয় ঝড় ও ব্রিটেন-ইউরোপের ভিনদেশি মুসলিম by ফারুক যোশী

শিরশ্ছেদের ভিডিও প্রকাশ করে আইএস
মুসলমান ও মুসলমানিত্বের নাম নিয়ে বিশেষত ইউরোপ আর আমেরিকা যেন নিয়মিত এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মত্ত। তবে এ খেলা অবশ্য সরকারের সঙ্গে মুসলমানদের নয়। তবে কি উগ্রতার বিপরীতে উগ্রদেরই যুদ্ধ? সেন্টিমেন্টের বিপরীতে অন্য সেন্টিমেন্টের প্রকাশ? ফ্রান্সের রম্য ম্যাগাজিন শার্ল এবদোর কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম বিদ্বেষ বেড়েছে তাৎক্ষণিক। স্বাভাবিকভাবেই সম্মুখে চলে আসছে এই বিদ্বেষ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। মুসলমানদের নিয়ে কিংবা মুসলমানদের কটাক্ষ করে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্বাভাবিক কারণেই বেড়েছে মুসলিম বিদ্বেষ। ফ্রান্সে অন্তত শতাধিক মুসলিম বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেছে। তার মাঝে যেমন মসজিদে ভাংচুর, অগি্নসংযোগ এমনকি গুলি করাসহ কোনো কোনো মানুষের ওপর হয়েছে হামলা। ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে কে বা কারা লিখেছে 'ইসলাম মাস্ট ডাই'। যদিও এ দেয়াল লিখন বেশি সময় স্থায়িত্ব পায়নি। স্বীকার করতেই হবে, এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। ফ্রান্সে জঙ্গি হামলায় অন্তত ১৭ জন মানুষের মৃত্যু মুসলমানদের কোনো না কোনোভাবে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করবেই। ইউরোপে তো বটেই, এমনকি সারাবিশ্বে। সে কারণেই গণমাধ্যম নতুন করে প্রতিদিন যেন জন্ম দেয় নতুন ঘটনার। ইসলামের নাম নিয়ে ঘটনাগুলো যে বানোয়াট কিংবা ভিত্তিহীন_ তাও বলা যাবে না। আইএস নামক সংগঠনটির কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কিত। ফ্রান্সের রেশ যেতে না যেতেই জাপানের দু'জন সাংবাদিককে আটকে রেখে ২০০ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করা কিংবা মুক্তিপণ না দিলে এদের শিরশ্ছেদ করার হুমকির বিপরীতে এ বিদ্বেষ নতুন মাত্রা পাবেই।
আইএস বিশ্বব্যাপী যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে লোমহর্ষক। শ্বেতাঙ্গদের ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করা হয়। তাও ইসলামের নাম নিয়ে। আইএসকে ইসলামের বাইরের কোনো গ্রুপ বলে আমরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারব না। কেননা, মুসলমানদের একটা গোষ্ঠীর সমর্থন নিয়েই এরা এগোচ্ছে। মুসলমান কিংবা ইসলাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। নীতিগতভাবে কিংবা ধর্মীয়ভাবেও আইএসকে সমর্থন করার কোনো কারণ নেই মুসলমানদের। কিন্তু যখন আমরা দেখি মুসলমান তরুণ-তরুণী এই ব্রিটেন থেকে কিংবা ইউরোপ থেকে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করে। এই ব্রিটিশ তরুণদের মাঝে আবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণদের খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তখন বহির্বিশ্বে নিজেদের দায় থেকে বাঁচানোরও পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ সিরিয়ার বিদ্রোহীরা মূলত একটা সংগঠিত শক্তি। এই শক্তি ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে সিরিয়ার জনপদ। সে জন্য আমাদের দায় সারানো বড়ই কঠোর এবং কঠিন।
আইএস নামের সংগঠনটি ইসলামিক স্টেটের কথা বলে এবং মানুষ কোরবানি দেয়, তাও পশ্চিমা মানুষ দেখে দেখে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা দেশ কিংবা দেশের মানুষকে। শুধু ব্রিটেন কিংবা পশ্চিমা দেশই নয়, জাপানিদেরও এরা ছাড়ছে না। ইসলামিক আইনের কথা বলে তারা আবার মানুষ ধরে নিয়ে মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়েও দেয়। বোকো হারামের নাম নিয়ে শত শত কিশোরী-তরুণীকে নিয়ে এরা হত্যা-ধর্ষণ চালাচ্ছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। তাতে তো প্রকারান্তরে ইসলামের বিজয়ডঙ্কা বাজছে না, বরং ওড়াচ্ছে তারা ধর্মের অশান্তি আর সন্ত্রাসের নিশান। কী অদ্ভুতভাবে ইসলামকে এরা ব্যঙ্গ করছে বিশ্বব্যাপী। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ কিংবা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এরা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নারকীয় কার্যক্রম। কখনও আল সাবাব, কখনও আল কায়দা, কখনও বোকো হারাম_ এই নামগুলো নিয়ে মূলত চালাচ্ছে তাদের একই কার্যক্রম।
স্বাভাবিকভাবেই সারা পৃথিবীতে আছে এ নিয়ে আলোচনা। সমালোচনার ঝড় বইছে। ফ্রান্সে বিদ্বেষ প্রত্যক্ষ হলেও দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ কিন্তু তাৎক্ষণিকই বলেছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, তবে কোনোভাবেই এ নিয়ে ধর্মীয় বিবাদকে তার দেশ সহ্য করবে না। সত্যি কথা বলতে কি, ব্রিটেনে এ বিদ্বেষ এতটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমনকি এর আগে একজন সৈন্যকে মুসলমানিত্বের নাম নিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করার পরও সরকার কিংবা বিরোধী দল এ নিয়ে কোনোভাবেই মুসলমানদের অহেতুক বিরোধিতায় নেই। সাধারণ মানুষের মাঝে অস্বস্তি হয়তো আছে, কিন্তু আপামর মুসলমানদের প্রতি অহেতুক ঘৃণা কিংবা ঘৃণাজনিত অপরাধ কোনো বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি। বরং ইউরোপের ধর্মীয় নেতা পোপ বলতে গেলে মুসলমানের পক্ষেই বলেছেন। তিনি শার্লি এবদো ম্যাগাজিনের নীতি কিংবা সম্পাদনা নীতির বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। তার কথায়_ 'কেউ যদি কারও মাকে অভিশাপ কিংবা গালি দেয়, তাহলে এর বিপরীতে আঘাত তো প্রত্যাশা করতেই পারে।' এবং তার দৃষ্টিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য শার্লি এবদো কর্তৃপক্ষ কোনো না কোনোভাবে উৎসাহিত করেছে ওই উগ্রবাদীদের। ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস যা-ই বলেন না কেন, এ নিয়ে মুসলমানদের খুব একটা গর্ব করার মতো কিছু নেই। কারণ যতটুকু শক্তি নিয়ে মুসলিম উগ্রবাদী জঙ্গিরা তাদের জঙ্গিত্ব চালাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো মুসলিম বিদ্বেষকে রোখার চেষ্টা করছে। সরকার কিংবা সাধারণ জনগণ উগ্র মুসলমানদের এই আক্রমণ কিংবা জঙ্গিত্বকে ব্যাপক মুসলমানদের কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করছে না। তারা বরং সৌহার্দ্য টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ম্যানচেস্টারের কোনো এক স্থানীয় কাউন্সিলের কর্মকর্তা ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির 'কিক ইসলাম আউট অব ব্রিটেন- উই নিড আওয়ার কান্ট্রি ব্যাক' এই কমেন্টের পক্ষে শ্লেষাত্মক বাক্য ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিলে তাকে কাউন্সিলের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। স্থানীয় এক অধিবাসী কাউন্সিলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ অভিযোগ দিলে কাউন্সিলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা বিবেচনা করে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। এভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সরকার আরও দৃঢ় করতে এবং ধর্মীয় কোনো প্রকার উস্কানি যেন না ছড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
লন্ডন থেকে প্রচারিত বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষত বাংলা এবং উর্দু গণমাধ্যমগুলো এখানে নিজেদের কৃষ্টি-কালচারের চেয়ে গোঁড়া ধর্মীয় মূল্যবোধকেই গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষত টিভি চ্যানেলগুলোর দিকে তাকালে বিস্মিত হতেই হয়। এরা যেন চাষ করে গোঁড়ামির। এক ধরনের গোঁড়া ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার করে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় গোঁড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বানাতে এরা উঠেপড়ে লেগেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই এরা মূলধারা থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে এবং সরে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় অবস্থান করে আধুনিকতা থেকে সরে গিয়ে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা যদি পশ্চাৎমুখী থাকে, আলখেল্লা দিয়ে নিজের শরীর আবৃত্ত করে যদি কেউ চায় আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে, তাহলে বাস্তবতা হলো সম্মুখে কেউ না করুক পরোক্ষভাবেই কেউ না কেউ তাকে পেছনে ফেলে দিতে চেষ্টা করবেই। আর সে জন্যেই শেষ পর্যন্ত চাকরির বাজারে নিজেকে কোনোভাবেই এরা টিকিয়ে রাখতে পারবে না, পারছে না। এরা না পারছে বাঙালি কিংবা পাকিস্তানি হতে, না পারছে আধুনিক মুসলমান হতে। স্বাভাবিকভাবেই তাই তারা এই সমাজ ব্যবস্থার একটা অংশও হয়ে উঠতে পারছে না। সে জন্যই এরা হতাশায় ঘুরপাক খায়। শুধুই গালি দেয়, বর্ণবাদ ডেকে আনে তারা। এবং গোটা মুসলিম তরুণ-তরুণীদের জড়িয়ে নিতে চায় এই কথিত বর্ণবাদী আহ্বানে। দ্বন্দ্ব এখানেই। দ্বন্দ্ব সংস্কৃতির। ধর্মটা মাঝখানে টেনে নিয়ে আসছে একটা গ্রুপ তাদেরই প্রয়োজনে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিতে এরা ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি করছে এই ব্রিটেন কিংবা ইউরোপে। সে কারণেই বাঙালি-পাকিস্তানি তথা মুসলমানরা এখানেই পিছিয়ে যায়।
ব্রিটেন তথা ইউরোপে ইসলাম কিংবা উগ্রতাকে পুঁজি করে উন্মাদনা যাতে না ছড়ায়, সে চেষ্টা করছে সরকার কিংবা মুক্তমনের অগণিত মানুষ। ঠিক সেভাবেই আজ আমাদেরও প্রয়োজন ধর্মীয় গোঁড়ামির বাতাবরণ থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত সমাজে বেড়ে উঠতে নতুনদের উদ্দীপ্ত করা। প্রয়োজনে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একটা সেতুবন্ধ তৈরি করা।
ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.